কম ভোট পড়াই কি এখন নতুন ‘স্বাভাবিক বিষয়’ হয়ে যাচ্ছে?

Vote center
ছবি: স্টার ফাইল ফটো

গত কয়েকদিন যাবত আমি বার বার একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি: কেমন হলো ঢাকা সিটি করপোরেশন দুটির নির্বাচন? এর উত্তর খুঁজতে নির্বাচনের পরে সুজন-এর ফেসবুক পেজে আমরা একটি অনলাইন ভোটের ব্যবস্থা করি। এতে চার হাজারেরও বেশি মানুষের সাড়া পড়েছে। যারা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তাদের প্রায় ৯৪ শতাংশই বলেছেন যে নির্বাচনগুলো অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়নি। যদিও অনলাইন ভোট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নয়, এটি জনসাধারণের ধারণার অনেকটা ইঙ্গিত বহন করে।

এছাড়াও, সাম্প্রতিক নির্বাচন সম্পর্কে আমি প্রায় দুই ডজন সাংবাদিককে, যারা আমার প্রতিক্রিয়া জানতে যোগাযোগ করেছেন, তাদেরকে তাদের মতামত জিজ্ঞাসা করেছি। দুর্ভাগ্যক্রমে, তাদের কারোর কাছেই মনে হয়নি যে নির্বাচনগুলো অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে।

১ ফেব্রুয়ারির সিটি নির্বাচনে আমি নিজেও সাতটি কেন্দ্র পরিদর্শন করেছি। এর মধ্যে চারটি ঢাকা উত্তরের এবং বাকি তিনটি ঢাকা দক্ষিণের। এই কেন্দ্রগুলোতে আমি প্রিজাইডিং অফিসার এবং অন্যান্য নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তখন অনেক ভোটারের সঙ্গেও কথা বলেছি। পরিদর্শনকালে আমি অনেককে দেখতে পেয়েছি ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত বা সমর্থিত প্রার্থীদের ব্যাজ পরে কেন্দ্রের ভেতরে এবং বাইরে অবস্থান করছেন, যা ছিলো নির্বাচনী আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তাদের বেশির ভাগই ছিলেন তরুণ এবং তারা একটি শোডাউনের অংশ হিসেবে সেখানে অবস্থান করছিলেন।

তবে আমি কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি পেয়েছি খুব নগণ্য এবং জনসাধারণের মধ্যে নির্বাচনের প্রতি আগ্রহও দেখেছি অতি সামান্য। আমি যে কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করেছি সেখানে বিরোধীদলের মেয়র প্রার্থীদের কোনো এজেন্ট দেখতে পাইনি। কেন্দ্রগুলোতে আমি কোনো ধরনের সহিংসতাও দেখিনি, যা ছিলো নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কয়েকজন নির্বাচনী কর্মকর্তা আমাকে বলেছেন, গত জাতীয় নির্বাচনের মতো তারা চাপও অনুভব করেননি। সামগ্রিকভাবে, সেখানে আমি লক্ষ্য করেছি ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক অনীহা (cynicism) উদাসীনতা (resignation)।

ভোটারদের অনীহা ও উদাসীনতার কারণেই সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে ভোট কম পড়েছে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে, যেখানে আমি গিয়েছি, দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৩৫৯ জনের মধ্যে ৩০ জন (বা ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ) ভোট দিয়েছিলেন। সেগুনবাগিচা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুপুর পর্যন্ত ৩ হাজার ১৯৮ জনের মধ্যে ২৪৪ জন (বা ৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ), বেগম রহিমা আদর্শ বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুপুর ২টা পর্যন্ত ২ হাজার ৩৭৩ জনের মধ্যে ৩৯২ জন (১৬ দশমিক ৫২ শতাংশ), মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের পুরুষ কেন্দ্রে দুপুর ২টা পর্যন্ত ২ হাজার ২৩২ জনের মধ্যে ৪০০ জন (বা ১৭ দশমিক ৯২ শতাংশ) এবং ওখানকার নারী কেন্দ্রে বিকাল ৩টা পর্যন্ত ২ হাজার ৬৯৩ জনের মধ্যে ২৭০ জন (বা ১০ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ) ভোট দিয়েছিলেন। আমার নিজের দেখা এ নগণ্য ভোটের হারের সঙ্গে নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ঢাকা উত্তরের ২৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং ঢাকা দক্ষিণের ২৯ শতাংশের ফলাফল সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

নির্বাচন কমিশন গভীর রাত পর্যন্ত ফলাফল ঘোষণা করতে না পারার কারণেও ঘোষিত ফলাফল নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। ইভিএম থেকে তাত্ক্ষণিকভাবে ফলাফল পাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু, কমিশন গভীর রাত পর্যন্ত সে ফলাফল ঘোষণা করতে পারেনি। ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থী কমিশনের বিরুদ্ধে ফলাফল পাল্টানোর এবং ‘ডিজিটাল কারসাজি’র অভিযোগ তুলেছেন। দৈনিক মানবজমিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী শেখ মোহাম্মদ আলমগীরের জালিয়াতির অভিযোগের কারণে ঢাকা দক্ষিণের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের ফলাফল স্থগিত করা হয়েছে।

দুটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কম ভোট পড়ার জন্য মোটাদাগে চারটি কারণ চিহ্নিত করা যেতে পারে। প্রথমত, ইভিএমের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ। নির্বাচনে ব্যবহৃত ইভিএমগুলোতে পেপার ট্রেইল (ভোটার ভেরিফিকেবল পেপার অডিট ট্রেইল- ভিভিপিএটি) নেই। উল্লেখ্য, অধিক নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিতের স্বার্থে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ২০১১ সালের এক আদেশের কারণে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন তাদের ইভিএেম ভিভিপিএটি সংযুক্ত করেছে। ইভিএম নিয়ে নির্বাচন কমিশনের গঠিত প্রযুক্তিগত উপদেষ্টা কমিটির প্রধান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী পেপার ট্রেইল ছাড়া ইভিএম কেনার সুপারিশে স্বাক্ষর করেননি। নির্বাচন কমিশন তারপরও ভিভিপিএটি ছাড়াই ইভিএম ক্রয় করেছে। পেপার ট্রেইল থাকলে ভোটগুলো পুনরায় গণনা করা যেতে পারে, যার ফলে ফলাফল নিয়ে ওঠা অভিযোগের সহজেই সমাধান হতে পারে।

আমাদের ইভিএমের আরেকটি দুর্বলতা হলো: কিছু কিছু ভোটারের ক্ষেত্রে তাদের আঙ্গুলের ছাপ শনাক্ত করতে না পারা। যেমনটি হয়েছিলো ড. কামাল হোসেন, এমনকী, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ক্ষেত্রেও। এই দুর্বলতার কারণে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ইভিএম ওভাররাইড এবং ভোটারদের পরিচয় আপলোড করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিলো। গত জাতীয় নির্বাচনে ভোটার সংখ্যার ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষেত্রে নির্বাচন কর্মকর্তাদের এই ক্ষমতা দেওয়া ছিলো। সাম্প্রতিক নির্বাচন দুটোতে এই ক্ষমতা দেওয়া ছিলো এক শতাংশ ভোটারের জন্য, যা রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং নির্বাচন কমিশনের দেওয়া একটি বিশেষ কোড দিয়ে বাড়ানো যেতো।

নির্বাচন কর্মকর্তারা যদি তাদের আঙুলের ছাপ না নিয়েই ভোটারদের পরিচয় আপলোড করতে পারতেন, তাহলে তারা ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের অনুপস্থিতিতে ভোটও দিতে পারতেন। নির্বাচনী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এই ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ ইতোমধ্যেই উঠেছে। উল্লেখ্য, ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী ঢাকা উত্তরের ৪৫টি কেন্দ্রে ৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে, যার মধ্যে সর্বোচ্চ হলো ৭৮ দশমিক ২১ শতাংশ।  ঢাকা দক্ষিণের ৫০টি কেন্দ্রে ৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে, যার মধ্যে সর্বোচ্চ হলো ৭৭ দশমিক ৮০ শতাংশ। ভোট পড়ার এসব উচ্চ হার নিয়ে অনেকের মধ্যে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে। প্রসঙ্গত নিউইয়র্ক টাইমসের একটি সাম্প্রতিক প্রবন্ধের শিরোনাম ছিলো- The only safe election is a low-tech election. (February 4, 2020)।

কম ভোট পড়ার দ্বিতীয় কারণ হলো: নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থার অভাব। গত নির্বাচনগুলোতে নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্বমূলক ভূমিকার কারণে অনেক নাগরিক এবারের ভোট বর্জন করেছেন। তাদের অনেকের মনে ধারণা হয়েছে যে, তাদের ভোটের কোনো প্রভাব নির্বাচনে পড়বে না। এছাড়াও, অনেকের মনে আশঙ্কা ছিলো যে ভোটকেন্দ্রে গেলেও তাদের ভোট দিতে দেওয়া হবে না।  তাদের প্রার্থীরা কোনো না কোনোভাবে বিজয়ী হবেনই, এই আত্মবিশ্বাসের কারণে এমনকী অনেক ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরাও ভোট দিতে যাননি।

কম ভোট পড়ার তৃতীয় কারণ, ভোটকেন্দ্রগুলোর আশেপাশে শোডাউন করায় সৃষ্ট নিরাপত্তা-ঝুঁকি। এই নিরাপত্তা-ঝুঁকি অনেক ভোটারকে নিরুৎসাহিত করেছিলো ভোটকেন্দ্রে যেতে। তাদের ভয় ছিলো ভোটকেন্দ্রগুলোর নিয়ন্ত্রণে রাখা ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা তাদের হয়রানি করতে পারে। এমনকী, ভোট দিতে বাধাও দিতে পারে। এই ধরনের ভয় বেশিরভাগ বিরোধীদলের প্রার্থীর সমর্থকদের নিরুৎসাহিত করেছিলো ভোটকেন্দ্রে যেতে।

ভোটের খরার চতুর্থ কারণ — ভোট প্রদানে বাধা। আমি অভিযোগ পেয়েছি, অনেক স্থানে ভোটকেন্দ্রের সামনে প্রকৃত ভোটারদের প্রবেশ বাধাগ্রস্ত করা হয়েছিলো। কোথাও কোথাও ভোট প্রদানে বাধা দিতে শোডাউনকারীরা কৃত্রিম লাইন তৈরি করেছিলো। কিছু ক্ষেত্রে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মী-সমর্থক হিসেবে পরিচিত ভোটারদের কেন্দ্রে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। এই ধরনের হয়রানির সংবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেক ভোটার তা দেখে ভোটকেন্দ্রে যেতে নিরুত্সাহিত হন।

আমি ভোটারদের কাছ থেকে আরও অনেক অভিযোগ পেয়েছি। অনেকের মতে তারা নির্দ্বিধায় তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। ভোটকেন্দ্রে অবাঞ্ছিত ‘সহায়তাকারী’রা ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে ভোট দিতে বাধ্য করছিলো বা তারাই ভোটারদের পক্ষে ভোট দিয়ে দিচ্ছিলো। কিছু ভোটারকে বলা হয়েছিলো, ইভিএমে ভোট দিলে তারা কাকে ভোট দিচ্ছে তা গোপন থাকবে না। তাই তারা কাকে ভোট দিচ্ছে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। বেশ কয়েকজন ভোটার অভিযোগ করেছিলেন, তাদের পরিচয় আপলোড করতে আঙুলের ছাপ দেওয়ার পরই তাদের ভোট দেওয়া হয়ে গেছে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়।

সামগ্রিকভাবে, এটি স্পষ্ট যে সাম্প্রতিক সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো ছিলো ‘নিয়ন্ত্রিত’, যদিও অতীতের তুলনায় নিয়ন্ত্রণের ধরন ছিলো ভিন্ন। নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন এবং কম ভোট পড়া যেনো এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন ‘স্বাভাবিক বিষয়’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বস্তুত, ইভিএম সম্পর্কে ভোটারদের মধ্যে যে উদ্বেগ এবং নির্বাচন কমিশনের প্রতি তাদের মধ্যে যে আস্থাহীনতা ছিলো সাম্প্রতিক নির্বাচনের মাধ্যমে তা কাটিয়ে উঠা সম্ভবপর হয়নি, বরং সেগুলো আরও প্রকট হয়েছে।

এই উদ্বেগ ও আস্থাহীনতা আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থার পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ার ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করছে। তবে নির্বাচনই ক্ষমতা রদবদলের একমাত্র বৈধ এবং শান্তিপূর্ণ পথ। যদি ক্ষমতা হস্তান্তরের শান্তিপূর্ণ পথটি রুদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে আমরা এক অশুভ ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হতে পারি, যার দায় নিতে ক্ষমতাসীনদেরকে এবং মাসুল গুনতে হবে দল-মত নির্বিশেষে সবাইকেই।

ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন - সুশাসনের জন্য নাগরিক

Comments

The Daily Star  | English

Protests, road blockades trigger traffic disruptions in Dhaka

Several parts of the capital have been experiencing severe traffic congestion today due to demonstrations and road blockades by different political parties citing various reason

1h ago