কক্সবাজারের বাকখালী নদী

‘নদী দখলকারী’ যখন নদী সংরক্ষণ কমিটির সদস্য

কক্সবাজারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাকখালী নদীর পাড় দখল করে স্থানীয় এক প্রভাবশালীর নির্দেশে নির্মাণ করা হয়েছে বেশকিছু স্থাপনা। তার নির্দেশনাতেই নদীতে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণ আবর্জনা ফেলা হচ্ছে।
grabbed_by_gurdian
ময়লা ফেলে নদী দখল করে বানানো হয়েছে ছোট ছোট ঘর। ছবি: স্টার

কক্সবাজারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাকখালী নদীর পাড় দখল করে স্থানীয় এক প্রভাবশালীর নির্দেশে নির্মাণ করা হয়েছে বেশকিছু স্থাপনা। তার নির্দেশনাতেই নদীতে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণ আবর্জনা ফেলা হচ্ছে।

যার নির্দেশনায় নদীর এমন ক্ষতি হচ্ছে, তিনিই আবার জেলা প্রশাসন কর্তৃক গঠিত নদী সংরক্ষণ কমিটির সদস্য।

যার ব্যাপারে এতক্ষণ বলা হচ্ছিলো, তিনি কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান। তার রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেই ২০১৭ সালে তাকে নদী সংরক্ষণ কমিটিতে রাখে জেলা প্রশাসন।

২০১৪ সালে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ৫২ জন দখলকারীর একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল। সেখানে মুজিবুরের নামও ছিল। কক্সবাজার শহরের কস্তুরিঘাট এলাকায় একটি নদী বন্দর তৈরি করতে চেয়েছিল বিআইডব্লিউটিএ। দখলদারদের কারণে তা করতে পারেনি। এরপর বিআইডব্লিউটিএ নদী দখলকারীদের একটি তালিকা প্রকাশ করে।

বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দখলদারদের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দখল হওয়া নদী উদ্ধার করতে পারেনি।

২০১৪ সালে কক্সবাজারের ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন মুজিবুর। ২০১৮ সালে তিনি মেয়র হন।

গত ১০ বছরে নতুন বাহারছড়া এলাকায় বাকখালী নদীর পাড় দখল করে বেশকিছু ছোট ঘর ও একটি ওয়্যারহাউস নির্মাণ করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এ নেতা। বিআইডব্লিউটিএ ও পৌরসভার কর্মকর্তা এবং স্থানীয়রা জানান, ছোট ঘরগুলো ও ওয়্যারহাউসটি ভাড়া দিয়েছেন মুজিবুর।

গত মাসে নতুন বাহারছড়া এলাকায় যান দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিনিধি। তিনি দেখেন বাকখালী নদীর কিছু অংশ মাটি দিয়ে ভরাট করে ফেলা হয়েছে। সেই ভরাট অংশে ১০টি ছোট ঘর তৈরি করা হয়েছে, বাঁশ স্তুপ করে রাখা হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, এ বাঁশগুলো বিক্রির জন্য অন্য এলাকা থেকে নৌকায় করে আনা হয়েছে। এ ব্যবসার মূলেও রয়েছেন মুজিবুর।

সেখানে অবৈধভাবে নির্মিত একটি ভবনের পাশেই নদীর সীমানা নির্ধারণের একটি পিলার আছে।

গত মাসে কস্তুরিঘাটস্থ ও বিআইডব্লিউটিএ’র বাংলো সংলগ্ন বাকখালী নদীতে একাধিকবার যান আমাদের প্রতিনিধি। সেসময় তিনি দেখেন, ট্রাকে করে নদীতে আবর্জনা ফেলা হচ্ছে।

এ বিষয়ে কক্সবাজার পৌরসভার সুপারভাইজার সরকার আলীকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, “আবর্জনাগুলো শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিদিন অন্তত ১০০ ট্রাক আবর্জনা এ নদীতে ফেলা হচ্ছে।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পৌরসভার একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মেয়রের নির্দেশনাতেই এখানে ময়লা ফেলা হচ্ছে।

আবর্জনা ফেলার কারণে অনেকটাই সংকুচিত হয়ে গেছে বাকখালী নদী। এ সুযোগে নদীর পাড়ে টিনের ছাদযুক্ত কিছু ভবন তৈরি করা হয়েছে।

নুনিয়াছড়ি ও বাংলাবাজারের মধ্যবর্তী প্রায় ৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নদী দখল করা হয়েছে। আমাদের প্রতিবেদক সেখানে অন্তত ৫০০ অবৈধ স্থাপনা দেখেছেন।

৭০ কিলোমিটার ব্যাপ্তির বাকখালী নদীটি বান্দরবানের পাহাড় থেকে উদ্ভূত হয়ে রামু ও মহেশখালী হয়ে কক্সবাজারের বঙ্গোপসাগরে পড়েছে।

জেলা প্রশাসকের তালিকা

২০১৪ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) করা রিটের ভিত্তিতে নদী দখলদারদের তালিকা প্রকাশ করতে কক্সবাজার প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। একইভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জরিপ করে দখল হওয়া ভূমি পুনরুদ্ধার করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়।

এছাড়া, দূষণ বন্ধে ব্যবস্থা নিতেও যথাযথ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

২০১৫ সালে ৯২ নদী দখলদারের একটি তালিকা প্রকাশ করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। ২০১৪ সালের তালিকায় নাম থাকলেও ২০১৫ সালের তালিকায় মুজিবুরের নাম ছিল না।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক (ডিসি) কামাল হোসেন জানিয়েছেন, সমীক্ষা চলাকালীন নদী দখলের সঙ্গে মুজিবুরের কোনো সংশ্লিষ্টতা পাননি কর্মকর্তারা।

নদী সংরক্ষণ কমিটিতে মুজিবুরের অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে ডিসি বলেন, মেয়র হওয়ার কারণেই তাকে এ কমিটিতে রাখা হয়েছে। এছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তিগত পছন্দ বা কারণ ছিল না।

তবে তাকে কমিটিতে রাখায় অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে অভিযানে কোনো প্রভাব পড়বে না বলেও জানিয়েছেন ডিসি।

তিনি বলেছেন, “দখল হওয়া অংশ আমাদেরকে সিএস জরিপের ভিত্তিতে পুনরুদ্ধারের নির্দেশ দিয়েছিলেন কোর্ট। যেহেতু কক্সবাজারে কোনো ধরনের সিএস জরিপ করা হয়নি, সেহেতু এ ব্যাপারে আমরা কোর্টের নির্দেশনা চেয়েছি। নির্দেশনা পাওয়া মাত্রই আমরা কাজ শুরু করবো।”

২০১৫ সালে দেওয়া এক আদেশে বাকখালী নদী কিংবা এটির পাড়ে কোনো ধরনের শক্ত বা তরল বর্জ্য ফেলা বন্ধ করতে পৌরসভার মেয়রকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

দূষণ বন্ধে ব্যবস্থা নিতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনকে একাধিকবার নোটিশ দিয়েছে পরিবেশ আইনবিদ সমিতি। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি।

জাতীয় নদী সংরক্ষণ কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেছেন, “এটি অকল্পনীয় যে, নদী সুরক্ষা কমিটিতে মুজিবুরের মতো একজনকে রেখেছে জেলা প্রশাসন।”

তিনি বলেন, “তিনি (মেয়র মুজিবুর) এ কমিটির সদস্য হিসেবে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। এ ধরনের মানুষ কমিটিতে থাকলে কমিটি অকার্যকর হয়ে যাবে। বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখবো এবং জেলা প্রশাসককে বলবো যত দ্রুত সম্ভব তাকে কমিটি থেকে বাদ দিতে।”

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দ্য ডেইলি স্টারকে মেয়র মুজিবুর জানিয়েছেন, ২০১৪ সালে বিআইডব্লিউটিএ’র করা নদী দখলদারদের তালিকায় নিজের নাম থাকার ব্যাপারে অবগত নন তিনি।

তবে, নতুন বাহারছড়া এলাকার বাকখালী নদীর পাড়ের অংশ ভরাট হয়ে গেলে সেখানে নিজের কর্মচারীদের জন্য বরফ কল ও বেশকিছু ছোট ঘর নির্মাণের বিষয়টি স্বীকার করেছেন মুজিবুর।

নদীতে বর্জ্য ফেলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, যে অংশে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে, সেটি কক্সবাজার পৌরসভার কেনা।

তবে নদীতে জোয়ারের সময় সেই স্থানেও (পৌরসভার কেনা!) পানি উঠতে দেখেছেন আমাদের প্রতিনিধি।

মেয়র মুজিবুর বলেছেন, “বর্জ্য ফেলার কোনো স্থান আমাদের নেই। আমরা নতুন জমি কেনার চেষ্টা করছি। নতুন জমি পেলে সেখানেই আমরা বর্জ্য ফেলবো।”

গত বছরের জুলাই মাসে হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন, নদী দখল ও দূষণ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড।

হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে করা একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট এ রায় দিয়েছিলেন।

রিট আবেদনে দ্য ডেইলি স্টারে ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর ‘তুরাগকে মৃত ঘোষণা করার সময় এসছে (Time to declare Turag dead)’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়েছিল হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ। এ প্রতিবেদনের জন্য দ্য ডেইলি স্টারকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন হাইকোর্ট।

Comments

The Daily Star  | English

3 quota protest leaders held for their own safety: home minister

Three quota protest organisers have been taken into custody for their own safety, said Home Minister Asaduzzaman Khan

6m ago