কর্ণফুলী রক্ষার যত মিথ্যে প্রতিশ্রুতি!

দূষণ ও দখলের মুখে রয়েছে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী কর্ণফুলী। নদী রক্ষায় নানা সময়ে রাজনীতিবিদরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। নির্দেশনা এসেছে আদালত থেকেও। এছাড়াও, এটি দখল ও দূষণমুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছে জাতীয় নদী সংরক্ষণ কমিশন। এসবের জেরে গত বছর কর্ণফুলীকে দূষণ ও দখলমুক্ত করতে একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়।
নির্বিঘ্নে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে কর্ণফুলী নদীতে। এছাড়া, নদীর জমি দখল করে গড়ে তোলা হচ্ছে অবৈধ স্থাপনা। ছবি: রাজিব রায়হান/স্টার

দূষণ ও দখলের মুখে রয়েছে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী কর্ণফুলী। নদী রক্ষায় নানা সময়ে রাজনীতিবিদরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। নির্দেশনা এসেছে আদালত থেকেও। এছাড়াও, এটি দখল ও দূষণমুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছে জাতীয় নদী সংরক্ষণ কমিশন। এসবের জেরে গত বছর কর্ণফুলীকে দূষণ ও দখলমুক্ত করতে একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়।

এখনও বাস্তবায়িত হয়নি ওইসব প্রতিশ্রুতি ও মহাপরিকল্পনা। আর এ সুযোগেই নির্বিঘ্নে নদীতে ফেলা হচ্ছে বর্জ্য এবং দখল করা হচ্ছে নদীর জমি। ফলে দূষণ ও দখল হুমকির মুখেই রয়েছে কর্ণফুলী।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে গঠিক উপকমিটির অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে, দেশের জিডিপিতে (মোট দেশজ উৎপাদন) এ নদীর অবদান ৩৬ শতাংশ। অথচ, এ নদীতেই দৈনিক ২২ হাজার টন শক্ত ও তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। সাধারণত ঘারবাড়ি, কল-কারখানা ও বিভিন্ন হাসপাতালের বর্জ্য সেখানে ফেলা হচ্ছে।

২০১৬ সালে একনেকের (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) এক বৈঠকের পর কর্ণফুলী ও হালদা নদীর জন্য একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করেছে ওই উপকমিটি। যেটির খসড়া ২০১৮ সালে মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত কমিটির কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। সেখানে এই দুই নদী রক্ষায় ৪৫টি প্রাথমিক ও ১৬৬টি পরিপূরক ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এসটিপি)

ওই উপকমিটির সদস্য হিসেবে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম ওয়াসা এবং পরিবেশ অধিদপ্তর। উপকমিটির পাওয়া তথ্যানুসারে, বিভিন্ন ঘরবাড়ি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য ফেলা হয় সাতটি খালে। খালগুলোর সঙ্গে নদীর সংযোগ থাকায় ওইসব বর্জ্য যায় নদীতে।

ওই সাতটি খাল হলো- মহেশ খাল, মুরারি খাল, খন্দকিয়া খাল, চাক্তাই খাল, রুবি গেট খাল, মাইজপাড়া খাল ও রাজাখালী খাল।

কর্ণফুলীর তীরে অবস্থিত শতবর্ষের পুরনো বন্দর নগরী চট্টগ্রামে প্রায় ৭০ লাখ মানুষের বসবাস। তবে দুর্ভাগ্যজনক বিষয়, নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কোনো স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এসটিপি) নেই।

মহাপরিকল্পনায় বলা হয়েছে, নগরে কোনো এসটিপি না থাকায় বর্জ্য ফেলা হচ্ছে খালে। যেসব খালে বর্জ্যগুলো ফেলা হচ্ছে, সেগুলোর সঙ্গে নদীর সংযোগ রয়েছে। ফলে ওইসব বর্জ্য চলে যাচ্ছে নদীতে।

গত ৫ জানুয়ারি চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম ফজলুল্লাহ জানিয়েছেন, নগরীতে এসটিপি’র জন্য মহাপরিকল্পনা করা হয়েছিল, যেটি ২০১৭ সালে অনুমোদনও পেয়েছে। ছয়টি ধাপে এসটিপি স্থাপনের কাজ করা হবে। তাদের আশা, ২০২২ সালের মধ্যেই কাজ সম্পন্ন হবে।

তিনি বলেন, “এসপিটির নকশা প্রস্তুতে আমাদের পরামর্শ দিচ্ছে মালয়েশিয়ার একটি ফার্ম। ২০২০ সালের মার্চের মধ্যেই আমরা এ কাজের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ দেবো এবং কাজ শুরু করবো। এসটিপির কাজ হয়ে গেলেই দূষণের হাত থেকে রক্ষা পাবে কর্ণফুলী।”

নদী দূষণ প্রতিরোধ এবং এটি পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরেরও। তারাও বলছে, এসটিপি না থাকাতেই নদী দূষণ হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, রাঙ্গামাটির চন্দ্রঘোনা থেকে পতেঙ্গাস্থ কর্ণফুলীর মুখ পর্যন্ত প্রায় ১০০ কিলোটিমার স্থানজুড়ে অন্তত ৩০০টি কারখানা কিংবা শিল্প স্থাপনা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে পেপার মিল, তেল শোধনাগার, পাওয়ার প্ল্যান্ট, ট্যানারি, সার প্রস্তুতকারক, সাবান এবং সিমেন্ট তৈরির কারখানাও রয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা যায়, অন্তত ৮৪টি কারখানার বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হয়। এগুলোর মধ্যে ৭৪টি কারখানায় তরল বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) থাকলেও উৎপাদন খরচ কমাতে মালিকরা সেগুলো ব্যবহার করছে না।

অভিযোগ রয়েছে, কর্তৃপক্ষের পর্যাপ্ত নজরদারি না থাকার কারণেই কারখানাগুলো ইটিপি ব্যবহার করছে না। তবে, এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (মেট্রো) আজাদুর রহমান মল্লিক। তিনি জানান, নিয়মিত কারখানাগুলো পরিদর্শন করা হয় এবং কোনো কারখানা থেকে অশোধিত বর্জ্য ফেলা হলে জরিমানাও করা হয়।

তবে তিনি এও জানান, যদি এসটিপি না থাকে, তাহলে শুধু কারখানার দূষণ নিয়ন্ত্রণ করেই কর্ণফুলীকে দূষণমুক্ত করা যাবে না।

মানুষ ও জলজ জীবনের জন্য উদ্বেগ

মহাপরিকল্পনায় বলা হয়েছে, কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী এলাকায় যেসব মানুষ বসবাস করছেন, নদী দূষণের প্রভাব তাদের ওপরেও পড়ছে। এর কারণে বাড়ছে পানিবাহিত রোগ। নদীর তীরের বাসিন্দাদের ঘরবাড়ি স্থানান্তর করতে হচ্ছে। এছাড়া, দূষণের ফলে নদীতে কমছে মাছ। ফলে পেশা পরিবর্তনের দিকে ঝুঁকছেন জেলেরা।

২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে খন্দকিয়া, চাক্তাই ও রাজাখালী খাল সংযোগের তিনটি ভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে দেখেন দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিনিধি। কিন্তু, নদী দূষণ থেকে সৃষ্ট দুর্গন্ধের কারণে সেখানে এক মিনিটও অবস্থান করতে পারেননি তিনি।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের ল্যাবের পরিচালক ডা. নুরুল্লাহ নূরী দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, প্রায়ই তারা নদী এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া খালের পানির গুণগত মান বিশ্লেষন করে থাকেন। নদী ও এসব খালের প্রতি স্তরের পানিই মানুষ এবং জলজ জীবনের জন্য বিপজ্জনক।

তিনি বলেছেন, “গত নভেম্বরেও তারা ল্যাবে পরীক্ষা করেছেন। যেখানে দেখা গেছে, ওই সাতটি খালের প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের (ডিও) পরিমাণ গড়ে ৩ দশমিক ৯৯ মিলিগ্রাম। যেখানে এর আদর্শমান ৫ মিলিগ্রাম। এছাড়া, প্রতি লিটার পানিতে জৈব রাসায়নিক অক্সিজেনের পরিমাণ গড়ে ২৫ মিলিগ্রাম। যেখানে পরিষ্কার পানিতে এর পরিমাণ থাকে ৯ মিলিগ্রাম।”

পরিবেশ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে (২০১২ সাল) দেখা গেছে, কর্ণফুলীতে ১৪০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। যেগুলো মিঠা পানি, মিশ্র পানি ও সামুদ্রিক প্রজাতির। কিন্তু, দূষণের কারণে ৩৫ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এছাড়া, বাকিগুলোও বিপন্ন হয়ে পড়ছে।

বর্জ্য ও দূষিত পদার্থের পাশাপাশি কর্ণফুলী নদীতে প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার জাহাজ চলাচল করে থাকে। এগুলোও নদী দূষণের জন্য দায়ী।

কর্ণফুলীতে চলা ওইসব জাহাজের মাধ্যমে সাধারণত পন্য পরিবহন করা হয়। পুরো ব্যাপারটি নিয়ন্ত্রণ করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবি, তেল যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, সেই বিষয়টি তারা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেন। এছাড়া, তরল ও শক্ত বর্জ্য পরিষ্কার এবং তেল যাতে না ছড়ায়, সেজন্য তারা বিশেষ জাহাজ ব্যবহার করে থাকে।

সবারই কান বন্ধ!

২০১০ সালে হাইকোর্টের এক আদেশের পরে নদী দখলকারীদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। সেই তালিকায় দেখা যায়, কালুরঘাট থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর ৪০ কিলোমিটার এলাকা অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে দুই হাজার ১১২ দখলদার।

শুধু দূষণই নয়, দখলও কর্ণফুলীর নদীর জন্য বড় হুমকি।

নদীর জমি থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে ২০১৬ সাল থেকে বেশ কয়েকবার চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে নিদের্শনা দিয়েছেন আদালত।

তবে, আজ অবধি কেউই আদালতের নির্দেশ সম্পূর্ণরূপে পালন করেনি।

আদালতের নির্দেশনা মানতে আরও সময় চেয়ে যাচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা শুরু করলেও এক সপ্তাহ পরেই সেটি বন্ধ করে দেয় জেলা প্রশাসন। পুনরুদ্ধার করা জমি পরিচালনায় সমস্যার অজুহাতে তারা অভিযান বন্ধ করে দেয়।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন গত ৮ জানুয়ারি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, “এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে বন্দর কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এ কাজে তাদের যদি কোনো ম্যাজিস্ট্রেট ও লোকবল প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে তাদের সহায়তা করবে জেলা প্রশাসন।”

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র ওমর ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে গত ৮ জানুয়ারি তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “বন্দর কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে বেশকিছু অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে। বাকিগুলো উচ্ছেদের প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছে।”

তিনি জানান, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে আবারও তারা অভিযান পরিচালনা করবেন।

অর্থাৎ, আবারও একটি প্রতিশ্রুতি!

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

7h ago