আমেরিকা-ইরান বিরোধ: ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ
আমেরিকা ও ইরানের দ্বন্দ্বে দীর্ঘদিন থেকেই উত্তাল হয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্য। এ বছরের শুরুতেই হোয়াইট হাউসের নির্দেশে ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা কাশেম সোলাইমানিকে হত্যা এবং জবাবে ইরাকে দুটি মার্কিন বিমান ঘাঁটিতে তেহরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা সে উত্তেজনাকে চরম মাত্রায় নিয়ে গেছে।
ইরানের খনিজ সম্পদ নিয়ন্ত্রণ, দেশটির উপর আমেরিকার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা, পারমাণবিক শক্তি অর্জনের আকাঙ্ক্ষা এবং মধ্যপ্রাচ্যে উভয় রাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের আগ্রহ থাকায় দেশ দুটির মধ্যে গত অন্তত পাঁচ দশক ধরে চলা দ্বন্দ্ব বিশ্বব্যাপী আলোচনা ও ভাবনার বিষয়।
আমেরিকা-ইরানের ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের ক্রমধারা নিচে তুলে ধরা হলো:
১৯২৫-১৯৪১: ইরানের উপর ব্রিটিশ প্রভাব
বিংশ শতকের শুরু থেকেই ইরানের তেলের খনিগুলো অ্যাংলো-ইরানিয়ান তেল কোম্পানি নামে এক ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে ছিলো।
১৯২৫ সালে ব্রিটিশদের সহায়তায় অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রেজা শাহ পাহলভি ইরানের বাদশাহ হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন।
১৯৫১: গণতান্ত্রিক ইরান
ভোটে জয়লাভ করে ইরানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন মোহাম্মদ মোসাদ্দেক। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি তেলক্ষেত্রগুলো জাতীয়করণের ঘোষণা দেন।
১৯৫৩: সিআইএ’র ষড়যন্ত্রে গণতন্ত্রের পতন
ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এবং সিআইএ’র সহায়তায় সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থানে মোহাম্মদ মোসাদ্দেক ক্ষমতাচ্যুত হন। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে পাহলভি আবারও ইরানের বাদশাহ হিসেবে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন।
১৯৫৭: পারমাণবিক কর্মসূচিতে ইরান
ইরানকে পারমাণবিক প্রযুক্তি সহযোগিতার বিষয়ে আমেরিকা ও ইরানের মধ্যে চুক্তি হয়। সেসময় তেহরানে ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার সায়েন্স প্রতিষ্ঠা করা হয়।
১৯৬৪: আয়াতুল্লাহ খোমেনির নির্বাসন
ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনিকে দেশ থেকে বের করে তুরস্কে নির্বাসনে পাঠানো হয়। এরপর তিনি ইরাক, কুয়েত ও সবশেষে ফ্রান্সে নির্বাসিত ছিলেন।
১৯৬৭-৬৮: পারমাণবিক গবেষণায় অগ্রগতি
ইরানকে আমেরিকা একটি ৫ মেগাওয়াটের রিসার্চ রিঅ্যাক্টর সরবরাহ করে। এর জ্বালানির হিসেবে দেওয়া হয় ৫ কেজির বেশি ইউরেনিয়াম। সেগুলো ৯৩ শতাংশ পরিশোধিত ছিলো।
এরপর, ইরান পারমাণবিক শক্তির বিস্তার নিয়ন্ত্রণ (এনপিটি) চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
১৯৭৯: ইরানে ইসলামী বিপ্লব
শাহ আমলের অনাচার, দুঃশাসন ও দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে ইরানজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভ দমনে হাজার হাজার ইরানিকে হত্যা করে শাহের সৈন্যবাহিনী।
অবশেষে, খোমেনির নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালে রেজা শাহ পাহলভির পতন ঘটে। প্রায় ১৪ বছরের নির্বাসিত জীবন ছেড়ে বিপ্লবের নেতা হিসেবে আয়াতুল্লাহ খোমেনির দেশে প্রত্যাবর্তন।
১৯৭৯-৮০: জিম্মি সংকট
১৯৭৯ সালে রেজা শাহ ক্যানসার চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় যান। অত্যাচারী শাহকে পৃষ্ঠপোষকতা করার প্রতিবাদে ও তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার দাবিতে বিপ্লব সফল হওয়ার দুই সপ্তাহ পর তেহরানে মার্কিন দূতাবাসে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা প্রবেশ করে। এক পর্যায়ে ৫২ আমেরিকানকে জিম্মি করে বিক্ষোভকারীরা। ৪৪৪ দিন পর সেই জিম্মি সংকটের অবসান হয়।
সেসময় ইরানের ওপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের পাশাপাশি সমস্ত কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে আমেরিকা।
১৯৮০-৮৮: ইরাক-ইরান যুদ্ধ
আমেরিকার প্ররোচনায় ইরানের বিপ্লবী সরকারকে উৎখাত করতে প্রতিবেশী দেশটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ইরাক।
সীমান্ত বিরোধ এবং ইরাকের অভ্যন্তরে শিয়াদের মদত দেওয়ার অভিযোগে ১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইরাকি বাহিনী পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই অবৈধভাবে ইরানকে আক্রমণ করে।
সেসময় ইরাকি বিমানবাহিনী ইরানের ১০টি বিমানঘাঁটির উপর অতর্কিত আক্রমণ চালালে পূর্ণ যুদ্ধে চলে যায় ইরাক ও ইরান।
আট বছরব্যাপী চলা যুদ্ধে ইরাক ও ইরানের দশ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়। আহত হয় প্রায় ১৫ লাখ মানুষ।
১৯৮৬: আমেরিকার কন্ট্রা কেলেঙ্কারি
ইরান-ইরাক যুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাষ্ট্র গোপনে ইরানের কাছে অবৈধ অস্ত্র বিক্রি করে এবং তা থেকে প্রাপ্ত অর্থ নিকারাগুয়ার তৎকালীন কমিউনিস্ট সরকার উৎখাতের জন্য কন্ট্রা বিদ্রোহীদের কাছে পাচার করে।
আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগ্যান ও বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ মার্কিন কর্মকর্তা এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন।
১৯৮৮: ইরানের যাত্রীবাহী বিমানে আমেরিকার হামলা
পারস্য উপসাগরে ইরান উপকূলের সমুদ্রসীমায় ঢুকে ‘ভিনসেন্স’ নামের মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ইরানের একটি যাত্রীবাহী বিমানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। বিমানটির ২৯৮ জন আরোহীর সবাই নিহত হন।
১৯৯৭: ইরানের কুদস ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে কাশেম সোলাইমানি
ইরানের বিপ্লবী গার্ডের (আইআরজিসি) কমান্ডার কাশেম সোলাইমানিকে ‘কুদস ফোর্স’র প্রধান বানানো হয়। এই ‘স্পেশাল অপারেশন ইউনিট’র মূল কাজ হচ্ছে ইরানের বাইরে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার করা।
সোলাইমানির নেতৃত্বে সিরিয়া, ইয়েমেন ও লেবানন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে কুদস ফোর্স। হামাস, ইসলামিক জিহাদসহ অসংখ্য গেরিলা দলকে বিভিন্ন সময় সামরিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্র প্রদান করে।
এই বাহিনীর কর্মকাণ্ড নিয়ে সোলাইমানিকে জবাবদিহি করতে হয় শুধুমাত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির কাছে।
২০০২: এক্সিস অফ ডেভিল
সেপ্টেম্বর মাসে ইরানের বুশেহরে প্রথমবারের মতো রুশ প্রযুক্তির সহায়তায় নির্মিত হয় পারমাণবিক চুল্লি।
২০০১ সালে নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর আফগানিস্তানে তালেবানদের বিরুদ্ধে আমেরিকানদের যুদ্ধে ইরান আমেরিকাকে সহযোগিতা করলেও রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লু বুশ ইরানকে ‘শয়তানের অক্ষশক্তি’ হিসেবে আখ্যা দেন।
২০০৩: ইরানের পারমাণবিক হুমকি
আমেরিকা জানায়, ইরান ইউরেনিয়াম উৎপাদনের আড়ালে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে। ইরান জানায়, তারা ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করছে এবং নিজস্ব প্রযুক্তির সাহায্যে জ্বালানি উৎপাদনের দিকে যাচ্ছে। এরপর আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা তেহরানের নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট পরীক্ষা করতে শুরু করলে ইরানের রাষ্ট্রপতি আহমেদিনেজাদ কট্টর অবস্থানে গিয়ে আরও জোরালো করে তুলেন দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচি।
এর ফলে, ইরানের ওপর আমেরিকা ও ইউরোপের নতুন নতুন নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়।
২০১৩-১৫: পারমাণবিক চুক্তিতে ইরানের স্বাক্ষর
মধ্যপন্থি হিসেবে পরিচিত হাসান রুহানি ইরানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়লাভ করার পর ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম বন্ধ বা সীমিত করে পশ্চিমের মিত্র দেশগুলো সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দেন।
২০১৫ সালে ছয় বিশ্বশক্তির সঙ্গে ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি সংক্রান্ত একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, চীন এবং রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের সেই চুক্তি হয়।
চুক্তির পর ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়া থেকে সরে আসে ইরান। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ইরান সংবেদনশীল পরমাণু গবেষণা সীমিত করতে রাজি হয়। অপরদিকে, দেশটির বিরুদ্ধে আনা অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলো দেশ ছয়টি।
২০১৭: আমেরিকার রাষ্ট্রপতির পদে ডোনাল্ড ট্রাম্প
ইরানসহ সাতটি মুসলিম দেশের নাগরিকদের জন্য ভিসা বাতিলের ঘোষণা দেয় আমেরিকার নতুন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প।
তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ইরান আর ডলার ব্যবহার করবে না বলে ঘোষণা দেয়।
২০১৮: পরমাণু চুক্তি থেকে সরে আসার ঘোষণা ট্রাম্পের
ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর ইরানের সঙ্গে বিশ্বশক্তির পরমাণু চুক্তিতে শর্তের ঘাটতি রয়েছে বলে ঘোষণা দেন। ইরান এখনো মাত্রাতিরিক্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে বলে অভিযোগ তুলে ২০১৮ সালের মে মাসে ট্রাম্প সেই চুক্তি থেকে সরে আসেন।
চুক্তি থেকে সরে এসে ইরানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আমেরিকা।
এপ্রিল, ২০১৯
ইরানের কুদস ফোর্সকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ঘোষণা দেয় আমেরিকা। জবাবে, ইরান অভিযোগ করে, আমেরিকা ‘রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাসবাদ’ চালাচ্ছে।
জুন, ২০১৯
পারস্য উপসাগরে তেলের ট্যাংকারে হামলা এবং আমেরিকান ড্রোন ভূপাতিত হলে এর দোষ পড়ে ইরানের ওপর। সেসময় ইরানের ওপর আরেক দফা অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে আমেরিকা।
ইরান নতুন করে পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করে। সেসময় দেশটির শীর্ষ ব্যক্তিরা চুক্তির কিছু অংশ না মানার ঘোষণা দেয়।
ডিসেম্বর, ২০১৯
ইরাক ও সিরিয়ায় বিমান হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। সেই হামলায় ইরাকের কয়েকজন শীর্ষ শিয়া মিলিশিয়া কমান্ডার নিহত হন। জবাবে, বাগদাদে মার্কিন দূতাবাস ঘেরাও করে ইরান-সমর্থিত ইরাকিরা। সেখানে তারা বিক্ষোভ করে, দূতাবাস ভবনে ভাঙচুর চালায়।
জানুয়ারি, ২০২০
ট্রাম্পের নির্দেশে ইরাকে ড্রোন হামলা চালিয়ে মার্কিন সেনারা ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও কুদস ফোর্সের প্রধান জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে হত্যা করে।
ইরান প্রতিশোধ হিসেবে ইরাকে দুটি মার্কিন বিমানঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। সেদিনই ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বিধ্বস্ত হয় ইউক্রেনীয় উড়োজাহাজ। নিহত হয় ১৭৬ জন আরোহী। উড়োজাহাজ ভূপাতিত করার কথা ইরানের শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে তা মেনে নেয়। এরপর সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনিসহ দেশটির শীর্ষ ব্যক্তিদের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ইরানের তরুণ সমাজ।
Comments