ভোটারদের প্রতিক্রিয়া কি গুরুত্ব পায়?
নির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ হওয়ার ৪৮ ঘণ্টা আগে গত ২৮ জানুয়ারি ক্ষমতাসীন দলের ঢাকা দক্ষিণের মেয়র প্রার্থী ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস তার নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছেন। এর একদিন আগে ঢাকা দক্ষিণের বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেন প্রকাশ করেছিলেন তার নির্বাচনী ইশতেহার। তাবিথ আউয়াল (ঢাকা উত্তর, বিএনপি) এবং আতিকুল ইসলাম (ঢাকা উত্তর, আওয়ামী লীগ) একটু এগিয়ে থেকে যথাক্রমে ২৭ ও ২৬ জানুয়ারি তাদের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছিলেন।
তাদের ইশতেহার সম্পর্কে আমাদের দুটি মন্তব্য। প্রথমটি ইশতেহার প্রকাশের সময় নিয়ে এবং দ্বিতীয়টি তাতে লেখা প্রতিশ্রুতি নিয়ে।
প্রথমে, সময় প্রসঙ্গে। ইশতেহার হলো এমন কর্মসূচি যার মাধ্যমে প্রার্থীরা জনগণের কাছে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, নির্দিষ্ট কর্মসূচি এবং কীভাবে সেই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবেন তার বিশদ বিবরণ তুলে ধরেন। নিজ নিজ ইশতেহারের সঙ্গে প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনী এলাকা, মিডিয়া এবং সাধারণ জনগণের সামনে আসেন। ইশতেহারে বর্ণিত পরিকল্পনাগুলোর কার্যকারিতা এবং কীভাবে তারা এগুলো বাস্তবায়ন করবেন তা নিয়ে সবার মুখোমুখি হন। ভোটাররা প্রার্থীদের কর্মসূচি দেখে এবং কর্মসূচির আলোকে তাদের কথা শুনে পছন্দের প্রার্থীকে খুঁজে নিতে পারেন।
প্রশ্ন হলো, এতোকিছু করার সময় কোথায়? প্রার্থীরা কীভাবে প্রত্যাশা করতে পারেন যে এই অল্প সময়ের মধ্যে ভোটাররা তাদের ইশতেহার প্রথমে পড়বেন, তারপরে তা যাচাই করবেন এবং তারপরে তাদের প্রশ্ন তুলে ধরবেন। ইশতেহার এতো দেরিতে প্রকাশ করলে এই অল্প সময়ের মধ্যে ভোটাররা কীভাবে এতোগুলো ধাপ সম্পন্ন করবেন? যার ফলে বেশিরভাগ ভোটারের কাছে ইশতেহার কেবলমাত্র প্রতিশ্রুতিতে ভরা নিছক কিছু কাগজের টুকরো। কেবলমাত্র প্রচারমাধ্যমগুলো প্রার্থীদের ইশতেহার ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ পুরোপুরি করতে পারে। তবে তা করার কোনও সময় দেওয়া হয়নি।
সুতরাং এটা বলাই যায় প্রার্থীরা কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে ইশতেহার উপস্থাপন করেন। আমরা ভোটাররাও এটিকে সেভাবেই গ্রহণ করি। তাদের প্রস্তাবগুলোর কার্যকারিতা সম্পর্কে কোনো বিশ্লেষণ এবং বিতর্ক করারও সুযোগ থাকে না।
নির্বাচনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বা উত্তেজনাপূর্ণ বিষয় হতে পারে ইশতেহার।
প্রার্থী নিজের ইশতেহারের ইতিবাচক বিষয়গুলো ভোটারের সামনে তুলে ধরতে পারেন। বিরোধীদের ইশতেহারের ত্রুটি বা দুর্বলতার কথা বলতে পারেন। একটি প্রতিযোগিতা হতে পারে। এমনকী, ব্যাপকভাবে যা চিন্তা করা হয় সেভাবে নির্বাচন যদি পূর্বনির্ধারিতও হয় তাহলেও এই বিতর্কগুলো আকর্ষণীয় এবং উত্তেজনাপূর্ণ হতে পারে। কারণ, এতে ভোটাররা প্রার্থীদের জ্ঞানের গভীরতা এবং সামর্থ্য সম্পর্কে ধারণা করতে পারতেন।
সব প্রতিযোগীই ব্যাপক প্রচারণা চালান। এমনকী, যার জেতার সম্ভাবনা খুবই কম তিনিও প্রচারণায় পিছিয়ে থাকেন না। সেই প্রচারণার অংশ হিসেবে প্রার্থীরা নিজেদের মধ্যে আকর্ষণীয় বিতর্ক করতে পারতেন, যদি ইশতেহারগুলো সময় মতো প্রকাশ করা হতো।
আন্তর্জাতিক টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর বদৌলতে আমরা বিভিন্ন দেশের প্রার্থীদের নির্বাচনী বিতর্ক দেখতে পাই। সেসব চ্যানেলকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। সেখানে দেখা যায় কতোটা গুরুত্ব সহকারে বিতর্কগুলো দর্শকদের সামনে তুলে ধরা হয়। আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোও এ ধরনের বিতর্ক দেখাতে পারতো, যদি সময় মতো ইশতেহারগুলো প্রকাশিত হতো। ‘টক শো’ এসব বিতর্কের বিকল্প না।
নির্বাচন কমিশন এই ক্ষেত্রে কি কিছুই করতে পারে না?
দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো, চার মেয়র প্রার্থী শেষ মুহূর্তে জনসাধারণকে যে ইশতেহার দিয়েছেন তা আসলে কী?
আতিকুল ইসলাম মশা নিরোধ ও বায়ু দূষণ প্রতিরোধের উপর জোর দিয়ে একটি ইশতেহার দিয়েছেন। তাবিথ আউয়াল ঢাকাকে ‘ইনটেলিজেন্ট সিটি’, আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং কৃষকের বাজার প্রবর্তনের বিষয়ে কথা বলেছেন। ইশরাক হোসেন ঢাকাকে আধুনিক মহানগরীতে পরিণত করার, নারীবান্ধব এবং দুর্নীতিমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ব্যারিস্টার তাপস বলেছেন, তিনি ঢাকা দক্ষিণকে একটি পর্যটন নগরীতে এবং পুরাতন জেলখানাকে একটি বিনোদন পার্কে পরিণত করবেন।সিটি করপোরেশন দুর্নীতিমুক্ত করবেন।
এই প্রতিশ্রুতিগুলোর যেকোনও একটির বাস্তবায়ন প্রতিটি ঢাকাবাসীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের মতো হবে। যাই হোক, মূল প্রশ্নে আসি। এ মেয়র প্রার্থীরা কি জানেন যে একজন মেয়রের ক্ষমতা কতোটুকু? মেয়রের কার্যালয় কতোটা স্বল্প পরিসরে সাজানো থাকে? তাদের এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে সেই ক্ষমতা বা পরিসর যথেষ্ট কী না?
মেয়রের কার্যালয়ের ভূমিকা অনেকাংশে পরিষ্কার না এবং তাদেরকে খুবই কম ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে দেখা যায় মেয়রের কার্যালয়ের মূল কাজটি হলো শহরকে পরিচ্ছন্ন ও আলোকিত রাখা এবং কোরবানির সময় ‘পশুর হাট’ ইজারা দেওয়া। এছাড়াও রিকশার লাইসেন্স এবং জন্ম-মৃত্যুর প্রত্যায়ণপত্র দেওয়ার মতো কিছু কাজও করে। ব্যবহারিকভাবে এগুলো ছাড়া বাকি কাজের জন্য মেয়রকে এমন প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিতে হয় যা তার নিয়ন্ত্রণে নেই।
আমরা সবাই প্রশংসার সঙ্গে স্মরণ করি আমাদের সফল মেয়র আনিসুল হককে। অকাল মৃত্যুর কারণে খুব স্বল্প সময়েও তিনি কিছু কাজ করতে পেরেছেন। আমরা দেখেছি কীভাবে আবর্জনা নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতির উপায় খুঁজতে তিনি দৌড়ে বেড়িয়েছেন। তাকে অনেক মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়েছে। কোথাও আটকে গেলে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করতে হয়েছে এবং ব্যক্তিগতভাবে মিনতি করে কাজ করিয়ে নিতে হয়েছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন।
পরিচালনা করার জন্য সবচেয়ে কঠিন একটি শহর ঢাকা। আধুনিক নগরীর সব ধরনের সমস্যা এখানে আছে এবং তার থেকে বেশিও আছে। সর্বোপরি, ঢাকায় গত দুই দশকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে জনসংখ্যা বেড়েছে যা এধরনের শহরগুলোতে খুব কম দেখা যায়।
এই শহরে সুশাসনের মতো প্রয়োজনীয় আর কিছুই নেই। প্রধানমন্ত্রী শহরটি সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য উত্তর ও দক্ষিণে ভাগ করেছেন। এটি একটি সময়োচিত সিদ্ধান্ত ছিলো। তবে আগাম পরিকল্পনা ছাড়াই তাড়াহুড়ো করে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছিলো।
বর্তমানের বাস্তবতা বিবেচনা করে বলা যায়, কোনো মেয়র নিজে কোনো প্রতিশ্রুতিই বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার দক্ষতার ওপর সবকিছু নির্ভর করবে। প্রধানমন্ত্রীর আশীর্বাদ পেলে অনেককিছুই কার্যকর হবে। সুতরাং তাদের নিজ নিজ ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো আকর্ষণীয় কিছু নয়।
মাহফুজ আনাম, দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক
Comments