প্রতিশ্রুতি শুধুই প্রতিশ্রুতি
গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে যখন একের পর এক মরদেহ নেওয়া হচ্ছিল তখন তাদের সাহায্যের জন্য প্রতিশ্রুতির কোনো অভাব হয়নি।
চকবাজার আগুন দেখিয়েছিলো রাষ্ট্র ও সমাজের সম্মিলিত ব্যর্থতায় কিভাবে এতগুলো জীবন ঝরে যায়। সরকার এবং বেসরকারি খাতের অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত ও তাদের পরিবারের জন্য আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এগিয়ে এসেছিল।
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের একদিন পর, ২১ ফেব্রুয়ারি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নিহত ফুটপাতের হকার, রিকশাচালক ও শ্রমিকদের পরিবারের জন্য এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তা জানান হয়।
ওই বছরের ১৮ ডিসেম্বর, বাংলাদেশ শ্রমকল্যাণ ফাউন্ডেশনের বোর্ড সভায় ক্ষতিপূরণের অর্থ বাড়িয়ে দুই লাখ টাকা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মন্ত্রণালয় ফাউন্ডেশনের তহবিল ব্যবহার করে সহায়তা করবে এমন ২৭ জন নিহত শ্রমিকের একটি তালিকা তৈরি করে।
এর আগে এপ্রিলে ৪০টি বেসরকারি ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় সরকারের জাতীয় ত্রাণ তহবিলে ৩০ কোটি টাকার চেক জমা দিয়েছে বলে ৪ এপ্রিল দ্য ডেইলি স্টার প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
তার কয়েক দিন আগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন রাজধানীর সিরডাপে একটি গণশুনানিতে নিহতদের পরিবারকে সিটি করপোরেশনে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
সব প্রতিশ্রুতিই লাল ফিতার ভেতরে আটকে আছে।
দ্য ডেইলি স্টারের সংবাদদাতারা চকবাজারের চুরিহাট্টায় বিধ্বংসী আগুনে নিহত ৭১ জনের মধ্যে ৪০ জনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা জানিয়েছেন, উল্লিখিত কর্তৃপক্ষের কারো কাছ থেকেই গত এক বছরে একটি টাকাও পাননি।
তাদের পাওয়া একমাত্র ক্ষতিপূরণ ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গ থেকে মরদেহের ব্যাগের সঙ্গে দেওয়া ২০ হাজার টাকা। এই টাকা দেওয়া হয়েছিল দাফনের খরচ হিসেবে।
ব্যস, এপর্যন্তই। তারপর থেকে তারা আর কিছুই পাননি।
জানতে চাইলে মন্ত্রণালয় ও ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারা প্রতিশ্রুতি পূরণে কাজ করছে এবং প্রতিশ্রুত অর্থ এবং চাকরি ‘শীঘ্রই’ দেওয়া হবে।
‘শীঘ্রই’ শব্দটি কোনো কাজেই আসছে না আগুনে পুরে মারা যাওয়া রাজু মিয়ার স্ত্রীর। রাজু চকবাজারে একটি মোবাইল ফোন সার্ভিসিংয়ের দোকানে কাজ করতেন। মারা যাওয়ার মাত্র ২৬ দিন আগে তিনি বিয়ে করেছিলেন।
রাজু যখন মারা যান তখন তার স্ত্রী উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডিও পেরোননি। শোকের মাঝেই বুঝতে পারেন তিনি গর্ভবতী। সাহস না হারিয়ে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন এবং পাস করেছেন। গত বছর নভেম্বরের শেষে তিনি ছেলে সন্তান জন্ম দেন।
রাজুর ভাই মেরাজ জানিয়েছেন, গত বছরের আগস্টের শেষের দিকে ফোন পেয়ে তিনি মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলেন। “সেদিন ছিল ৩০ আগস্ট। তারা আমাদের তথ্য নিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে আমাদের চেক হাতে তুলে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপ্রধানের সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।”
“এরপর পাঁচ মাসেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। আর কোনও ফোন কল বা মন্ত্রণালয়ের কোনও খবর নেই।”
পানবিক্রেতা মোহাম্মদ ইব্রাহিমের পরিবারের সদস্যরা গত বছরের ২৯ অক্টোবর এক কর্মকর্তার ফোন পেয়ে মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে তাদের জানানো হয় তারা কোনো টাকা পাবেন না।
ইব্রাহিমের শ্যালক নুরনবী বলেন, “আমি সচিবালয়ে গিয়ে আমাকে যে নম্বর থেকে কল দেওয়া হয়েছিল সেই নম্বরে কথা বলি। অপর পাশ থেকে একজন আমাকে অপেক্ষা করতে বলেন। একজন একটা তালিকা নিয়ে নেমে আসেন এবং আমাকে বলেন সেখানে ইব্রাহিমের নাম আছে কিনা। সেখানে তার নাম ছিল না, তাই আর আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।”
নুরনবীকে যে কর্মকর্তা ফোন করেছিলেন তার নাম বলতে পারেননি। তিনি বলেন, “আমি মনে করি, আমাদের হেনস্থা করা হচ্ছে।”
দ্য ডেইলি স্টার এই ঘটনায় মন্ত্রণালয় থেকে সহায়তা পাবে এমন নিহত শ্রমিকদের একটি তালিকা সংগ্রহ করেছে। তালিকায় ইব্রাহিমের নাম আছে একদম শুরুতেই।
ইব্রাহিমের স্ত্রীর ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশা প্রতিদিন ফিকে হচ্ছে।
ইব্রাহিমের মৃত্যুর পরে তার স্ত্রী বিবি হাজেরা তাদের নিজ শহর ফেনীতে ফিরে গেছেন। এখন তিনি সেখানে শীতল পাটি তৈরি করে তিন এবং সাত বছর বয়সী দুই মেয়েকে নিয়ে বাঁচার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
একই নামে কামরাঙ্গীরচরের একজন রিকশাচালক আছেন। তার নাম মোহাম্মদ ইব্রাহিম। তবে মন্ত্রণালয়ের তালিকায় তার নাম নেই।
দ্য ডেইলি স্টার তার শ্যালিকা শিরিনের সঙ্গে কথা বলেছিল। তার সঙ্গেই বর্তমানে ইব্রাহিমের স্ত্রী রোখসানা এবং তার দশ বছরের মেয়ে আছে।
“আমার স্বামীও রিকশাচালক। তিনি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য। প্রতিদিন মাত্র ২০০-৩০০ টাকা আয় করেন। তা দিয়েই সাতজনের পরিবার চালানো খুবই কঠিন,” তিনি বলেন।
এই দুর্ঘটনার শিকার রুমা বেগমের স্বামী মোহাম্মদ বিল্লাল মারা যাওয়ার দিন শূন্য ঘর রেখে গিয়েছিলেন। রুমা বলেন, “আমাদের ঘরে ভাত ছিল না, সবজি ছিল না, এক কথায় কিছুই ছিল না। আমি অপেক্ষায় ছিলাম সে বাজার করে আসবে তারপর আমরা রান্না করে খাবো।”
বিল্লাল একটি দোকানে পর্দা সেলাইয়ের কাজ করতেন। মন্ত্রণালয় থেকে রুমার ২ লাখ টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও এখনও তিনি একটি পয়সাও পাননি।
দুর্ঘটনার ঠিক কয়েকদিন আগে ঢাকার নবাবগঞ্জের ওয়ানডেরেলা গ্রিন পার্কে সপরিবারে পিকনিকে যান ওষুধের দোকানের কর্মী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু।
আগুনে মারা যাওয়ার পর তার ছেলের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিতে হয়েছে। কারণ তার স্ত্রী নাহিদা রহমানের পক্ষে ঢাকার স্কুলের খরচ চালানো সম্ভব হচ্ছে না। নাহিদা এখন তার ভাইয়ের সঙ্গে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে থাকেন। এলাকার বাচ্চাদের টিউশনি করিয়ে যে অর্থ আসে তা দিয়েই চলছে তাদের বেঁচে থাকার লড়াই।
“গ্রামের স্কুলেও ওকে পড়ানোর মতো টাকা আমার নেই। তার চাচারা বলছেন, আমার ছেলে মাদ্রাসায় ভর্তি হলে তারা সেই খরচ দেবে।”
ঢাকায় মাসিক নয় হাজার টাকা বাসা ভাড়া দেওয়া সম্ভব না বলে তিনি তার ভাইয়ের বাড়িতে চলে গেছেন বলে জানান। নাহিদা বলেন, “সবাই প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু, আসলে কেউই সহায়তা করে না।”
প্রতিশ্রুতি দেওয়া অর্থ কেনো এখনও হস্তান্তর করা হয়নি তা জানতে চাইলে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক মো. রেজাউল হক বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের পরিচয় যাচাই করা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া।
তিনি বলেন, “ডিসি অফিস এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে আমাদের তথ্য নিশ্চিত করতে হচ্ছে। টাকা দেওয়ার আগে মৃতদের বিস্তারিত তথ্য যাচাই-বাছাই করে নেওয়ার অপেক্ষায় আছি।”
আরও চার মৃত শ্রমিকের পরিবার জানিয়েছেন তারা মন্ত্রণালয় থেকে ফোন কলও পাননি।
মন্ত্রণালয় গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি আহত ১০ জনের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা জরুরি সহায়তা দিয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে, মেয়র খোকনের প্রোটোকল কর্মকর্তা হাবিবুল ইসলাম সুমন জানিয়েছেন, তারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের চাকরি দেওয়ার জন্য কাজ করছেন।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, “আমরা আগুন লাগার ঘটনার এক বছরপূর্তির দিন তাদের সঙ্গে দেখা করব এবং তাদের নগদ অর্থ, দোকান এবং চাকরি দেব। এগুলো সম্পূর্ণ মেয়রের বিবেচনামূলক তহবিল থেকে অর্থায়ন করা হবে।”
এত দীর্ঘ সময় কেন লাগল তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের খুঁজে পাওয়া আমাদের জন্য খুবই কঠিন ছিল এবং গত এক বছরে আমরা মাত্র ৩১ জনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছি।”
দ্য ডেইলি স্টারের সংবাদদাতারা আগুনের ঘটনার পরে চুরিহাট্টায় স্থানীয়দের প্রতিষ্ঠিত একটি সমাজকল্যাণ সংস্থা ‘চুরিহাট্টা একতা সংঘ’র কাছে থেকে একদিনেই নিহত ৭১ জন এবং তাদের পরিবারের বিস্তারিত তথ্য পেয়েছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ও ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ বলেছেন, মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ ৬৭ ভুক্তভোগীর ময়নাতদন্তের রিপোর্ট তৈরি করেছে এবং শিগগিরই তা পুলিশের কাছে জমা দেবে।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “নিহত ৬৭ জনের মধ্যে ৪৫ জনকে সনাক্ত করা হয়েছে। বাকি ২২ জনকে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে সনাক্ত করা হবে।”
Comments