যে ধর্ষণে কিছু আসে যায় না

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদের সময় তোলা একটি ছবি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলকালাম হয়। ছবিতে দেখা যায় প্ল্যাকার্ড হাতে রয়েছেন ক্যাম্পাসের চা বিক্রেতা আবুল জলিল স্বপন- যিনি ‘স্বপন মামা’ হিসেবেই শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয়। প্রতিবাদ-সমাবেশে দাঁড়িয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর ধর্ষকের শাস্তির দাবির সঙ্গে দাবি করেছেন নিজের মেয়ের ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদের সময় তোলা একটি ছবি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলকালাম হয়। ছবিতে দেখা যায় প্ল্যাকার্ড হাতে রয়েছেন ক্যাম্পাসের চা বিক্রেতা আবুল জলিল স্বপন- যিনি ‘স্বপন মামা’ হিসেবেই শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয়। প্রতিবাদ-সমাবেশে দাঁড়িয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর ধর্ষকের শাস্তির দাবির সঙ্গে দাবি করেছেন নিজের মেয়ের ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড।

তার ২০ বছর বয়সী বাক-প্রতিবন্ধী মেয়েকে ২০১৮ সালে ৫৫ বছর বয়সী এক প্রতিবেশী ধর্ষণ করেছিলো। সেই ধর্ষণের আসামি জামিনে মুক্তি পেয়ে স্বপন মামার বিরুদ্ধেই এখন ডাকাতির মামলা ঠুকেছে।

খোঁজ নিলে দেখতে পাবেন দেশের বেশিরভাগ ধর্ষণের ঘটনায় কী হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কিছুই না।

আপনি দেখতে পাবেন এখন খুবই ভালো সময় চলছে। ধর্ষণের ঘটনায় ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। যেমন হয়েছিলো ঢাবি শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে, যেমন হয়েছিলো সিরামিক কারখানার শ্রমিক এবং কামরাঙ্গীর চরে এক মেয়ে গণধর্ষিত হওয়ার পর। ঢাবির শিক্ষার্থী ধর্ষিত হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ধর্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়। আর বাকি দুটি ক্ষেত্রে ধর্ষক ধরা পড়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। ধর্ষণের ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ধর্ষকদের ধরতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখছেন না। এই প্রচেষ্টা যথেষ্ট প্রশংসনীয়।

কিন্তু, ধর্ষক ধরার ক্ষেত্রে এতো উৎসাহ আগে কোথায় ছিলো? প্রিয়াঙ্কা রানি দেবনাথ নামে এক মেয়ের সঙ্গে এমনটি করা হয়নি কেনো? তার পক্ষ নিয়ে কেউ বিক্ষোভ করেননি, আন্দোলন করেননি। দেশের বিচারব্যবস্থায় নিজের মামলা নিজেকেই ঠেলতে হয়েছিলো। কিন্তু, নড়াচড়ার কোনো ইচ্ছাই ছিলো না ‘সিস্টেমের’।

গত বছর দ্য ডেইলি স্টারের স্টার উইকেন্ড ম্যাগাজিন প্রিয়াঙ্কার লড়াই নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলো। এর শিরোনাম ছিলো ‘The Burden of Proof’। ধর্ষিত হওয়া একজনের জন্য বিচার পাওয়া কতো কঠিন তা তুলে ধরা হয়েছিলো সেই প্রতিবেদনে। ঘটনার পরপরই রক্তাক্ত প্রিয়াঙ্কা একাই চলে গিয়েছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য। মাসের পর মাস, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিজেই যোগাযোগ রেখে ধর্ষণকারীদের খুঁজতে তাগাদা দিয়েছেন। তদন্ত কর্মকর্তা উল্টো ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে যৌন হয়রানিমূলক আচরণ করে। কিন্তু, এর তিন মাস পরও কোনো অগ্রগতি না দেখে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন ভুক্তভোগী। তার আশা ছিলো সাংবাদিকরা তার কষ্ট বুঝবে। কিন্তু, সেই সংবাদ সম্মেলনের পুরুষ সাংবাদিকরা তার কাছে ধর্ষণের বিশদ বিবরণ জানতে চান। শেষ পর্যন্ত তারা তার বক্তব্যকে ‘খাপছাড়া’ এবং ‘সংবাদ হিসেবে প্রকাশের অযোগ্য’ ধরে নেন।

এখানেই শেষ না। যৌন হয়রানি থেকে বাঁচতে প্রিয়াঙ্কা থানাকে অনুরোধ করেন একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য। তার মামলার নতুন তদন্ত কর্মকর্তা শুরু থেকেই ছিল নিষ্ক্রিয়। ফোন নম্বর ব্যবহার করে ধর্ষককে সহজেই খুঁজে বের করা সম্ভব আমাদের পুলিশ বাহিনীর। কিন্তু তা না করে তদন্ত কর্মকর্তা তাকেই বলে ধর্ষক কোথায় থাকে তা খুঁজে বের করতে। তিনি তার মামলা হস্তান্তরের অনুরোধ নিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) যান। তারা মামলাটি হাতে নেয় ঠিকই, কিন্তু তারা প্রিয়াঙ্কাকে বলে অনলাইনে একটি নকল আইডি তৈরি করে ধর্ষকের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে। বন্ধুত্বের এক পর্যায়ে এক জায়গায় তারা দেখা করবে। সেখান থেকে ধর্ষককে গ্রেপ্তার করবে পিবিআই। পুলিশের কাজে সহযোগিতা করার জন্য, সব ভয় এবং মানসিক যন্ত্রণা উপেক্ষা করে প্রিয়াঙ্কা আবার কথা বলা শুরু করেন সেই পুরুষের সঙ্গে, যে তাকে ধর্ষণ করেছিলো। তিনি ধর্ষককে এক জায়গায় নিয়ে আসেন, যেখানে পুলিশ ওত পেতে ছিলো এবং অবশেষে ধর্ষক ধরা পড়ে।

পুলিশ যখন ধর্ষককে ভ্যানে তুলছিলো তখন ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় সবার সামনে প্রিয়াঙ্কা স্বস্তির কান্নায় ফেটে পরেন- সেই দৃশ্য আমি কখনো ভুলতে পারবো না। ন্যায়বিচারের জন্য তার যে ‘ম্যারাথন যাত্রা’ তার একটি অংশ অন্তত শেষ হলো। এখন সময় আদালতে লড়াইয়ের।

সোহাগী জাহান তনুর মামলার দিকে না হয় নাই গেলাম। ২০১৬ সালে তাকে গণধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছিলো। তার লাশ কবর থেকে তুলে দুই দফায় ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। তনু হত্যার বিচারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলো সারাদেশের সাধারণ মানুষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তনুর হত্যার বিচার চেয়ে  হ্যাশট্যাগ ছড়িয়ে পড়ে। ময়নাতদন্তে তার শরীরে তিনটি আলাদা আলাদা ডিএনএ নমুনা পাওয়া যায়। কিন্তু, সেখানই থেমে গেছে মামলাটি। মামলাটি ‘দাফন’ হয়ে আছে দেশের অন্যতম অভিজাত তদন্ত সংস্থা সিআইডির কাছে।

কেনো ডিএনএর নমুনা পাওয়ার চার বছর পরও তনুর ধর্ষকদের গ্রেপ্তার করা গেলো না? তারা ঢাবি শিক্ষার্থীর ধর্ষকের মতো রাস্তার নেশাখোর নয় বলে কি?

ধর্ষণের পর প্রাণে বেঁচে যাওয়া ঢাবি শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে এতো দ্রুত ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট মিলে যাওয়াটাও একটু গোলমেলে। ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার বলেছিলেন, “বেশিরভাগ ধর্ষণের শিকার নারীর মেডিকেল রিপোর্ট জমা দিতে এক মাসের বেশি সময় লেগে যায়।”

তার মতে, “যেহেতু বিচার প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ সময় নেয় তাই অনেক ভুক্তভোগী আদালতের বাইরে ধর্ষকদের সঙ্গে সালিশ করে নেন। ফলে, মুক্তই থেকে যায় ধর্ষক।” ২০১৮ সালে দৈনিক প্রথম আলোর এক তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলোর ৪১ শতাংশ বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যেই হারিয়ে গেছে।

ফাহমিদা আক্তারের মতে, “ধর্ষণকারীরা টাকা-পয়সা দিয়ে আপোষ করে ফেলে, নতুবা বাদীদের মামলা তুলে নেওয়ার হুমকি দেয়। এমনকী, ধর্ষণের পর, সেই নারীকে আবার ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ারও উদাহরণ রয়েছে।”

ধর্ষণের শিকার ঢাবি শিক্ষার্থীর ব্যাপারে রাষ্ট্রের যে প্রশংসনীয় উদ্যোগ তার সঙ্গে অন্যান্য ধর্ষণ মামলার পার্থক্য রয়েছে।

এমনকী, ধর্ষণে অভিযুক্ত মজনুকে যেদিন ঢাবি শিক্ষার্থীর সঙ্গে আদালতে আনা হলো সেদিন মেয়েটিকে ট্রমা থেকে রক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিলো। তারা তাকে বোরখায় আবৃত করে সবার আড়ালে ম্যাজিস্ট্রেটের ঘরে নিয়ে যান। ঠিক একই সময়, ধর্ষণ মামলায় বিচার প্রার্থী অন্যান্য নারীরা জনসম্মুখে দাঁড়িয়ে-বসে অপেক্ষা করছিলেন, হয় ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট ভবনের পার্কিংয়ে, নতুবা এজলাসের বাইরে- বারান্দায়।

ঢাবির শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সংবেদনশীলতা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু, একই সঙ্গে আমাদের জানা প্রয়োজন, অন্যান্য ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রেও কেনো একই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে রাষ্ট্র কী করতে পারে তা তারা নিজেরাই দেখিয়েছে। তাহলে কেনো সবক্ষেত্রে তা হয় না?

আমরা জানতে পারলাম, অপরাধী একজন ‘সিরিয়াল রেপিস্ট’। তাই, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তার ডিএনএর নমুনা অন্যান্য মামলায় সংগ্রহ করা ডিএনএর সঙ্গে মিলে কী না তা দেখার জন্য আমাদের সবিনয় অনুরোধ থাকলো। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অতীতে যে নারীদেরকে ধর্ষণ করেছে তাদেরকে  খুঁজে বের করুন। সে নাকি রাস্তার ভিক্ষুক এবং মানসিক প্রতিবন্ধীদের ধর্ষণ করতো- তাদের কাছে যান। সেসব নারীদের জন্যে পুরো জাতি প্রতিবাদ করেনি, সেসব নারীদের জানান, তাদের ধর্ষক ধরা পড়েছে।

এই দেশের নারীদের কাছে প্রমাণ দিন যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ঢাবি শিক্ষার্থীর মামলাটি শুধুমাত্র ভাবমূর্তি বাঁচানোর জন্য, লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে বা আন্দোলন স্তিমিত করার জন্য সমাধান করছে না। আসলেই তারা ধর্ষণের অবসান ঘটাতে চান।

এটা করুন, কেনো করবেন না?

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

12h ago