নির্যাতনে ‘অন্ধ-পঙ্গু’ হয়ে গেছে আঁখি, স্বামী পলাতক শ্বশুর-দেবর গ্রেপ্তার

Ankhi and Hriday
শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতন করায় আঁখি শুকিয়ে কঙ্কালসার হয়ে গেছেন। আঁখির স্বামী হৃদয় ভুঁইয়া (ডানে)। ছবি: সংগৃহীত

দীর্ঘ এক বছর অবরুদ্ধ রেখে প্রেমিক-স্বামী, শ্বশুর ও শাশুড়ি নির্মম ও পাশবিক নির্যাতন করেছে মুন্সীগঞ্জের সুখবাসপুর গ্রামের কলেজ ছাত্রী লাবনী আক্তার আঁখির (১৯) ওপর। এখন তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। অমানবিক নির্যাতনে ‘অন্ধ ও পঙ্গু’ হয়ে কলেজ ছাত্রী আঁখি চিকিৎসাধীন রয়েছেন মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে। হাসপাতালে শুয়ে আঁখি একথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারকে।

২০১৯ সালের ৮ জানুয়ারি তারা প্রেম করে বিয়ে করেন। স্বামী হৃদয় ভুঁইয়া মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার হাতিমারা গ্রামের আমীন ভুঁইয়ার ছেলে। শ্বশুর বাড়িতে আঁখিকে একটি ছোট ঘরে অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থায় জীবন কাটাতে বাধ্য করা হয়। শ্বশুর তাদের বিয়ে মেনে নেননি। এক পর্যায়ে স্বামীও এতে যোগ দেন। প্রায় সময় তাকে মারধর করা হতো। কখনো কখনো শ্বশুর, শাশুড়ি ও দেবর একসঙ্গে নির্যাতন করতো বলে আঁখি অভিযোগ করেছেন।

শ্বশুরের ভয়ে তিনি কখনই দরজা খুলতেন না। স্বামী ধীরে ধীরে তার উপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেন এবং যৌতুক আনার জন্য চাপ দিতে থাকেন। কখনো কখনো সিগারেট জ্বালিয়ে তার শরীরের বিভিন্ন অংশে ছ্যাঁক দেওয়া হতো। তাকে একদিন মারতে মারতে বেহুশ করে ফেলা হয়েছিলো। বাম চোখের উপরে ক্ষত সৃষ্টি হলে সেখানে দশটি সেলাই দেওয়া হয়েছিলো। তাকে একদিন জোর করে ফিনাইল খাইয়ে দেওয়া হয় এবং এতে তার খাদ্যনালী সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। এ ঘটনার পর শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাকে সদর হাসপাতালে আনার পর অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়। সেখানে তার অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকলে তাকে ফেলে শ্বশুর বাড়ির লোকেরা পালিয়ে যায়।

গত সাত-আটদিন দিন ঢাকা মেডিকেলে লাবনী আক্তার আঁখি নিঃসঙ্গভাবে কাটানোর পর পাশের সিটের রোগীর আত্মীয়ের মাধ্যমে আঁখি বাবা ও মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তার বাবা-মা গিয়ে ডাক্তারের পরামর্শক্রমে খাদ্যনালীর অপারেশন করান। এরপর গত ১৮ জানুয়ারি তাকে আবার মুন্সীগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।

আঁখি আক্তার বর্তমানে মুন্সীগঞ্জ সদর হাসপাতালের ৯নং বেডে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। তার দৃষ্টি হারানো দুটি চোখ নীরবে এ অত্যাচারের বিচার চাচ্ছে।

স্বজনরা জানিয়েছেন, এ ঘটনায় আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে। প্রেমিক-স্বামী হৃদয় ভূঁইয়া, শ্বশুর রুহুল আমিন ভূঁইয়া ও শাশুড়ি মাহফুজা বেগম অবরুদ্ধ রেখে ও নির্যাতন করায় আঁখি শুকিয়ে কঙ্কালসার হয়ে গেছেন।

এর আগে, কলেজ ছাত্রী আঁখিকে সুখবাসপুর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসার খবর জেনে রামপাল ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মো. মহিউদ্দিন বিষয়টি ইউপি চেয়ারম্যান বাচ্চু শেখকে জানান। এরপরই ইউপি চেয়ারম্যান বাচ্চু শেখ ও স্থানীয়রা আঁখিদের বাড়িতে যান।

রামপাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাচ্চু শেখের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেছেন, “মেয়েটির বাবা প্রথমদিকে আমাকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। মেয়ের বয়স আঠারো বছর হওয়ার সামাজিক নিষ্পত্তি চেয়ে আইনের আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম। গতকাল আমি মেয়েটির নির্যাতনের করুণ পরিণতির কথা জেনে তাদের বাড়িতে যাই এবং ঘটনা শুনে স্তব্ধ হয়ে পড়ি। আমার জীবনে এমন অমানবিক ঘটনা দ্বিতীয়টি আর শুনিনি।”

জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) খন্দকার আশফাকুজ্জামান জানিয়েছেন, “আদালতের আদেশ এখনও থানায় পৌঁছায়নি। তারপরও স্বামীসহ অন্যান্য অপরাধীদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু হয়েছে।”

সিভিল সার্জন ডা. আবুল কালাম আজাদ দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, “এখন আঁখি চোখে দেখতে পাচ্ছে না। কেন দেখতে পাচ্ছে না তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। অনেক সময় মাথায় আঘাতের কারণে এ রকম হতে পারে অথবা চোখেও কোনো আঘাতের কারণে এটা হয়ে থাকতে পারে। এ বিষয়ে চক্ষু বিশেষজ্ঞর মতামত নিতে হবে।”

“মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে চোখের কোনো ডাক্তার নেই” উল্লেখ করে তিনি আরও বলেছেন, “বাইরে নিয়ে তাকে চোখের ডাক্তার দেখানোর প্রক্রিয়া চলছে। তখন এ বিষয়ে প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাবে। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ সেবা দিচ্ছি। হাসপাতালের সমাজসেবা বিভাগ থেকেও আঁখিকে সহযোগিতা করা হচ্ছে।”

শ্বশুর-দেবর গ্রেপ্তার

মুন্সীগঞ্জের রামপাল কলেজের ছাত্রী লাবনী আক্তার আঁখিকে অবরুদ্ধ রেখে নির্মম নির্যাতনের ঘটনায় শ্বশুর ও দেবরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ আজ সকালে হাতিমারা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে শ্বশুর রুহুল আমিন ভূঁইয়া (৫৫) ও দেবর রিফাত ভূঁইয়াকে (২১) গ্রেপ্তার করেছে। পরে সাত দিন করে রিমান্ডের আবেদন করে বাবা ও ছেলেকে আদালতে পাঠানো হয়েছে।

এর আগে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মুন্সীগঞ্জ সদর থানায় এই সংক্রান্ত মামলা হয়েছে। মামলা নং ৪৮ (০১)২০। যৌতুকের জন্য মারধর করে গুরুতর জখম করার অপরাধে মামলা দায়ের করা হয়। মামলার বাদী হয়েছেন আঁখির বাবা আব্দুর রহিম। এই মামলায় চারজনকে আসামি করা হয়েছে। মুন্সীগঞ্জ সদর থানার ওসি আনিসুর রহমান জানিয়েছেন, এর মধ্যে প্রধান আসামি আঁখির স্বামী হৃদয় ভূঁইয়া (২৪) ও তিন নম্বর আসামি মাহফুজা বেগমকে (৫০) পুলিশ গ্রেপ্তার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। তারা পলাতক।

ওসি বলেছেন, “গত ১৪ জানুয়ারি আঁখির পিতা আব্দুর রহিম বাদী হয়ে মুন্সীগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালে মামলা দায়ের করেন। আদালত মামলাটি এফআইআর হিসেবে গ্রহণ করার আদেশ দেন। কিন্তু আদেশটি থানায় পাঠানো হয়নি। কোনো কারণে তা আটকে রাখা হয়েছিলো। পরে আজ সকালে থানা থেকে একজন পুলিশ কর্মকর্তা গিয়ে হাতে হাতে আদেশটি নিয়ে আসেন। তারপর মামলাটি গ্রহণ করা হয়।”

Comments

The Daily Star  | English
ACC finds Nagad corruption evidence

ACC raids Nagad HQ over hiring controversy

"During the drive, the ACC team found initial evidence of irregularities in the recruitment process"

48m ago