বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের স্বপ্নদ্রষ্টা প্রান্তিক কৃষক আব্দুর রশিদ

লালমনিরহাট জেলা সদর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে কালীগঞ্জ উপজেলার অজো পাড়া গাঁ দক্ষিণ দলগ্রামের প্রান্তিক কৃষক আব্দুর রশিদ। তিনি হয়ে উঠেছেন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের স্বপ্নদ্রষ্টা। এই শিশুদের মাঝে ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি।
আব্দুর রশিদের (৬১) সামান্য কিছু জমি আছে। সেখানে কিছু ফসল ও সবজি চাষ করে চলে তার জীবিকা। চার সন্তানের জনক আব্দুর রশিদের সংসারে আছেন স্ত্রী পারুল বেগম ও দুই মেয়ে। বড় দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে।
ছয় ভাই আর চার বোনের মধ্যে সবার বড় আব্দুর রশিদ দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের প্রতি অবহেলা আব্দুর রশিদের বিবেককে নাড়া দেয়। তাদের জন্য কিছু করার স্বপ্ন দেখেন তিনি। নিজের এক টুকরো জমির ওপর ২০১১ সালে গড়ে তোলেন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য 'কালীগঞ্জ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়'।
গ্রামের মানুষের কাছে বাঁশ, টিন, কাঠ ও রশি সাহায্য নিয়ে নির্মাণ করা হয় স্কুলের ঘর। হাতেগোনা কয়েকজন শিশু নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও এখন এই স্কুলে পড়ালেখা করছে দুই শতাধিক শিশু।
কৃষক আব্দুর রশিদের এই মহৎ কাজের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এগিয়ে এসেছেন গ্রামের বেশ কয়েকজন মানুষ। আব্দুর রশিদের সঙ্গে বিনা পারিশ্রমিকে তারা পড়াচ্ছেন শিশুদের। আদর, ভালোবাসা আর যত্ন দিয়ে শিশুদের আগলে রাখেন তিনি। তার স্কুলে আনন্দ-উল্লাসে সময় কাটায় শিশুরা। অফুরন্ত মমতাবোধ ছড়িয়ে থাকে স্কুলজুড়ে।
স্কুলের এক শিশুর অভিভাবক সেলিনা বেগম (৩২)। ১২ বছর বয়সী কন্যা শিশুকে নিয়ে প্রতিদিন আব্দুর রশিদের স্কুলে আসেন। গত তিন বছর ধরে শিশুটি এই স্কুলে পড়ালেখা করছে। তিনি বলেন, "এখানে আমার মেয়ে হাসিখুশি থাকে। সেই সঙ্গে পড়ালেখাও শিখছে সে। মেয়েকে হাসতে দেখলে আমারও ভালো লাগে।"
"আমার মতো অনেক অভিভাবক দূর-দূরান্ত থেকে তাদের সন্তানদের এখানে নিয়ে আসেন। আমাদের শিশুদের স্বপ্নদ্রষ্টায় পরিণত হয়েছেন কৃষক আব্দুর রশিদ। শিশুদের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও স্বপ্ন দেখছি তাদের উন্নতিতে", বলেন সেলিনা বেগম।
আব্দুর রশিদ জানান, তিনি আমৃত্যু বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য কাজ করবেন। তাদেরকে শিক্ষিত করতে পেরে, শিশুদের আনন্দে রাখতে পেরে তিনিও খুশি।
তিনি বলেন, "এই স্কুলের অনেক শিশু দশম শ্রেণিতে পড়ছে। আমরা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াচ্ছি। শিশুরা যখন পড়ে তখন মনে হয় আমি পড়ছি, তারা যখন হাসে তখন মনে হয় আমি হাসছি।"
তিনি আরও বলেন, "জানি না গ্রামের শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা বিনা পারিশ্রমিকে আর কতদিন সহযোগিতা করবে। তবে আমি হাল ছাড়বো না। এই শিশুদের প্রতিষ্ঠিত করে গড়ে তুলতে যদি শেষ সম্বল টুকুও বিক্রি করতে হয়— করবো।"
বর্তমানে স্কুল পরিচালনা করতে যাবতীয় খরচ নিজেই চালাচ্ছেন আব্দুর রশিদ। মাঝে মাঝে প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনের দ্বারস্থ হন। দিনদিন তার স্কুলের প্রসার বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে খরচও। তবুও নির্ভিক, হতাশাহীন, সংশয়হীন তিনি। নিরলস পথ চলছেন।
লক্ষ্য তার বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের স্বপ্ন দেখানো আর সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়া।
Comments