‘প্রথম অভিনয়ের সুযোগ পাই আরেকজনের বিকল্প হিসেবে’
মঞ্চ নাটক দিয়ে অভিনয়জীবন শুরু করেছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেতা শহীদুজ্জামান সেলিম। প্রথমে অভিনয় শুরু করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটারে। ওই সময়েই ঢাকা থিয়েটারে যোগ দিয়ে মঞ্চে নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন। আজও নিয়মিত অভিনয় করছেন ঢাকা থিয়েটারের হয়ে। পাশাপাশি অভিনয় করেছেন টিভি নাটক, সিনেমায়। নিজে নাটকও পরিচালনা করেছেন।
দ্য ডেইলি স্টারের কাছে অভিনেতা হয়ে ওঠার পেছনের গল্প বলেছেন শহীদুজ্জামান সেলিম।
“ছোটবেলা থেকে রেডিও শুনতাম। তখন মধ্যবিত্ত পরিবারে ট্রেডিশন ছিল, রবিবার দুপুরে নাটক শোনা। আবার কলকাতা বেতারকেন্দ্র থেকেও নাটক প্রচার হতো। সেসব নাটকও শুনতাম।
রবিবার দুপুরে ফ্যামিলির সবাই মিলে ভাত খেতে বসে রেডিওর নাটক শুনতাম। অন্যান্য দিন শুনতাম রাতে। বেশ আগ্রহ নিয়ে রেডিওর নাটক শুনতে শুনতে নাটকের প্রতি আমার আগ্রহ বেড়ে যায়।
সেই বয়সেই অনেক নাটকের সংলাপ মুখে মুখে বলতে পারতাম। বিশেষ করে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব- এই সংলাপটি খুব ভালো বলতে পারতাম।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর একদিন আড্ডায় সংলাপটি বলি। তখন থাকতাম মীর মশাররফ হোসেন হলে। রুমে বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিতাম। সেই আড্ডায় হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞাসা করা হলো- নাটক করবো কি না।
অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নাট্য সম্পাদক। তিনি আমাকে চেনেন না তখনো। তিনি একটি নাটকের রিহার্সাল করছিলেন। বন্ধুদের অনুরোধে আমিও একদিন যাই।
যাওয়ার পর দেখতে পাই হুমায়ুন ফরীদি মাথা নিচু করে বসে ‘তুমি পড়, তুমি পড়’- এ কথা বলে আদেশ দিচ্ছেন।
আমার দিকে না তাকিয়েই একইভাবে পড়তে বলেন। আমি পড়তে শুরু করি। সেটা ছিল নাটকের নায়ক চরিত্রের সংলাপ। নাটকের নাম ছিল ‘আবার বাউল আইবো ফিরা’। পড়ার সময় কী পড়লাম জানি না। কিন্ত তাতেই হয়ে গেল।
শিউলি নামে আমাদের একজন সিনিয়র ছিলেন। ইংরেজি বিভাগে পড়তেন। আমি পড়তাম অর্থনীতি বিভাগে। শিউলি ওই নাটকের নায়িকা হলেন। আমি হলাম নায়ক। একটি নাট্য উৎসবে এ নাটকটির মঞ্চায়ন হয়েছিল।
এভাবেই জীবনের প্রথম মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেছিলাম। এভাবেই নাটকের ভেতরে, অভিনয়ের ভেতরে ঢুকে গেলাম।
এরপর আমরা কয়েকজন শিক্ষার্থী মিলে প্রতিষ্ঠা করি জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার। সেটি এখনও আছে।
ওই বছরই ঢাকা থিয়েটারে যোগ দেই। এটা ১৯৮৩ সালের মে মাসের কথা। এক এক করে ঢাকা থিয়েটারে বেশ কয়েকটি নাটকে একজনের বিকল্প হিসেবে অভিনয় করার সুযোগ পাই। মনে পড়ে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেই সময়ে যে কজন শিক্ষার্থী ঢাকা থিয়েটারে যোগ দিয়েছিল, তাদের মধ্যে আমিই প্রথম অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলাম।
ওই সময়ে দিনের পর দিন টিএসসিতে রিহার্সাল করতাম। জাহাঙ্গীরনগর থেকে এসে রিহার্সাল করে আবার হলে ফিরে যেতাম।
একসময় পড়ালেখা শেষ করে ঢাকায় চলে আসি। চাকরিতে যোগ দেই। মাঝে চাকরিতে সময় দেওয়ার কারণে কিছুদিন মঞ্চে নিয়মিত ছিলাম না। বিরতি শেষে আবারও মঞ্চে অভিনয় শুরু করি। ‘কেরামত মঙ্গল’ নাটকটি দিয়ে ফেরা হয়েছিল। সেটারও একটি গল্প আছে।
সেই নাটকটি মঞ্চায়নের কয়েকদিন আগে একজন অভিনেতা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ফলে প্রধান চরিত্রটি করার সুযোগ পেয়ে যাই। সেই থেকে দল আমার প্রতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে। টানা কয়েকবছর কারো না কারো বিকল্প হিসেবে অভিনয় করি।
১৯৮৭ সালে আমার জীবনে বড় সুযোগ আসে। কারো বিকল্প ছাড়াই অভিনয় শুরু করি। অবশ্য এর আগে বছরের পর বছর প্রক্সি দিয়েছি, অন্যের বিকল্প হয়ে অভিনয় করেছি। এজন্য মনে মনে জিদও ছিল। ভাবতাম, এমন একদিন আসবে, যেদিন কারো বিকল্প নয়, নিজের যোগ্যতা দিয়ে ঢাকা থিয়েটারে অভিনয় করবো।
ঢাকা থিয়েটারের ‘হাত হদাই’ নাটকটি করার সময় আমাকে বিটিভিতে অডিশন দিতে বলা হয়েছিল। অডিশন দেওয়ার পর দেখা যায় আমিই সবার মধ্যে প্রথম হয়েছি।
মঞ্চের পাশাপাশি সেই সময়ে বিটিভিতে ‘জোনাকি জ্বলে’ ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই সময়ে এই নাটকটিই আমাকে ব্যাপক পরিচিতি এনে দিয়েছিল। অর্থাৎ অভিনেতা হিসেবে আমার প্রথম পরিচিতি আসে ‘জোনাকি জ্বলে’ নাটকটি দিয়ে।
বুলবুল চৌধুরীর পরিচালনায় একটি ভিডিও ফিল্মে অভিনয় করেছিলাম সেই সময়ে। ট্রেনে করে নরসিংদী যাচ্ছিলাম শুটিং করতে। প্রয়াত খ্যাতিমান অভিনেতা আবুল খায়ের জেনেছিলেন হুমায়ুন ফরীদি অভিনয় করবেন। ট্রেনে বসে পরিচালকের কাছ থেকে শুনতে পান, ফরীদি অফিস থেকে ছুটি পাননি, তাই কাজটি করতে পারছেন না। সেই কাজটি আমি করছি। বলে রাখি, হুমায়ুন ফরীদি তখন আজাদ প্রোডাক্টসে চাকরি করতেন।
আমার কথা শুনে আবুল খায়ের মন খারাপ করে বললেন, ‘নাগরিক চেহারা নিয়ে এই ছেলে করবে শ্রমিকের চরিত্র? পারবে না করতে।’
তার কথায় আমি প্রচণ্ড অপমানবোধ করেছিলাম। আমি চুপ করে ছিলাম। কষ্ট পেয়েছিলাম খুব।
শেষে অভিনয় করার জন্য যখন ক্যামেরার সামনে দাঁড়াই এবং কাজটি ভালোভাবে করি, তখন আবুল খায়ের আমার হাতে ধরে বলে ফেলেন, ‘আমার ভুল হয়ে গেছে। তুমি ভালো অভিনয় করেছ।’
সেই থেকে আবুল খায়েরের সঙ্গে আমার ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল।
অভিনেতা হওয়ার দীর্ঘ পথ চলতে চলতে এইরকম আরও কত ঘটনাই তো আছে আমার জীবনে। এরপরও আমি অভিনেতাই হতে চেয়েছিলাম। এজন্য বিসিএস’ও দেইনি। সরকারি ব্যাংকে চাকরি হয়েছিল। পোস্টিং হয়েছিল ঢাকার বাইরে। শুধুমাত্র অভিনয় করবো বলে চাকরিটি করিনি।
একজীবনে আমি অভিনেতাই হতে চেয়েছি। এটাই করে যেতে চাই।”
Comments