নদীদূষণ রোধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই

river_pollution
টঙ্গীর তুরাগ নদ থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করছেন এক নারী। ছবি: পলাশ খান

শহীদ বুদ্ধিজীবী ব্রিজের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক বৃদ্ধ। প্রশ্ন করায় জানালেন তার নাম শফিকুল ইসলাম খোকন। বুড়িগঙ্গার পূর্ব তীরে মাত্র ১০ ফুট দূরে লাল রঙের পাঁচতলা বাড়িটির মালিক তিনি। শফিকুলের বয়স এখন ৬৫ বছর। বসিলা এলাকায় তার জন্ম। বেড়ে উঠেছেন এখানেই।

বুড়িগঙ্গা নদীর তীর পর্যন্ত যাওয়ার আগেই নাকে আসে পচা দুর্গন্ধ— এ কথা বলতেই শফিকুল বলেন, “এক সময় এই নদীর স্বচ্ছ পানিতে রোদের ছটা পড়ে ঝিলিক দিত। আশির দশকে যখন থেকে তরল বর্জ্য আর আবর্জনা নদীতে ফেলা শুরু হলো, চোখের সামনে দেখলাম পানির রঙ বদলে গেল।”

ট্যানারি শিল্প হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তর করায় কোনো পরিবর্তন এসেছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আগের মতোই আছে, কোনো পরিবর্তন হয়নি।”

“প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে দু’তিন মাস কিছুটা উন্নতি দেখা যায়। বাকি সময় পানির রঙ কালো হয়ে যায়, দুর্গন্ধ বের হয়। ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসে অনাবৃষ্টিতে অবস্থা আরও খারাপ হয়।”

উন্নতি নেই বুড়িগঙ্গার

শফিকুলের বাড়ি থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরে জেলে পল্লী। সেখানেই বাস করেন সূর্যবান রাজবংশী। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “৩০ বছর আগেও বুড়িগঙ্গার পাশে দু’টি গ্রামে দেড়শ’ জেলে পরিবারের বাস ছিল। নদী থেকে মাছ হারিয়ে যাওয়ায় তারাও এলাকা ছেড়ে চলে গেছে।”

জেলে পল্লীতেই বাস করেন লক্ষ্মী রাজবংশী। তিনি বলেন, “নদীর পাশে বাস করায় প্রায় সারাবছরই দুর্গন্ধ সহ্য করতে হয়। আমরা পুরোপুরি নদীর ওপর নির্ভরশীল। যে কারণে আমাদের আরও অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়। গোসল করা, কাপড় কাচার কাজেও নদীর পানি ব্যবহার করা যায় না।

বাসিলা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানা এলাকায় এসেও দেখা যায় একই চিত্র। শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে রুপালি আবাসিক এলাকায় বাস করেন আয়েশা আক্তার। তিনি বলেন, “নারায়ণগঞ্জ শহরে যেতে আমাদের প্রায়ই নৌকায় নদী পার হতে হয়। নাকে রুমাল চাপা না দিয়ে নদী পার হওয়া প্রায় অসম্ভব।”

তুরাগ নদের শোচনীয় পরিস্থিতির সাক্ষী হয়ে আছেন গাজীপুরের টঙ্গী এলাকার বাসিন্দারা। হায়দ্রাবাদ মুসুন্দিরবাগ এলাকার সাবেক কমিশনার মাসুদুল হাসান বিল্লাল বলেন, “আমরা কৃষিজমিতে ধান একং অন্যান্য ফসল চাষ করতাম। তুরাগ দূষিত হয়ে যাওয়ায় আমরা আর চাষ করতে পারি না। শিল্প দূষণের কারণে প্রায় এক লাখ একর কৃষিজমি অনাবাদি পড়ে আছে।”

সম্প্রতি ঢাকাকে ঘিরে থাকা বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী পরিদর্শন করে এই সংবাদদাতা পরিবর্তনের কোনো চিত্র দেখতে পাননি। প্রতিটির পানি কুচকুচে কালো এবং দুর্গন্ধযুক্ত। এর প্রভাব পড়ছে মেঘনা নদী এবং শীতলক্ষ্যা নদেও।

নদী রক্ষায় ২০০১ সাল থেকে উচ্চ আদালত সরকারকে একাধিকবার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে বললেও গত এক দশকে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি

উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, ২০১০ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর দেশের প্রধান নদীগুলোর পানির গুণগতমান নিয়ে প্রতিবেদন তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল। ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে তারা। বর্তমানে ২০১৮ সালের প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলছে।

প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ এবং বালু নদীর পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা প্রায় শূন্যের কোটায়। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে অক্সিজেন থাকে না বললেই চলে। মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর জীবন ধারণে প্রতি লিটার পানিতে কমপক্ষে পাঁচ মিলিগ্রাম অক্সিজেন থাকতে হবে।

পানির গুণগতমান উন্নয়নে ২০১৬ সালে সরকার হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সাভারে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেয়। এই উদ্যোগ যে শুধু ব্যর্থ হয়েছে তা নয়, বরং ট্যানারি শিল্পের বর্জ্যে এখন পরিষ্কার ধলেশ্বরী দূষিত হচ্ছে। কেন্দ্রীয় তরল বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) না থাকাই এর জন্য দায়ী।

যদিও দূষণকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে শাস্তির আওতায় এনেছে সরকার। পরিবেশ অধিদপ্তরের ২০১৮-১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার চারপাশে গড়ে ওঠা ২,০৮৭টি দূষণকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১,৬৯১টি প্রতিষ্ঠান ইটিপি স্থাপন করেছে। আরও ১০৪টি প্রতিষ্ঠানের ইটিপি স্থাপন প্রক্রিয়াধীন।

শিল্প দূষণ নিয়ে কাজ করছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষক ড. মহিদুস সামাদ খান। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “যদি সব শিল্প প্রতিষ্ঠান ইটিপি’র মাধ্যমে বর্জ্য পরিশোধন করে নদীতে ফেলে, তাতেও দূষণ বন্ধ হবে না। কারণ, আমাদের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে যে মান নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে যা যথেষ্ট না।”

তিনি আরও বলেন, “জলজ প্রাণীর জীবনধারণে প্রতি লিটার পানিতে কমপক্ষে পাঁচ মিলিগ্রাম অক্সিজেন থাকতে হবে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালায় (১৯৯৭) শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতি লিটার পানিতে ৫০ মিলিগ্রামের বেশি বর্জ্য ফেলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।”

“গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পোশাক কারখানাগুলো ২০২১ সালে ২০,৩০০ কোটি লিটার বর্জ্য নদীতে ফেলবে। ট্যানারি এবং অন্যান্য শিল্পগুলোকে এই গবেষণার অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি”, বলেন ড. মহিদুস সামাদ।

river_pollution1.jpg
ঢাকার বর্জ্য যাচ্ছে বুড়িগঙ্গায়। ছবি: এমরান হোসেন/স্টার

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক একেএম রফিক আহম্মেদ বলেন, “নদীর পানির মানোন্নয়নে হাইকোর্ট বিভাগের দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এটি সময় সাপেক্ষ কাজ। দেখা গেছে, বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো তাদের নদী দূষণমুক্ত করতে প্রচুর পরিশ্রম করেছে। তাদেরও অনেক সময় লেগে গেছে।”

তবে ভিন্ন মত জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “আমি মনে করি, আদালতের নির্দেশনা পাওয়ার পরে প্রধানমন্ত্রী সত্যিই নদী দূষণমুক্ত এবং দখলকারীদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সমস্যা নির্দেশনা বাস্তবায়নে। আমরা সবাই জানি যে, সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে দূষণকারী এবং দখলদারদের যোগসাজশ রয়েছে। যে কারণে নদীর পানির গুণমানে এখনো উন্নতি হয়নি।”

তিনি আরও বলেন, “নদী রক্ষায় সরকার করের অর্থ ব্যয় করেছে এবং ট্যানারি শিল্প হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তর করেছে। কিন্তু দুই বছরে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার করতে পারেনি। তাই নতুন করে একটি নদী দূষিত হচ্ছে।”

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জনস্বার্থে বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের করেছিলেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে নদী রক্ষায় নির্দেশনা দেন আদালত।

কেন্দ্রীয় ইটিপি প্রতিদিন ২৫,০০০ ঘনফুট পানি পরিশোধন করতে সক্ষম। কিন্তু ইটিপি লবণ প্রক্রিয়াজাত করতে পারে না। ট্যানারিগুলোতে লবণের ব্যবহার অপরিহার্য। তাই ইটিপি থেকে লবণাক্ত পানি যাচ্ছে নদীতে। ২০০৯ সালে হাইকোর্ট বিভাগ ঢাকাকে ঘিরে প্রবাহিত চারটি নদীকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা করেন। তখন থেকেই দেশের নদীগুলোকে দখল ও দূষণমুক্ত করতে আদালত সরকারকে প্রায় ১০০টি ভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন।

২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট বিভাগ নদীকে ‘আইনি সত্তা’ ঘোষণা করেন। আদালতের আদেশে জীবিত ব্যক্তির মতো অধিকার দেওয়া হয় নদীকে। জাতীয় নদী সংরক্ষণ কমিশনকে (এনআরসিসি) নদীর অভিভাবক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

নদী দূষণের ধারাবাহিকতা প্রসঙ্গে এনআরসিসির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, “বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে অগ্রগতি করেছে তবে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে পারেনি। ঢাকা এবং অন্যান্য কিছু জায়গায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়া রয়েছে। তবে বেশিরভাগ অঞ্চলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি নেই। দিন শেষে সব বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। নদী দূষণ বন্ধ করতে চাইলে সরকারকে এই বিষয়ে কাজ করতে হবে।”

দূষণের কবলে মেঘনাও

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সম্প্রতি করা এক গবেষণায় বলা হয়েছে, গাজীপুর, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে নদী দূষণ বন্ধ করতে পারেনি সরকার। যে কারণ এই নদীগুলোর পানি প্রবাহিত হয়ে মেঘনা দূষিত হচ্ছে।

বিশনন্দী খালের বেশ কয়েকটি স্থানে ক্রোমিয়ামের উপস্থিতি এত বেশি যে তা পানের অযোগ্য। এটি সম্ভাব্য ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করা উচিত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

ঢাকাবাসীকে মেঘনা নদী থেকে পানি সরবরাহ করতে ওয়াসা দু’টি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। দূষণের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে রাজধানীর ২ কোটির মানুষের ৪০ শতাংশ খাবার পানি সরবরাহ করতে ওয়াসার পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হবে।

সরকার যথাযথভাবে আইন প্রয়োগ না করায় দূষণ বন্ধ হচ্ছে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল।

তিনি বলেন, “পরিবেশ দূষণ করার অনুমতি দেওয়ায় কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে এমন নজির এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। পোশাক কারখানার দূষণ বন্ধ করতে কারখানাগুলোর জন্য আলাদা অঞ্চল গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার। প্রকৃতপক্ষে দূষণ এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, বন্ধ হয়নি।”

Comments

The Daily Star  | English
sirens sound in israel after iran missile attack

Attacking military infrastructure in Western and Central Iran: Israeli military

Trump to decide within two weeks on possible military involvement

20h ago