কন্টেইনারের অবৈধ বাণিজ্য

রাস্তায় যে সব লরি চলতে দেখেন সেগুলো সম্ভবত তৈরি হয়েছে চ্যাসিসের ওপর শিপিং কন্টেইনার বসিয়ে।
লরিগুলো এভাবে তৈরি করা এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ট্রাক কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির প্রধান মকবুল আহমেদ বলেছেন, “৯৬ থেকে ৯৮ ভাগ লরিই শিপিং কন্টেইনার দিয়ে তৈরি।”
তিনি আরও জানিয়েছেন, একটি শিপিং কন্টেইনার দিয়ে লরির বডি তৈরি করতে ব্যয় হয় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা।
কন্টেইনার দিয়ে লরি তৈরি করলে খরচ অনেক কম হয় বলেই এটি এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর খরচ এতো কম হওয়ার কারণ হলো, সরকারি কর এবং ফি ফাঁকি দিয়ে কন্টেইনার বিক্রি করা। এভাবে লরির বডি তৈরি করা অবৈধ।
বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য নিয়ে আসা এবং বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানির জন্য আনা খালি কন্টেইনারগুলো পুনরায় পণ্য নিয়ে অথবা খালি ফেরত যাওয়ার কথা। কিন্তু, কাস্টমস কর্তৃপক্ষের অবহেলা এবং তদারকির অভাবে এসব কন্টেইনার স্থানীয় বাজারে কর ফাঁকি দিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে।
এসব কন্টেইনারগুলোই লরি (কাভার্ড ভ্যান নামে পরিচিত), দোকান এবং অস্থায়ী আবাসন তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এই অবৈধ বাজারটির মূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ এবং গাজীপুরে শতাধিক ওয়ার্কশপে পুরাতন এবং নতুন কন্টেইনার বিক্রি করা হয়।
শুল্ক পরিশোধ করে কন্টেইনার আমদানি কিংবা বাংলাদেশে কন্টেইনার তৈরি না হলেও ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিআরটিএতে নিবন্ধিত লরির (কাভার্ড ভ্যান) সংখ্যা ৩৪ হাজার ৫৪৩টি।
মূলত চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে শিপিং এজেন্টরা খালি অথবা আমদানিকৃত পণ্য বোঝাই কন্টেইনার নিয়ে আসে। বিক্রির উদ্দেশ্যে আমদানি না হওয়ায় এসব কন্টেইনারগুলো পণ্য হিসেবে গণ্য হয় না। যার কারণে এগুলো আনতে কোন ধরনের শুল্ক দিতে হয় না। তবে এসব কন্টেইনারগুলো ছয় মাসের মধ্যেই ফেরত পাঠানোর শর্ত থাকে।
১৯৯৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জারিকৃত দেশের স্থায়ী শুল্ক আদেশ-০১ অনুযায়ী কন্টেইনারগুলো যদি ফেরত পাঠানো না হয়, তাহলে প্রতিটি ২০ ফুট কন্টেইনারের জন্য ৬০ হাজার টাকা এবং ৪০ ফুট কন্টেইনারের জন্য এক লাখ ৪০ হাজার টাকা আমদানি শুল্ক দিতে দায়বদ্ধ থাকে শিপিং এজেন্টরা।
নজরদারি নেই, আছে অজুহাত
কোনো শিপিং এজেন্ট যদি খালি কন্টেইনার নিয়ে আসে তখন কাস্টমসের সাধারণ বন্ড শাখায় এর বিস্তারিত বিবরণের তালিকা জমা দেয়। যা বিএল নামে পরিচিত। কাস্টমসের সার্ভারে এর বিস্তারিত তথ্য থাকে।
খালি কন্টেইনারগুলো আসার সময় কোনও বিল অফ এন্ট্রির প্রয়োজন হয় না। তবে কাস্টমস কর্মকর্তারা তাদের সার্ভার এবং বিএল থেকে কোন কন্টেইনার কোথায় আছে তা খুঁজে বের করতে পারেন।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের কমিশনার ফখরুল আলম জানিয়েছেন, কতোগুলো খালি কন্টেইনার আনা হয়েছে বা কতোগুলো কন্টেইনার রপ্তানি পণ্যের সঙ্গে ফেরত গেছে তা তারা জানেন না। কারণ খালি কন্টেইনার আসলে সেগুলোর বিল অব এন্ট্রি বা লেটার অব ক্রেডিট প্রয়োজন হয় না।
তিনি জানিয়েছেন, কোনও কন্টেইনার ধ্বংস করতে হলে বা বিক্রি করতে হলে শিপিং এজেন্টদের অবশ্যই শুল্ক দিতে হবে। এই খাতে কাস্টমস এখনও কোনও টাকা পায়নি।
চট্টগ্রামে বিভিন্ন কন্টেইনার বিক্রির দোকান এবং ওয়ার্কশপে এই সংবাদদাতা ট্র্যাকিং নম্বরসহ কমপক্ষে ৫৭টি খালি কন্টেইনার দেখতে পান।
সাতটি কন্টেইনারের ট্র্যাকিং নম্বর এই সংবাদদাতা চট্টগ্রাম বন্দরের সার্ভার কন্টেইনার টার্মিনাল ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসের (সিটিএমএস) তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছিলেন।
সিটিএমএসের তথ্য অনুযায়ী, কন্টেইনারগুলো ২০১৮ সালের ২১ আগস্ট থেকে ২০১৯ সালের ২৪ জুনের মধ্যে বাংলাদেশে এসেছিলো এবং বন্দরের ইয়ার্ডে আছে।
বন্দর নগরের নয়াবাজার এলাকায় আজমির মেরিন এন্টারপ্রাইজের ওয়ার্কশপে একটি কন্টেইনার রয়েছে যার ট্র্যাকিং নম্বর এফসিআইইউ৩১৩৮২৫১। সিটিএমএস এবং কাস্টমসের সার্ভারের তথ্য অনুযায়ী এই কন্টেইনারটি এইচআর শিপিং লাইনস গত বছরের ১ জুন নিয়ে এসেছিলো এবং এখনও সেটা বন্দরেই আছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, বন্দরের সার্ভারটি নিয়মিত আপডেট করা সম্ভব হয় না।
তবে দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে তথ্য আপডেটের কাজ করা হয় বলে তিনি দাবি করেছেন।
এতো আগে কন্টেইনার বন্দর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরও সার্ভারটি ভুল তথ্য কেনো দেখাচ্ছে সে বিষয়ে তারা অনুসন্ধান করবেন জানিয়ে তিনি বলেছেন, “আমরা তথ্যগুলো যাচাই করবো।”
এফসিআইইউ৩১৩৮২৫১ নম্বর কনটেইনার সম্পর্কে এইচআর শিপিং লাইনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রকিবুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেছেন, “এই কন্টেইনার হয়তো বন্দর বা ডিপোর বাইরে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু, আমরা জানি না তা কীভাবে গেলো।”
তিনি বলেছেন, কখনও কখনও কন্টেইনারের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে শেষ গন্তব্যে পৌঁছানোর পর তা ধ্বংস করে ফেলা হয় বা নিলামে বিক্রি করা হয়। তবে, তা করতে হয় শুল্ক দিয়ে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়ার পর।
তার দাবি, “আজ অবধি আমরা কোনো কন্টেইনার বিক্রি বা ধ্বংস করিনি।”
গত বছর, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এবং ডেলিভারি দেওয়া হয়নি এমন কমপক্ষে ছয় হাজার আমদানি চালানের বিষয়ে তদন্ত করা হয়। দেখা যায়, শিপিং এজেন্ট এবং দেশের কন্টেইনার ডিপোর মালিকরা কন্টেইনার সংক্রান্ত কাস্টমসের নিয়ম মানছেন না।
তদন্ত এখনও চলছে। তবে, কতোগুলো কন্টেইনারের খোঁজ নেই তা কর্মকর্তারা বলতে পারেননি।
তদন্তের নেতৃত্বে থাকা কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার শরিফুল হাসান ডেইলি স্টারকে বলেছেন, কাস্টমস হাউজের সাধারণ বন্ড শাখা কন্টেইনারগুলোর ওপর নজরদারি করছে না। এই তদারকির অভাবে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
কাস্টমস হাউজের ১৯৯৯ সালের আদেশটি সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন সাধারণ বন্ড বিভাগের সহকারী কমিশনার নীতীশ কুমার বিশ্বাস এবং কাস্টমস হাউসের রাজস্ব কর্মকর্তা স্বপন কুমার বেপারী।
স্বপন জানান, বেশিরভাগ শিপিং এজেন্ট এবং বেসরকারি ডিপো মালিকরা বন্দর থেকে ডিপোতে স্থানান্তরিত কন্টেইনারগুলোর একটি তালিকা জমা দেন। তবে বন্দর ছেড়ে যাওয়া কন্টেইনারগুলো ডিপো থেকে পুনরায় ফেরত যাচ্ছে কী না তা নিশ্চিত করার জন্য কোনো যাচাই করা হয় না।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান বলেছেন, নিখোঁজ কন্টেইনারের ক্ষতিপূরণ দিতে ডিপো মালিকরা দায়বদ্ধ।
তিনি বলেছেন, “এখনও পর্যন্ত কোনও শিপিং এজেন্ট কন্টেইনার নিখোঁজ হয়েছে বলে অভিযোগ করেনি। আমরা সবাই জানি, খালি কন্টেইনার অবৈধভাবে ডিপোর বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেগুলো বাজারে বিক্রি করা হয়। তবে আমি জানি না কীভাবে এটা হয়।”
তিনি ধারণা করেছেন, ১৮টি বেসরকারি ডিপো মালিকদের মধ্যে কেউ কেউ শিপিং এজেন্টদের সহযোগিতায় এ ধরণের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আহসানুল হক চৌধুরী বলেছেন, খালি কন্টেইনার বিক্রির জন্য আমদানি করা হচ্ছে না।
তিনি বলেছেন, “কিছু মহল অবৈধভাবে সেগুলো বিক্রি করতে পারে।”
কন্টেইনার বিক্রির জন্য শুল্ক নীতি আদেশটি পুরানো বলে অনেকেই হয়তো জানেন না এবং এ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির জন্য কাস্টমসের পুনরায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা উচিত বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
বড় হচ্ছে কন্টেইনার ব্যবসার বাজার
আজমির মেরিন এন্টারপ্রাইজের মালিক জসিম উদ্দিন ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, তার কাছে থাকা সমস্ত কন্টেইনার তিনি শিপিং এজেন্টদের কাছ থেকে কিনেছেন।
তিনি বলেছেন, “খালি কন্টেইনারের বিষয়ে কী আইন আছে তা আমি জানি না। আমরা বিভিন্ন শিপিং এজেন্টদের কাছে থেকে খালি কন্টেইনার কিনে থাকি। এই শিপিং এজেন্টরা মূল প্রতিষ্ঠানের (কন্টেইনারের প্রধান মালিক) অনুমতি নিয়ে পণ্য পরিবহনের অনুপযুক্ত কন্টেইনার বিক্রি করে দেয়।”
রাজধানীর ফার্মগেট, কমলাপুর ও চট্টগ্রামের সদরঘাটে তিনটি কন্টেইনার ওয়ার্কশপের মালিক উসমান গনি জোর দিয়ে বলেছেন, ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন হওয়ায় খালি কন্টেইনারের ব্যবসা অবৈধ হতে পারে না।
তিনি দাবি করেছেন, শিপিং এজেন্ট এবং কন্টেইনারের মূল মালিকরা এগুলো বিক্রি করার জন্য বাংলাদেশে আনতে চুক্তি করে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি শিপিং এজেন্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কন্টেইনার বিক্রির ব্যাপারটি স্বীকার করে জানিয়েছেন, অপ্রদর্শিত খরচ মেটাতে তারা কন্টেইনার বিক্রি করেন।
তিনি বলেছেন, এই ধরনের বিক্রি অবৈধ জেনেও অনেক শিপিং এজেন্ট এবং কন্টেইনার ডিপোর মালিক বাজারে কন্টেইনার বিক্রি করতে বাধ্য হন। কারণ, শিপিং এজেন্টদের প্রায়ই জাহাজের ছাড়পত্র পেতে ঘুষ দিতে হয়।
এছাড়াও, আমদানিকারকরা তাদের পণ্য বুঝে না নিলে এসব কন্টেইনার বন্দরে বা ডিপোতে রাখার খরচ তাদের বহন করতে হয় বলে জানিয়েছেন তিনি।
Comments