বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরের সাত দিন

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পথিকৃৎ, জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান। তার দেশে ফেরার মধ্য দিয়েই সত্যিকারের পূর্ণতা পায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ভাষণ দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। সেখানেই তিনি সদ্য স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্র-জাতিকে মৌলিক দিক নির্দেশনা দেন। যেখানে বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক ও ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।

বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে একযোগে রাষ্ট্রের অবকাঠামো ও একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ডাক। সেই মুহূর্তে এমন একটি ব্যবস্থা দরকার ছিলো, যেটি নিশ্চিত করবে কার্যকরভাবে সরকারই দেশের দায়িত্বে থাকবে। বরাবরের মতো এসবের সমাধানে তাৎক্ষণিক উদ্যোগ নেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে একটি বৈঠক হয়। যেখানে সিদ্ধান্ত হয়, দেশে একটি সংসদীয় ব্যবস্থা চালু করা হবে। তিনি একটি অস্থায়ী সাংবিধানিক আদেশ জারি করেছিলেন, যার মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। এছাড়া, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর এবং ১৯৭১ সালের জানুয়ারি ও মার্চে নির্বাচিত সব এমএনএ (জাতীয় পরিষদের সদস্য) ও এমপিএ‘রা (প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য) যদি অযোগ্য বিবেচিত না হয়ে থাকে, তাহলে তারাই বাংলাদেশের প্রথম গণপরিষদ গঠন করবে এবং তারাই দেশের সংবিধান প্রণয়ন করবে বলেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

১২ জানুয়ারি দেশের রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন বঙ্গবন্ধু। এমন পদক্ষেপ নেওয়ার মূল কারণ ছিলো তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি। সেসময় বঙ্গবন্ধুর এমন পদক্ষেপ এবং সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছিলো সময়ের দাবি।

এরপর দরবার হলে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পান বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী। এছাড়া, মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন আরও ১১ জন এবং ওই দিনই তাদের কার্যভার বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

পরের দিন, অর্থাৎ ১৩ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীন দেশে ফেরার পর এটিই তার প্রথম সংবাদ সম্মেলন। সেই সংবাদ সম্মেলনে গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তার ভাবনার কথা বলেছিলেন তিনি। সেখানেই তিনি দ্রুত সংবিধান করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দেন।

ওই দিনই বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকেই ১৯৭২ সালের ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত সব ধরনের কৃষি জমির খাজনা মওকুফের সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে দেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আমার সোনার বাংলা’র প্রথম ১০ লাইন এবং রণসংগীত হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ নির্ধারণ করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের পর আরেকটি বড় উদ্বেগ ছিলো, বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের অধীনস্থ ছোট ছোট সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। এটি নিয়ন্ত্রণেও যথারীতি ভূমিকা পালন করেন বঙ্গবন্ধু। ১৭ জানুয়ারি ঘোষণা দেওয়া হয়, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা এখনও অস্ত্র বহন করছে, তাদের অস্ত্র জমা দিয়ে দিতে হবে (যারা রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র বাহিনীর অংশ হিসেবে ইউনিট গঠন করেছিলেন তারা ছাড়া)।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতির ওপর আক্রমণ শুরু করার পরই ধানমন্ডির বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় তিনি পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগারে বন্দি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাধ্য হয়ে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন ও নয়াদিল্লি হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি স্বাধীন স্বদেশের বুকে ফিরে আসেন।

(তথ্যসূত্র: দৈনিক বাংলা (১১-১৭ জানুয়ারি, ১৯৭২), দ্য বাংলাদেশ অবজারভার (১১-১৭ জানুয়ারি, ১৯৭২) এবং ড. কামাল হোসেনের আত্মজীবনী “Bangladesh: Quest for Freedom and Justice’’)

আরও পড়ুন:

পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

Comments

The Daily Star  | English

Central bank at odds with BPO over Nagad’s future

The discord became apparent after Faiz Ahmed Taiyeb, special assistant to the chief adviser with authority over the Ministry of Posts, Telecommunications and IT, sent a letter to the BB governor on May 12 and posted the letter to his Facebook account recently

1h ago