ছাত্রকল্যাণের নামে ছাত্রলীগের তাণ্ডব!
গতকাল (২৭ জানুয়ারি) সকালে প্রায় দুই হাজার ২০০ শিক্ষার্থী তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়ে দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে শুরু করেন।
সদ্য ভর্তি হওয়া এই শিক্ষার্থীদের জন্য এটি ছিল বিশেষ দিন। কারণ এ দিনটিতে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হবে। অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হয়, ক্যাম্পাস ঘুরে দেখে এবং শিক্ষকদের কাছ থেকে কিছু শোনার অভিজ্ঞতাও হয়।
সবকিছু মিলিয়ে এক ধরনের উদ্দীপনা নিয়েই গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু আসার পর পরিস্থিতি দেখে ধাক্কা খান শিক্ষার্থীরা। প্রথমেই তারা দেখেন, তাদের অভ্যর্থনায় তৈরি করা মঞ্চটি ভাঙা। তাদের এ ধাক্কা হতাশায় পরিণত হয় যখন তারা শোনেন, নবীনবরণ অনুষ্ঠানটি বাতিল করা হয়েছে। কারণ আগের রাতে (২৬ জানুয়ারি) এখানে বিক্ষোভ করেছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, মূলত একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিকে কেন্দ্র করে আওয়ামীপন্থী ছাত্র সংগঠনের দুই পক্ষ এ বিক্ষোভ করে। সেসময় তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনে তালা দেয় ও মঞ্চে ভাঙচুর করে। যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
প্রসঙ্গত, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই।
ইব্রাহিম খলিল নামে এক অভিভাবক বলেছেন, “আমি মেয়েকে নিয়ে নাটোর থেকে এসেছি। কারণ মেয়ে অনুষ্ঠানে অংশ নিতে চেয়েছিল। এসে শুনছি, ছাত্রলীগের কর্মীরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেছে। তাই অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে।”
শুধু ইব্রাহিম ও তার মেয়েই নয়, আরও অনেক শিক্ষার্থী তাদের অভিভাবকদের নিয়ে এসেছিলেন নবীনবরণ অনুষ্ঠানে। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তাদের হতাশ হয়েই ফিরে যেতে হয়েছে।
দূর-দূরান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের অনেকে এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেই দোষারোপ করেছেন। কারণ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিভাবে তারা নোটিশ দিতে পারতো, কিংবা সদ্য ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য বিকল্প কোনো ব্যবস্থা করতে পারতো।
রংপুর থেকে এসেছেন অভিভাবক জাহানারা বেগম। তিনি বলেন, “কী হবে তা আমরা জানি না। কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল উদ্ভূত পরিস্থিতি আরও ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা।”
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গত ২৬ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এরপর থেকেই মূলত এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষাকরা জানিয়েছেন, অনেক ছাত্রলীগ নেতাই হয়তো এখানে চাকরি করতে চাচ্ছে। তাই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ায় তারা ক্ষুদ্ধ হয়েছেন।
শিক্ষকদের অভিযোগ, বিগত কয়েক মাস ধরে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের জন্য ছাত্রলীগের নেতারাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্মৃপক্ষকে চাপ দিচ্ছিল। যদিও নিয়োগের জন্য আবেদন করতে যে মানদণ্ড, তারা সেই অনুযায়ী উপযোগী না।
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটি দেখার পরেই ২৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় এ তাণ্ডব চালায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সেসময় তারা বিশ্ববিদ্যালয় ভবনের জানালার কাচ ভাঙে, বিক্ষোভ করে এবং নবীনবরণ অনুষ্ঠানটি বানচাল করে দেয়। এছাড়ও, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনে তালা লাগিয়ে দেয় এবং দুই পক্ষের নেতৃত্বে একাধিক মিছিল বের করে।
তবে ওই দুই পক্ষের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষেই তারা বিক্ষোভ করেছিল। এদের এক পক্ষ জানিয়েছে, তারা ১৩ দফা দাবিতে বিক্ষোভ করছে। অপর পক্ষ জানিয়েছে, তারা বিক্ষোভ করছে ১১ দফা দাবিতে।
তাদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ ও ল্যাব সংকটের তাৎক্ষণিক সমাধান, বিভিন্ন ফি কমানো, পরিবহন সুবিধা ও ছাত্রাবাস বাড়ানো এবং বিএনপি-জামায়াতপন্থী কর্মকর্তাদের বাদ দেওয়া।
দাবি মানা না হলে আরও কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়ার কথাও জানিয়েছে দুই পক্ষই।
শিক্ষকরা বলছেন, এসব দাবিগুলো আসলে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে ছাত্রলীগের কর্মীরা। তারা মূলত ক্যাম্পাসে বিশ্ঙৃখল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে কর্তৃপক্ষকে চাপ দিচ্ছে। যাতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটি পুনরায় প্রকাশ করা হয়।
ছাত্রলীগের ওই দুই পক্ষের নেতা রনি ও রুবেলের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জানিয়েছেন, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের উন্নয়নেই তারা বিক্ষোভ করছেন।
তবে যদি শিক্ষার্থীদের কল্যাণেই তারা বিক্ষোভ করছেন, তাহলে সদ্য ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের অনুষ্ঠান বানচাল কেন করা হয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তারা জানিয়েছেন, অনুষ্ঠান বানচালের সঙ্গে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ফজলুল হক বলেছেন, “ছাত্রলীগের বিক্ষোভের পর থেকেই ক্যাম্পাসে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যে কারণে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে নবীনবরণ অনুষ্ঠান বাতিল করা ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প ছিল না।”
তিনি জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য ভর্তি হওয়া সব শিক্ষার্থীদের একসঙ্গে নিয়ে নবীনবরণ অনুষ্ঠান আর করা হবে না। তবে যত দ্রুত সম্ভব প্রত্যেক বিভাগ আলাদাভাবে নতুন শিক্ষার্থীদের জন্য অনুষ্ঠান আয়োজন করবে। কবে, কখন অনুষ্ঠান হবে, সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দেওয়া হবে।
তবে, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে কিছু বলেননি রেজিস্ট্রার।
ছাত্রলীগের দাবির বিষয়ে তিনি জানান, এ বিষয়ে শিগগিরই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বৈঠক করবে।
এ বিষয়ে কথা বলতে একাধিকবার চেষ্টা করেও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবুল কাসেমের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
Comments