আমরা প্রায় শূন্য থেকেই শুরু করেছিলাম: পরিকল্পনামন্ত্রী
পরিকল্পনা কমিশনে দ্য ডেইলি স্টারের মুখোমুখি হয়েছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। সাক্ষাৎকারের মাঝামাঝি সময়ে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, যে কোনো সময়ের হিসেব করলে দেখা যায়, সরকার অতিরিক্ত সংখ্যক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, এর পেছনে যুক্তি কী?
এক মুহূর্ত সময় নিয়ে তিনি বলেন, “আমরা একটা তাড়ার মধ্যে রয়েছি। অনেকটা সময় আমরা নষ্ট করেছি। আমরা উপনিবেশ ছিলাম। আমাদের নিজেদের কিছুই ছিল না, আমরা প্রায় শূন্য থেকেই শুরু করেছিলাম। আমাদের ১৬ কোটি মানুষ একটা উন্নত জীবনের আশায় লড়াই করছে”।
কিন্তু তিনি স্বীকার করেন, তাড়াহুড়ো করে কিছু করতে গেলে খরচটাও বেশি হয়ে যায়।
তিনি বলেন, “আপনি যখন তাড়াহুড়োর মধ্যে থাকবেন, তখন অপচয়ও বেশি হবে। একটু ভেবে করলে যে ব্যয় হতো, তাড়াহুড়ো করলে তার চেয়ে বেশি হয়। তবে, আমি তাড়ার মধ্যেই কাজ করতে চাই।”
কারণ, দেরি করলে বেশি ক্ষতি হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, “একটি দিন হারিয়ে গেলে আর ফিরে পাওয়া যায় না। আজ যে টাকা হারিয়ে যাচ্ছে, দ্বিগুণ কাজ করে তা ফিরে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু, চলে যাওয়া সময় ফিরে আসবে না”।
দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, “ঠিক মতো কিছু বাস্তবায়ন করা দীর্ঘদিনের সমস্যা। আমরা অন্য জাতির মতো কাজের প্রতি নিবেদিত নই। এখানকার মানুষ কাজ বিমুখ, ছুটি থেকে ফিরে কাজে যোগ দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের খুব একটা উৎসাহ থাকে না”।
“এমনকি তাদের কর্মক্ষেত্রে কাজের সময় নিয়েও অবহেলা রয়েছে। কাজের যে নির্ধারিত সময়সূচি ৯-৫ টা, সেটিও তারা মানছেন না। সকাল ১১টায় অফিসে এসে বিকাল ৩টার মধ্যে চলে যান। এছাড়া কাজ না করার নানা অজুহাত তো রয়েছেই”, বলেন মন্ত্রী।
“জাতি হিসেবেই আমরা আমাদের কাজকে গুরত্ব দেই না। জাপানী, জার্মান কিংবা পশ্চিমা দেশের মানুষের মতো করে আমরা কাজকে গুরুত্ব দিতে শিখিনি। আসলে এটি সংস্কৃতির বিষয়” বলেন তিনি।
“পশ্চিমা দেশ ও জাপানে যেভাবে এসব উপকরণের আধুনিকায়ন করা হয়, আমরা সেটি চিন্তাও করি না। সব সময় এটি আমাদের পরের চিন্তা।”
তারপরেই রয়েছে তহবিলের সমস্যা, বলেন মান্নান। যিনি এর আগের সরকারের সময় অর্থপ্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।
“আমরা আমাদের পরিকল্পনা মতো কখনও তহবিল পাই না। অনেক প্রত্যাশা নিয়ে প্রকল্প শুরু করি। প্রত্যাশা থাকে তহবিল পাওয়ার। কিন্তু, বেশিরভাগ সময়েই সেই প্রত্যাশা পূরণ হয় না। আমি চাইলেই হয়তো সব কিছু পরিকল্পনা করতে পারি, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন”।
জানতে চাওয়া হয়, বাংলাদেশের প্রকল্পগুলো শেষ করতে অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি খরচ হয়, কেন? প্রত্যুৎত্তরে এজন্য জমির দামকে দোষারোপ করেন তিনি।
পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, বাংলাদেশের জমির দাম ভারত ও চীনের চেয়ে বেশি। ফলে প্রকল্প ব্যয়ের এক-তৃতীয়াংশ জমিতেই চলে যায়।
“আর একটি কারণ আমাদের অভ্যাস। অনেক সময় প্রকল্প চলার মাঝপথে বুঝতে পারি, পরিকল্পনার পরিবর্তন করতে হবে। তখন ব্যয় বেড়ে যায়।” বলেন এম এ মান্নান।
এজন্য দুর্নীতি ও অপচয়কেও দায়ী করেন তিনি।
তিনি বলেন, “বিশ্বের সবখানেই কম-বেশি দুর্নীতি হয়। আগে সহনীয় পর্যায়ে ছিল দুর্নীতি, তবে গত কয়েক বছরে আমাদের মূল্যবোধের পরিবর্তন হয়েছে।”
“আগে মানুষ চুরি করলে লজ্জা পেত। কিন্তু এখন তা আর করে না, এখন এটা মনে করা হয় এটিই স্বাভাবিক” বলেন পরিকল্পনামন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার দুর্নীতিতে জিরো-টলারেন্সে বিশ্বাসী বলেও যোগ করেন তিনি।
এজন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশ তদন্ত ব্যুরো (পিবিআই) এবং বিভিন্ন আইনের সংশোধন করা হয়েছে বলেও জানান পরিকল্পনামন্ত্রী।
“তারপরও দুর্নীতি হচ্ছে। ঝুঁকি নেওয়া মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। দেখা যায়, ১০০ জনের মধ্যে কেবল ২-৩ জনের শাস্তি হচ্ছে। তাই মানুষ ভাবে তারাও পার পেয়ে যাবে। এ কারণেই তারা ঝুঁকি নিচ্ছে” বলেন তিনি।
তবে তিনি মনে করেন, আমাদের অর্থনীতির ব্যাপ্তির তুলনায় দুর্নীতি কম। তবে দুর্নীতির সংখ্যা বেড়েছে।
প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে ঘটে যাওয়া কিছু ভিত্তিহীন ব্যয় নিয়ে জানতে চাইলে তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের স্বভাবমতোই তা এড়িয়ে যান।
বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করেই প্রকল্প প্রস্তাব সাজানো হয়েছিল। যা সমস্ত ব্যয়ের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমি যখন এটি যাচাই করতে শুরু করি তারা অস্থির হয়ে ওঠে। তারা আমাকে কোনো সময় দিচ্ছিল না। তাদের সবার সঙ্গে বসার ধৈর্যও আমার ছিল না, তাই এটি অনুমোদন পেয়ে যায়। পরে আমরা সংবাদপত্রে দেখি ১০ হাজার টাকায় একটি বালিশ কেনা হয়েছে।”
এটি ধ্রুপদ সমস্যা আর সব জায়গাতেই এটি ঘটে, দাবি করেন মন্ত্রী।
“ইংল্যান্ডে, পার্লামেন্ট সদস্যরা চাপ দেন। যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেস সদস্যরা তাদের নির্বাচনি এলাকায় অনুদান পেতে ফেডারেল সরকারকে তদবির করেন, এনিয়ে একটি প্রচলিত শব্দই তৈরি হয়েছে, পোর্ক ব্যারেল।”
প্রকৌশলী, ডাক্তার, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, অর্থনীতিবিদদের জ্ঞানার্জনের নামে বিদেশভ্রমণের কারণ নিয়ে তিনি বলেন, “জার্মানির মতো বাংলাদেশে গবেষণার সেইরকম সুবিধা নেই। সমস্যা হয় তখন যখন প্রশিক্ষণ থাকে একজন প্রকোশলীর কিন্তু যান একজন হিসাবরক্ষক”।
“সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা হাজারো কর্মকর্তার হিসাব রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা সবকিছুর হিসাব রাখতে পারি না।” বলেন মন্ত্রী।
তবে ৭০-৮০ শতাংশ সিদ্ধান্তই পক্ষপাতহীণ, বাকিটা হয়তো পক্ষপাতমূলক।
“আমরা সবাই মানুষ। এক বন্ধু হয়তো অন্য বন্ধুর জন্য এগুলো করে। এটা মানুষ হিসেবে আমাদের ব্যর্থতা। আমরা এগুলো থামাতে পারি না।”
অপচয় নিয়েও পরিকল্পনামন্ত্রীর নিজস্ব দর্শন রয়েছে।
তিনি বলেন, “আমার অপচয়ে হয়তো আপনার লাভ হতে পারে। আমি বাংলাদেশের নাগরিক এবং আপনিও বাংলাদেশের নাগরিক। আমাদের সবার কাজ বাংলাদেশের জিডিপিতে যুক্ত হয়। তাই আমি যদি এখানে এক টাকা হারাই। তাহলে, আপনি হয়তো সেখানে এক টাকা লাভ করেন।”
ফলে, মূল ভারসাম্য ঠিক থাকে।
“আমি অন্যায়কে ন্যায়সঙ্গত মনে করছি না। কিন্তু, গাণিতিকভাবে দুটি মিলে যায়।”
প্রকল্প তদারকি করার দায়িত্বে থাকা বাস্তবায়ন, পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগকেও তিনি দোষ দিতে রাজি নন।
“এটি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। এখানে জনবল কম… তাই তাদের পক্ষে একসঙ্গে তদারকি ও পর্যবেক্ষণ করা প্রায় অসম্ভব।”
এছাড়া তাদের ওপর আরোপিত এসব কাজের জন্য প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়নি। সুতরাং, তারা একটি দল হিসেবে প্রকল্প দেখতে যান এবং শুধুমাত্র উপরিভাগের কাজটাই দেখার সুযোগ পান।
তিনি বলেন, “তারা এর বেশি গভীরে যেতে পারেন না।”
তিনি আরও জানান, পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে তার দুটি লক্ষ্যের একটি হলো পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) কে শক্তিশালী করা।
মন্ত্রী এ বছরের মধ্যে ৮টি বিভাগে আইএমইডি অফিস স্থাপনের পরিকল্পনা করেছেন এবং ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী এতে নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছেন।
“আমি যদি এখানে টিকে থাকি কিংবা সরকার যদি সময় পায়। তাহলে, আমরা জেলা পর্যায়ে পৌঁছাতে পারব এবং সেখানে কাজ করতে পারব।” বলেন তিনি।
প্রকল্প পরিচালকদের উদাসীন মনোভাবের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হয় বলেও জানান তিনি।
“তারা পুরো চেইনের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল দিক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সবচেয়ে উঁচু পদে তারা থাকেন তবে সবচেয়ে কম দায়িত্ব নিয়ে। তারা প্রকল্পের মূল কারিগর হলেও দু্ই তিন জনকে দায়িত্ব ভাগ করে দেন। মাঝে মাঝে ফোন করে কাজের খবর নেন।”
তবে, পদ্মা সেতুর মতো সব মেগা প্রকল্প সময়সাশ্রয়ী হয়েছে বলে জানান তিনি।
পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে এম এ মান্নানের আরেকটি লক্ষ্য হলো বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে আরও শক্তিশালী করা।
তিনি বলেন, “আমি এর বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে কাজ করছি।” পরিসংখ্যান সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ ও গবেষণা বিষয়ে একটি ইনস্টিটিউট স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান মন্ত্রী।
নীতিগতভাবে অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনাটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে।
“মানুষ এর ওপর আস্থা রাখতে পারবে। পরিসংখ্যানের ওপর নির্ভর করেই আমরা আমাদের পরিকল্পনা সাজাই। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আমাদের পরিসংখ্যান ব্যবহার করে, যা তারা আগে করত না।”
তিনি আরও জানান, এই পর্যায়ে বাংলাদেশের জন্য তহবিল কোনও সমস্যা নয়।
“সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার জন্য প্রতিদিন আমার অফিসে মানুষ আসে। কারণ, তাদের অন্যত্র অর্থ ব্যয় করার জায়গা নেই। তারা আমানতের জন্য কোন লাভও পায় না। যেমন-ইংল্যান্ডে আপনি কোনও সুদ পাবেন না। বরং সার্ভিস চার্জ হিসেবে তারা তা কেটে নেয়।”
তবে নিজের অর্থ ব্যয় করাই সবচেয়ে ভালো বলে মনে করেন পরিকল্পনামন্ত্রী।
“তথাকথিত সহায়তা নেয়ার চেয়ে আমি নিজের অর্থ ব্যয় করতে পছন্দ করি। তাদের অনেক শর্ত থাকে, যা আমাদের জন্য ব্যয়বহুল। সুতরাং, আমার ইচ্ছা মতো অর্থ ব্যয় করার স্বাধীনতা থাকলে ১ শতাংশ সুদের চেয়ে ৪ শতাংশই ভালো।”
পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে তিনি আশা করেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন আরো উন্নত, অপচয় হ্রাস এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করে যাবেন। যাতে করে বাংলাদেশে যে অবান্ধব ব্যবসা পরিবেশ রয়েছে সেটি দূর হবে।
“কিন্তু, সবচেয়ে বড় কথা- যে প্রকল্পগুলি আমার মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে সেগুলো যেন তৃণমূলে এবং সমাজের দরিদ্র অংশ তাতে সরাসরি উপকৃত হয়।”
Comments