রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আইসিজের অন্তর্বর্তী আদেশ : এখান থেকে কোথায় যাব?
আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) গত ২৩ জানুয়ারি নেদারল্যান্ডের দ্য হেগে মিয়ানমারের প্রতি রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় জন্য জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অন্তর্বর্তী আদেশ দিয়েছেন। এই অন্তর্বর্তী আদেশ অনেক দিক থেকেই ঐতিহাসিক এবং মিয়ানমারের নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য আশার ঝলক। তবে, প্রশ্নটি হচ্ছে আমরা এখান থেকে কোথায় যাব?
সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, আইসিজে মিয়ানমার সরকারকে চারটি অস্থায়ী ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। এর মধ্যে আছে সরকারকে গণহত্যা প্রতিরোধ, সামরিক ও পুলিশ বাহিনী যাতে গণহত্যা না করে তা নিশ্চিত করা, গণহত্যা সংক্রান্ত প্রমাণাদি সংরক্ষণ এবং চার মাসের মধ্যে এসব আদেশ পালন করা হচ্ছে সে বিষয়ে প্রতিবেদন দেওয়া। এই প্রতিবেদন প্রতি ছয় মাস পর পর দিয়ে যেতে হবে। গাম্বিয়া ২০১৯ সালের নভেম্বরে মামলা দায়ের করলে এর শুনানির ওপর ভিত্তি করে আইসিজে-র আদেশটি বিভিন্ন কারণেই তাৎপর্যপূর্ণ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ কারণ এতে সম্প্রদায় হিসেবে রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই প্রথমবারের মতো কোনও আন্তর্জাতিক আইনি সংস্থা তাদের ‘রোহিঙ্গা’ হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। এর আগে মিয়ানমারের শাসকরা তাদের বাঙালি এবং অন্য অনেক দেশ তাদের ‘বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক’ হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের পরিচয়ের এই ঘটনা ঘটেছে এমন এক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যার সংগে মিয়ানমার সরকার সম্পূর্ণরূপে সম্পৃক্ত ছিলো। তাদেরকে রোহিঙ্গা হিসাবে উল্লেখ করা এবং গণহত্যা কনভেনশনের অধীনে তাদের অবস্থানের কথা উল্লেখ করার বিষয়টি আইসিজেতে চলমান মামলার বাইরেও বিশেষ প্রভাব ফেলবে।
লক্ষণীয় ব্যাপার হলো এই আদেশটি সর্বসম্মত । সতেরো জন বিচারকের প্যানেল সর্বসম্মতভাবে এই অন্তর্বর্তী আদেশ দিয়েছে। এর অর্থ দাড়ায় মিয়ানমার যাকে তাদের পক্ষ থেকে বিচারক প্যানেলে মনোনয়ন দিয়েছে তিনিও মিয়ানমারের বিপক্ষেই ভোট দিয়েছেন। অন্তর্বর্তীকালীন এই আদেশের মধ্য দিয়ে আইসিজে দ্বিতীয়বারের মতো কোনও দেশের বিরুদ্ধে এই জাতীয় আদেশ জারি করলো। আইসিজে এর আগে ১৯৯৩ সালের এপ্রিল এবং সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন যুগোস্লাভিয়া বিরুদ্ধে দুটি ‘অস্থায়ী প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা’ জারি করেন। আইসিজে যুগোস্লাভিয়াকে আদেশ দিয়েছিলো, “গণহত্যার অপরাধ রোধে তার ক্ষমতায় থাকা সব কিছু করার এবং সামরিক বা আধাসামরিক বাহিনী যাতে তাদের পরিচালনা বা সমর্থনে গণহত্যা না করে তা নিশ্চিত করার।” যুগোস্লাভিয়া এই আদেশগুলোকে অগ্রাহ্য করেছিলো। বসনিয়ান মুসলমানদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা অব্যাহত ছিলো এবং ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে স্রেব্রেনিৎসাতে গণহত্যার ঘটনা ঘটে। এই দুটি ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হলো যুগোস্লাভিয়া আইসিজের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং মিয়ানমার আদালতের কার্যক্রমে পুরোপুরি অংশ নিয়েছে। মিয়ানমার নিজেকে রক্ষার জন্য তার সবচেয়ে বিখ্যাত প্রতিনিধিকে সেখানে পাঠিয়েছে। অং সান সুচি একসময় মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতেন। অথচ তিনি এমন একটি দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যার দায়িত্ব ছিলো আদালত এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বোঝানো যে মিয়ানমার শুধু নিরাপত্তাজনিত কারণেই এমন পদক্ষেপ নিয়েছিলো। তার এই প্রচেষ্টা কেবল ব্যর্থই হয়নি, মিয়ানমারের উপস্থিতি এই প্রক্রিয়াকে বৈধতা দিয়েছে।
বিচারকরা সর্বসম্মতভাবে গাম্বিয়ার মামলা করার এখতিয়ারের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের যুক্তিও বাতিল করে দিয়েছে। এই প্রথম সরাসরি সম্পৃক্ততা ছাড়াই কোনো দেশ আইসিজের কাছে একটি মামলা নিয়ে এসেছে। আদালত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, গণহত্যা কনভেনশনের বরখেলাফের কারণে গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিপক্ষে এই মামলা আনতে পারে। এই হিসেবে, আদালত ভবিষ্যতের জন্য নজির স্থাপন করেছে। আমাদের অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যে আদালত ঘোষণা করেছে ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশন লঙ্ঘনের প্রিমা ফেসি (দৃশ্যত প্রমাণ) আছে । এতে করে মিয়ানমারে গণহত্যা চালানোর বিরুদ্ধে মামলাটির গুরুত্ব বেড়েছে। যদিও অস্থায়ী পদক্ষেপগুলো মিয়ানমারে গণহত্যা হয়েছিলো কিনা সে বিষয়ে অন্তর্বর্তী আদেশ না। এটি গণহত্যা কি না তা নির্ধারিত হবে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।
২৩ জানুয়ারি থেকে গণমাধ্যমে যে প্রশ্নটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে তা হলো, এই অন্তর্বর্তীকালীন বিধানগুলোর কী প্রভাব ফেলবে? এটি সকলেই জানেন যে, আইসিজের রায় আইনত প্রতিটি দেশের জন্য মেনে চলা বাধ্যতামূলক। কিন্তু, আইসিজের এমন কোনো ব্যবস্থা নেই যার মাধ্যমে রায়ের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারে। যার ফলে, এই নির্দেশগুলো রোহিঙ্গাদের ওপর তাৎক্ষণিক কোনো প্রভাব ফেলবে না। তবে মিয়ানমার এই প্রক্রিয়াটিতে পুরোপুরি অংশ নিয়েছে বলে তাদের এই নির্দেশাবলী মেনে চলতে হবে। কারণ, এই অন্তর্বর্তী আদেশ আইসিজেতে চলমান প্রক্রিয়ার শেষ নয়, বরং শুরু। গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলার শুনানি এখনও হয়নি। এই মামলার মেরিট (বা গ্রহণযোগ্যতা) এখনও নির্ধারিত হয়নি। ২০০৭ সালে আইসিজের একটি রায়ে সার্বিয়াকে গণহত্যার ঘটনা রোধ করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য এবং আদালতের নির্দেশিত অস্থায়ী ব্যবস্থাগুলো মেনে চলার বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘনের জন্য দায়ী করা হয়েছিলো। মিয়ানমার আদালতের আদেশ অগ্রাহ্য করার সম্ভাবনা কম, যদিও তারা এই রায়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
অতীতে মিয়ানমার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বোকা বানানোর চেষ্টা করেছিলো। যা সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত মূল বিষয়গুলো সমাধান করার পরিবর্তে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছিলো। মিয়ানমার জোর দিয়ে আসছে যে তারা রাখাইন রাজ্যে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে হওয়া সামরিক বাহিনীর ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’-এ যারা অপরাধ করেছে তাদের শাস্তি দিচ্ছে। আইসিজেতে মিয়ানমারে মৌখিক উপস্থাপনা চলাকালীন সময়ে তাদের প্রতিনিধি স্বীকার করেছেন যে “রাখাইন রাজ্যে মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘিত হয়ে থাকতে পারে।” ২৩ জানুয়ারি আইসিজে অন্তর্বর্তী আদেশ ঘোষণার আগেই মিয়ানমারের তথাকথিত স্বাধীন তদন্ত কমিশন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলো। যাতে বলা হয়েছে, “তদন্ত কমিশন এমন কোনও প্রমাণ খুঁজে পায় নি যে এই হত্যাকাণ্ড বা উচ্ছেদের ঘটনা উত্তর রাখাইনের মুসলিম বা অন্য কোনো সম্প্রদায়কে ধ্বংস করার জন্য করা হয়েছিলো।” অং সান সু চি ২৩ জানুয়ারি ফিনান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে এই প্রতিবেদনের উল্লেখ করে স্বীকার করেছেন যে, যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে। তবে তিনি এর বিচারের জন্য সময় চেয়েছেন -- “যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য মিয়ানমারকে সময় দিন।” স্পষ্টতই, এটিই হবে মিয়ানমারের পরবর্তী কৌশল।
অস্থায়ী ব্যবস্থা সম্পর্কে আইসিজের আদেশ রোহিঙ্গাদের এবং মানবতার জন্য একটি নৈতিক বিজয়। রোহিঙ্গাদের ন্যায়বিচারের লড়াইয়ে যুক্ত থাকা বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার কর্মীরা এই অন্তর্বর্তী আদেশকে স্বাগত জানিয়েছেন। এই ঘোষণার পরে বাংলাদেশের শিবিরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উদযাপনের কারণ বোঝাই যায়। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিষ্ক্রিয় থাকলেও আইসিজের অন্তর্বর্তী আদেশটি একটি ইতিবাচক দিক। তবে এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে যে অস্থায়ী ব্যবস্থাগুলো বাংলাদেশে আটকা পড়া দশ লাখ শরণার্থীর দুর্দশা লাঘব করার লক্ষ্যে দেয়া না। এই নির্দেশাবলী মিয়ানমারকে অবিলম্বে শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করবে না।
আদালত উল্লেখ করেছে যে, “বাংলাদেশে উপস্থিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে মিয়ানমারের পদক্ষেপগুলো পর্যাপ্ত না।” এই যুক্তি অনুযায়ী মিয়ানমারে বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নতি হলো পরিকল্পিত প্রত্যাবাসনের পূর্বশর্ত। আইসিজে অন্তর্বর্তী আদেশকে উদ্বাস্তু সঙ্কটের সমাধান হিসাবে বিবেচনা করা উচিত না। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মর্যাদা নিয়ে দেশে ফিরে যাওয়ার প্রত্যাশা এখনও অর্জিত হয়নি।
মিয়ানমারের পদক্ষেপের অপ্রতুলতার বিষয়ে এই রায়টি আবার মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের দ্বিপাক্ষিক ব্যবস্থার অকার্যকারিতা প্রমাণ করেছে। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা ছাড়াই এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ সরকারকে বুঝতে হবে যে আইসিজে অন্তর্বর্তী আদেশটি আন্তর্জাতিক ফোরামে এই বিষয় নিয়ে একটি শক্তিশালী কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানোর সুযোগ তৈরি করেছে। এই সংকটের সময়ে বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়াতে ব্যর্থ দেশগুলোর দ্বারা প্রভাবিত হওয়াও উচিত না। বাংলাদেশের উচিৎ ভারত ও চীনের মতো ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাষ্ট্রদের ওপরে যে প্রভাব আছে তা ব্যবহার করা। এই ধরনের প্রচেষ্টা না কারার কারণে ইতিমধ্যেই অনেক মূল্য দিতে হয়েছে।
বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত, জাপান এবং আসিয়ান সদস্যদের পররাষ্ট্রনীতি পুনর্বিবেচনা করা উচিৎ। তাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে তাদের পররাষ্ট্রনীতিগুলো মিয়ানমারে একটি গণহত্যায় অবদান রেখেছে এবং রাখছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একদিকে মিয়ানমারের গণহত্যার অবস্থান থেকে অন্য দিকে দৃষ্টি সরানো এবং প্রমাণ নষ্ট করা যেমন ঠেকাতে হবে, অন্যদিকে শরণার্থীদের নিরাপদে প্রত্যাবর্তন নিয়েও সক্রিয় হতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ে একটি নৈতিক বিজয় প্রয়োজন। কিন্তু শুধু নৈতিক বিজয়ই পর্যাপ্ত না। নৈতিক বিজয় কঠিন পথে চলার একটি ছোট পদক্ষেপ। সামনের যাত্রা অনেক দীর্ঘ এবং কঠিন। আইসিজের অন্তর্বর্তী আদেশে বাংলাদেশ বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সন্তুষ্ট হওয়া উচিত না। এই ধরণের সন্তুষ্টি মিয়ানমারকে সহায়তা করবে এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুর্ভোগ দীর্ঘায়িত করবে।
আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিসটিংগুইশড অধ্যাপক।
Comments