বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার পক্ষে-বিপক্ষে

. ‘অন্যরা কোনো কিছু চাপিয়ে দিলে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গে যায় না’- সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী . ‘কিছু মানুষ সবসময় নেতিবাচক কথা বলবেই, তার জন্যে পিছু হটার কোনো কারণ নাই’ - কাজী শহীদুল্লাহ . ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা কোনো ট্রায়াল অ্যান্ড এররের বিষয় না’- তানজিম উদ্দিন খান
Sirajul islam, kazi shahidullah, tanzim uddin-1.jpg
ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহ, এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তানজিম উদ্দিন খান। ছবি: সংগৃহীত

. ‘অন্যরা কোনো কিছু চাপিয়ে দিলে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গে যায় না’- সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

. ‘কিছু মানুষ সবসময় নেতিবাচক কথা বলবেই, তার জন্যে পিছু হটার কোনো কারণ নাই’ - কাজী শহীদুল্লাহ

. ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা কোনো ট্রায়াল অ্যান্ড এররের বিষয় না’- তানজিম উদ্দিন খান

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা একসঙ্গে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। গত ২৩ জানুয়ারি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং ইউজিসির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সামনে সময় আছে কয়েক মাস। এতো বড় কর্মযজ্ঞ এতো অল্প সময়ে কমিশন কীভাবে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কোনো কোনো শিক্ষাবিদ। আবার সমর্থনও করছেন অনেকে।

যারা প্রশ্ন তুলছেন তাদের বক্তব্য, ইউজিসির সেই সক্ষমতা নেই যা দিয়ে তারা এতো বড় কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করবে। তাছাড়া এতো বড় একটি উদ্যোগ নেওয়ার আগে কোনো গবেষণা করেনি ইউজিসি। সাধারণ ধারণার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষা নিয়ে এতো বড় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায় না।

যারা ইউজিসির উদ্যোগ সমর্থন করছেন তাদের বক্তব্য, শুরু তো করতে হবে। তারপর সমস্যা হলে সেটা সমাধান করা যাবে। মেডিকেলের সমন্বিত ভর্তি প্রক্রিয়া তো সুষ্ঠুভাবে চলছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এখনও নিশ্চিত করেনি যে তারা ইউজিসির উদ্যোগের সঙ্গে থাকবে কি না।

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহ, ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তানজিম উদ্দিন খান

ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তিনি দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনকে বলেছেন, “এটা নিয়ে আমার ব্যক্তিগত কোনো মতামত নেই। অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”

ঢাবির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনকে বলেছেন, তিনি সমন্বিত ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মাকসুদ কামালের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো নিজামুল হক ভূঁইয়া মুঠোফোন ধরেননি। ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও উত্তর দেননি।

ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, “যে কারণে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার দাবি উঠেছে, তা হলো: যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয় তাদের অনেকগুলো পরীক্ষা দিতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায় একই সময়ে পরীক্ষা হয়। তাদেরকে বিভিন্ন শহরে ছোটাছুটি করতে হয়। এতে তাদের সময় ও অর্থের অপচয় হয়। অভিভাবকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হন। সেদিক বিবেচনায় ‘সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা’ যৌক্তিক।”

“কিন্তু, এর বড় অসুবিধা দুটি। একটি হলো: এটি ম্যানেজ করার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। এটি পরিচালনা করার দক্ষতা আমাদের কোনো প্রতিষ্ঠানের নেই। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল যে খুব রিয়ায়েবল হবে তাও নয়। এ ধরনের রেজাল্টে মানুষের আস্থা থাকে না। একটি বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি হবে।”

“খুব বড় ম্যানেজমেন্ট সমস্যা হবে। এর কোনো ধারণাও পাওয়া যাচ্ছে না। বলা হচ্ছে, রোটেশন করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দায়িত্ব নিবে। ছোট ছোট বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে এই দায়িত্ব নিবে?”

“দ্বিতীয়তটি হচ্ছে: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আদর্শগতভাবে স্বায়ত্তশাসিত হওয়া উচিত। এই স্বায়ত্তশাসনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের একটি হচ্ছে শিক্ষক নিয়োগ। অন্যটি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের বাছাই করে ভর্তি করা। এ ক্ষমতা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হাতে থাকা উচিত। অন্যরা কোনো কিছু চাপিয়ে দিলে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গে যায় না।”

সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ইমপ্যাক্ট নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গবেষণা বা চিন্তা-ভাবনা করেছে।

“না, না। তারা কোনো গবেষণা করেনি। অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এসব সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে হয়। এগুলোর যৌক্তিকতা খোঁজা হয় না। হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে সেগুলো বাস্তবায়ন করা কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।”

সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার পক্ষের শিক্ষকদের একাংশের অভিযোগ— পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে শিক্ষকরা যে টাকা পান তা বন্ধ হয়ে যাবে বলেই অনেক শিক্ষক সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিরোধিতা করছেন।

“এটা ঠিক যে পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে শিক্ষকরা কিছু টাকা পান। তবে আমার মনে হয় না, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিরোধিতার এটা কোনো কারণ।”

“আমি তো ভর্তি পরীক্ষার সঙ্গে জড়িত না। আমি নীতিগতভাবে এর বিরোধিতা করছি। এর বিরোধিতা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এক কথায়— এটি ম্যানেজ করা কঠিন হবে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন ধারণা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”

মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা এক সঙ্গে হচ্ছে। সেটিকে কি উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যেতে পারে? — “মেডিকেলের পরিসরটি ছোট। সেটাকে উদাহরণ হিসেবে নেওয়া ঠিক হবে না।”

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, “সমস্যা তো যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায়ই হতে পারে। এর জন্যে কি কোনো কিছু থেমে থাকে? সমস্যা হলে তার সমাধান বের করতে হবে। সমস্যা আছে মনে করলে তো কেউ কোনো কাজে এগুতে পারবে না। দ্যাট শুড নট স্টপ আস ফ্রম ট্রায়িং টু ডু গুড থিংস। আমরা কোনো প্রবলেম অ্যান্টিসিপেট করি না। প্রবলেম অ্যান্টিসিপেট না করলেও প্রবলেম যে হবে না সেটা তো আর বলতে পারি না। প্রবলেম তো লাইফে যেকোনো সময় যেকোনো জায়গা থেকেই হতে পারে। সেটার জন্যে পিছপা হলে হবে না। আমরা এগিয়ে যাবো। প্রবলেম আসলে উই উইল ফেস দ্য প্রবলেম।”

এতো বড় কাজ করার মতো দক্ষ জনবল কি আছে? — “পরীক্ষা তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই নিবেন। যারা পরীক্ষা সবসময় নিয়ে আসছেন, যাদের পরীক্ষা নেওয়া অভিজ্ঞতা আছে তারাই পরীক্ষা নিবেন। এ জন্যে নতুন করে কাউকে প্রশিক্ষণ দিতে হচ্ছে না। ১৯৯৭ সালের দিকে আমি যখন ডিন ছিলাম তখন পরীক্ষার খাতা দেখতে কম্পিউটার ব্যবহার করার বিষয়টি আসে। তখন অনেকে রিজারভেশন দেখিয়েছিলেন। কিন্তু, প্রক্রিয়াটি বন্ধ করে দিতে পারেননি। এখন সেটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে।”

“আমি যখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলাম তখন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত সব কলেজে একদিনে আর্টস, সায়েন্স ও কমার্সের পরীক্ষা হতো। তখন তো কোনো প্রশ্নপত্র ফাঁসও হয়নি, কোনো সমস্যাও হয়নি।”

পরীক্ষার জন্যে তো কমিটি গঠন করা হবে? সেই কমিটি… — “হ্যাঁ। কমিটি গঠন করা হবে। আমরা আশা করছি মার্চ মাসে আরও জোরালোভাবে কাজ করতে পারবো। ... তোমরা জানো কেউ জিআরআই, স্যাট পরীক্ষা দিলে স্কোর পায়। আমাদের এখানে পরীক্ষা দিলে স্কোর পাবে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় স্কোর অনুযায়ী ভর্তি করে নিবে।”

“ভর্তি পরীক্ষা ইউজিসির দায়িত্ব না। আমরা শুধু এটিকে ফেসিলিটেট করছি। আমরা একটা জাতীয় স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সহায়তা করছি। কমিটির বৈঠকে বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে একটা ফর্মুলা বের করা হবে।”

সাধারণত দেখা যায় যে ক্ষমতাসীন দলের কাছাকাছি যারা থাকেন তাদেরকে এ ধরনের কমিটিতে নেওয়া হয়। — “ক্ষমতাসীনের সঙ্গে এখানে কোনো বিষয় না। ... এখানে দক্ষ ও সৎ শিক্ষকদের বাদ পড়ার কোনো আশঙ্কা নেই। যারা অভিজ্ঞ, যারা এ ধরনের কাজ করে আসছেন তারাই থাকবেন। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা থাকবেন। তারা জানেন যে কারা যোগ্য ব্যক্তি। যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা ভালোভাবে কাজ করতে পারবেন তা আমি জানি। কেননা, আমি সেখানে ছিলাম।”

দেশে গুড গভর্নেন্সের অভাব রয়েছে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হলে আরও দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হবে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। — “আগে আমরা উদ্যোগটা নেই, তারপর দেখা যাবে কী হয়। আগে থেকেই যদি আমরা সবকিছুতেই নেতিবাচক ধারণা রাখি তাহলে তো ইউর মাইন্ড সেট ইজ রং। আমি সবাইকে বলবো পজিটিভ মাইন্ড সেটে আসতে। কারণ, পজিটিভ মাইন্ড সেট থাকলে সবকিছুর সমাধান পাওয়া যাবে। আর যদি নেগেটিভ মাইন্ড সেট থাকে তাহলে সবকিছুতেই ফল্ট দেখতে পাবে। যেমন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো, একদল ‘হ্যাঁ’ বলে আরেকদল ‘না’ বলে। আসলে সবকিছুতো ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ দিয়ে সমাধান করা যায় না।”

“মানুষের ভালোও থাকে, মন্দও থাকে। আমরা এটাকে ইতিবাচকভাবে দেখছি। কারণ, আমরা চেষ্টা করছি। আমরাও এর নেতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে অবগত। কোথাও যে টুকটাক কিছু হবে না সেটাতো আমি গ্যারান্টি দিতে পারি না। আমি বলছি যে আমরা চেষ্টা করছি। আমরা যদি এটার ভয়ে ওটার ভয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকি তাহলে তো জীবনেও কিছু হবে না। যেখানে আছি সেখানেই থাকতে হবে।”

অনেকেই বলছেন, ইউজিসির যে কাজ তাই তো ঠিকমতো পালন করতে পারে না। পাবলিক-প্রাইভেট অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা সমস্যা-জটিলতা গণমাধ্যমে অনেকদিন ধরে আলোচনা হয়। ইউজিসিকে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে তৎপর দেখা যায় না। এখন আবার এতো বড় উদ্যোগ নিয়ে ঠিকমতো বাস্তবায়ন করা সম্ভব?

“কেনো সম্ভব নয়? কেনো পারছে না? ... কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু হলে সেটা তো আমার ব্যাপার না, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ব্যাপার। ... আমি পলিসিগত বিষয়ে সহযোগিতা করবো। কিছু মানুষ সবসময় নেতিবাচক কথা বলবেই, তার জন্যে পিছু হটার কোনো কারণ নাই।”

কীসের ভিত্তিতে এতো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, কোনো পরিকল্পনা বা গবেষণা...

“অভিভাবক, শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে দাবি ছিল সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার। এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা। তারা সবদিক বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’’

অধ্যাপক ড. তানজিম উদ্দিন খান বলেছেন, “ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীদের যে যন্ত্রণার মধ্যে থাকতে হয় সেদিক দিয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা একটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু, আমাদের দেশের বাস্তবতার সঙ্গে এটি কতোটা সঙ্গতিপূর্ণ? সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার দুটি দিক নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। একটি হলো: বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বতন্ত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা কোনো বোর্ড বা পাবলিক পরীক্ষা নয়। এটি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরীক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে এর আয়োজন করা হয়। সে জন্যে পরীক্ষার ধরন আলাদা।”

“বাংলাদেশে সার্বিকভাবে যে গভর্নেন্স রয়েছে তা এক কথায় মিস গভর্নেন্স। সেই মিস গভর্নেন্স আমরা দেখি পিইসি, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায়। এসব পরীক্ষায় দুর্নীতি হয়, নকল হয়, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। দুর্নীতিমুক্ত পরীক্ষা নেওয়া ক্ষমতা আমাদের নেই। কেন্দ্রীভূত পরীক্ষার মাধ্যমে ঝুঁকি তৈরি হয়। ঝুঁকির কারণ হচ্ছে আমাদের মিস গভর্নেন্স।”

“প্রত্যেকটি স্তরে কেন্দ্রীভূত পরীক্ষা যখন নেওয়া হয়, তখন দেখা যায়, যাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হয় তারা সাধারণত রাজনৈতিক নেটওয়ার্কের মধ্যে থাকেন। বিশেষ করে, ক্ষমতাসীন দলের কাছাকাছি যেসব শিক্ষক থাকেন মূলত তাদেরকেই সেই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হয়। প্রকৃত দক্ষ-সৎ শিক্ষকরা বঞ্চিত হন। এর ফলে পুরো প্রক্রিয়াটি ঠিক মতো কাজ করে না। পিইসি থেকে এইচএসসি পর্যন্ত এর ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। তাই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা ঝুঁকিপূর্ণ।”

“আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে: ইউজিসির দায়িত্ব এটি কী না? বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে পরীক্ষা নিবে তা ইউজিসি নির্ধারণ করতে পারে কী না? তার চেয়ে বড় কথা, যে উপায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করা হয়, সেটা খুব নিরপেক্ষ না। কী উপায়ে উপাচার্য নিয়োগ করা হয় তা সর্বজনবিদিত। ইউজিসির চেয়ারম্যানও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগ হয় না। শুধুমাত্র রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে এগুলো নির্ধারিত হয়। এ ধরনের প্রশাসন যখন সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার কাজ করতে চায় তখন খুব স্বাভাবিকভাবে মানুষের মধ্যে অনেক ধরনের আশঙ্কা তৈরি হয়।”

“সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার আরেকটি বিপদ হলো: কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষার দিনে অসুস্থ হয়ে গেলে তিনি আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। আবার অনেক ছেলে-মেয়ে আছে যারা এক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায় না, কিন্তু অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায়। একটি ভর্তি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে আমরা তাদের সেই সম্ভাবনাকেও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিচ্ছি। তাই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করার ঝুঁকি তৈরি হয়। ”

“আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কখনোই কেন্দ্রীভূত ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে না। কারণ, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বিষয়ে পড়ানো হয়, সেই বিষয় অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নাও থাকতে পারে। এগুলো কীভাবে সমন্বয় করা হবে? এটি ঠিক যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার কারণে শিক্ষার্থীদের বাড়তি খরচ হয়। বাড়তি সময় নষ্ট হয়। কিন্তু, বিকল্প উপায়ে কীভাবে সেগুলোর সমন্বয় করা যায় তা ভেবে দেখতে হবে।”

সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার পক্ষে তো যুক্তি আছে? — “অনেক শিক্ষার্থীকে ভর্তি পরীক্ষা দিতে দূর-দূরান্ত থেকে আসতে হয়। তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা, অন্যান্য আর্থিক খরচ, শ্রম— এগুলোর কথা বিবেচনা করেই হয়তো এমন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার দাবি আছে।”

“প্রশ্ন হলো, এমন যুক্তিতে শিক্ষার ক্ষেত্রে ইউজিসি এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে কি না? সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কোনো গবেষণা করা হয়েছে কি না। বা কোনো পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়েছে কি না? কোনো কিছুই তো করা হয়নি। অনুমানভিত্তিক সিদ্ধান্ত শিক্ষার ক্ষেত্রে নেওয়া যায় না। আগে গবেষণা করে ভালোমন্দ যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ‘সমস্যা হলে সমাধান করবো’- এই যুক্তি শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা ঠিক না। প্রথমে সমগোত্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে একটি উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারতো। কিংবা, এটিকে অঞ্চলভিত্তিক করতে পারতো। অর্থাৎ, একটি অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হতে পারতো।”

“সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার সঙ্গেই যায় না। প্রত্যেকটি স্তরে যে পরিমাণ দুর্নীতি, মিস গভর্নেন্স... ইউজিসিতে যারা আছেন তারা কতোটা স্বচ্ছ? কতোটা দুর্নীতিমুক্ত— সেই নিশ্চয়তা কে দিবে? সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা দেশের সার্বিক গভর্নেন্সের সঙ্গে সম্পর্কিত। এগুলো যদি আমরা ঠিক করতে না পারি, তাহলে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা আরও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিবে।”

অভিযোগ উঠেছে, পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে শিক্ষকরা যে টাকা পান তা বন্ধ হয়ে যাবে বলেই অনেক শিক্ষক সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিরোধিতা করছেন। — “এটি খুবই জঘন্য কথা। আমরা তো ভর্তি পরীক্ষার সময় ডিউটি বাবদ যে টাকা দেওয়া হয় সেটাই পাই। যারা প্রশ্নপত্র করেন বা ছাপার কাজে থাকেন তারা তাদের পরিশ্রম বাবদ টাকা পান। এমন তো নয় যে ভর্তি পরীক্ষার টাকা সব শিক্ষকরা ভাগ করে নেন। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সেরকম হয়ে থাকলে সেটিকে স্ট্রিমলাইনিং করা ঠিক না। তাদেরকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনা তো কঠিন কিছু না।”

ইউজিসি বলছে, ‘আগে আমরা উদ্যোগটা নেই, তারপর দেখা যাবে কী হয়’ এবং ‘কোথাও যে টুকটাক কিছু হবে না সেটা তো আমি গ্যারান্টি দিতে পারি না’ — “এটি একটি সিরিয়াস ইস্যু। এটি কোনো ছেলেখেলা নয়। এতোগুলো ছেলেমেয়ের ভাগ্য এতে জড়িত, এটি কি আগে ‘উদ্যোগ’ নেওয়ার ইস্যু? এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ এভাবে শুরু করা যায় না। দূরদৃষ্টি নিয়ে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে যদি এ ধরনের কাজ না করা হয়, তাহলে ডিজাস্টার হবে। যারা সামর্থ্যবান তাদের সমস্যা না। কিন্তু, যারা অনেক কষ্ট করে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়, ডিজাস্টার হলে তাদের ভাগ্যে কী হবে? এটিকে এতো হালকাভাবে দেখার কিছু নেই। উনাদের ছেলেমেয়েরা তো কেউ দেশে পড়াশুনা করে না। এ জন্যে তাদের কাছে বিষয়টি এতো গুরুত্ব পায় না।”

“যারা ইউজিসির সদস্য তাদের সেই যোগ্যতা আছে কি? কয়জন যোগ্যতা দিয়ে ইউজিসির সদস্য হয়েছেন? সবাই তো সদস্য হয়েছেন রাজনৈতিক পরিচয়ে। ভর্তি পরীক্ষার কমিটিতে রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে কেউ থাকতে পারবেন কী না — এর নিশ্চয়তা কে দিবেন? এটি একটি দলীয়করণ প্রক্রিয়া।”

“ভর্তি পরীক্ষায় বুয়েট যে মানের প্রশ্ন করে সবার কথা বিবেচনা করে কি সেই মানের প্রশ্ন করা যাবে? অন্য বিশ্ববিদ্যালয় কেনো মেনে নিবে যে সবার জন্যে বুয়েটের স্ট্যান্ডার্ডে প্রশ্ন হবে।”

“আমি জানি ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসা খুবই যন্ত্রণার। তাই সমন্বিত পরীক্ষা একটি পপুলার ডিমান্ড। সেক্ষেত্রে অন্য কোনো উপায় আছে কী না তা ভেবে দেখতে হবে। অঞ্চলভিত্তিক পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে। ভর্তি পরীক্ষার বেশিদিন সময় নেই। এতো অল্প সময়ে এমন ফান্ডামেন্টাল কাজ করা কতোটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে?”

“বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা কোনো ট্রায়াল অ্যান্ড এররের বিষয় না। এর মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীর আজীবনের ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে। একজন শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে। ট্রায়াল অ্যান্ড এররের কোনো সুযোগ নেই। এখানে পয়েন্ট ওয়ান পারসেন্ট ভুলেরও কোনো সুযোগ নেই। সামান্য ভুল করার মানে হচ্ছে কোনো না কোনো শিক্ষার্থী দুর্ভাগ্যের শিকার হবে।”

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

9h ago