ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষকরাই পড়তে পারেন না মাতৃভাষায় লেখা বই

মাতৃভাষায় শিক্ষাদানে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে সরকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে পাঁচটি ভাষায় লেখা পাঠ্যবই বিতরণ করে। তবে, শিক্ষকরা নিজেরাই এসব লিপির সঙ্গে পরিচিত নন। ফলে ব্যাহত হচ্ছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় শিক্ষাকার্যক্রম।
Marma language
বান্দরবানের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মারমা ভাষায় পড়ানোর দৃশ্য। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

মাতৃভাষায় শিক্ষাদানে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে সরকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে পাঁচটি ভাষায় লেখা পাঠ্যবই বিতরণ করে। তবে, শিক্ষকরা নিজেরাই এসব লিপির সঙ্গে পরিচিত নন। ফলে ব্যাহত হচ্ছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় শিক্ষাকার্যক্রম।

সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত নিজেদের ভাষায় পড়াশোনা করবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা। তৃতীয় শ্রেণি থেকে তাদেরকে বাংলা শেখানো হবে।

মাতৃভাষায় পাঠদানের জন্য সরকার ২০১২ সালে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নিজস্ব ভাষায় পাঠ্যবই প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। ২০১৭ সাল থেকে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাদ্রি এবং গারো— পাঁচ ভাষায় পাঠ্যবই বিতরণ করা হচ্ছে।

একাধিক শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভাষায় দক্ষতা না থাকার কারণে শিক্ষকরা এই বইগুলো শিক্ষার্থীদের পড়াতে পারছেন না। খাগড়াছড়ির সদর উপজেলার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, “মাতৃভাষায় লেখা পাঠ্যপুস্তকগুলো শিক্ষার্থীদের পড়ানোর জন্য শিক্ষকদের নিবিড় প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।”

এ বছর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রায় ওই পাঁচ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ৯৭ হাজার ৫৯৪ জন শিক্ষার্থীর মাঝে দুই লাখ ৩০ হাজার ১৩০টি বই বিতরণ করেছে। এই বই পড়ানোর দায়িত্বে থাকা অধিকাংশ শিক্ষকই এসব ভাষায় লিখতে-পড়তে জানেন না, শুধু কথা বলতে পারেন।

গত তিন বছরে তিন পার্বত্য জেলাগুলোতে কর্মরত চার হাজার ২০৪ জনের মধ্যে কেবল ৩৮ দশমিক ৬০ শতাংশ শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশ নেন। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ওই শিক্ষকদের তাদের নিজেদের ভাষার বর্ণমালার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলা পরিষদ ১৪ দিনের প্রশিক্ষণের আয়োজন করে।

তবে, এই প্রশিক্ষণ যথেষ্ট নয় বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চাকমা শিক্ষক। প্রশিক্ষণে বর্ণপরিচয়ের বেশি কিছু শেখানো হয় না।

তিনি বলেন, “চাকমা ভাষার বর্ণমালা আমি জানি। কিন্তু এখনো আমি চাকমা ভাষায় লেখা কিছু পড়তে পারি না, ঠিকঠাক লিখতেও পারি না।”

বেশ কয়েকজন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাও স্বীকার করেন যে ভাষা দক্ষতা অর্জনের জন্য এই প্রশিক্ষণ যথেষ্ট নয়।

রাঙ্গামাটির জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা খোরশেদ আলম জানান, এ প্রশিক্ষণটি বেশ ভালো মানের। তবে, আরও বেশি সময় নিয়ে প্রশিক্ষণ চালানো দরকার।

গত বছর ডিসেম্বরে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উদ্যোগে তিন পার্বত্য জেলায় ১০ দিনের প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছিল। তবে শিক্ষকদের জন্য আরও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলে জানান সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমান।

সিলেটের চিত্র আরও শোচনীয়। সিলেট অঞ্চলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষকদের জন্য এখনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি। মৌলভীবাজার সংবাদদাতা মিন্টু দেশোয়ারা জানান, শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবে শিক্ষার্থীরা মাতৃভাষায় পড়ালেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

সিলেটের প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের উপপরিচালক এ কে এম শাফায়েত আলম দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, গারো ও ত্রিপুরা ভাষা জানেন এমন প্রশিক্ষক না থাকায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

তিনি বলেন, “আমরা প্রশিক্ষণের ব্যাপারে প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং এনসিটিবির সঙ্গে আলোচনা করেছি। কিন্তু, এখনো কোনও নির্দেশনা পাইনি।”

প্রশিক্ষণ না থাকায় শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে বাংলা পাঠ্যবইয়ে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। ফলে মাতৃভাষায় পাঠদানের পুরো ধারণাটিই এখানে অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে।

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার দ্বিতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নতুন বছরের শুরুতে তারা ত্রিপুরা ভাষায় বই পেয়েছিল। কিন্তু, এই বইগুলো ক্লাসে পড়ানো হয়নি।

একই ক্লাসে একাধিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী থাকলে সেখানে পাঠদান কীভাবে হবে সে সম্পর্কেও কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই।

খাগড়াছড়ির একটি বিদ্যালয়ের চাকমা শিক্ষক জানান, “আমরা যখন মারমা ও চাকমা শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেই, তখন ত্রিপুরা শিক্ষার্থীদের ঘোরাফেরা করা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না।”

বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম চালু কেবল বই বিতরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সৌরভ শিকদার বলেন, “শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং পাঠদান সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন। কারণ একই ক্লাসে বহুভাষায় কথা বলা শিক্ষার্থীদের পাঠদান পদ্ধতি প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতির চেয়ে আলাদা।”

শিক্ষকদের ন্যূনতম তিন মাস প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত বলে জানান তিনি। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, শিক্ষার মান নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণ জরুরি।

“তাছাড়া আমাদের ভাষাগুলোকেও বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন।”

সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট এর শীর্ষ কর্মকর্তা নৃবিজ্ঞানী আবদুল হাই আল হাদী জানান, “বাংলা ভাষার আধিপত্যের কারণে সিলেট অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ বিশেষত শিশুরা বিদ্যালয় এবং অন্যান্য জায়গায় নিজস্ব ভাষায় কথা বলতে পারে না। এক পর্যায়ে এমনকি পারিবারিক পরিবেশেও তারা নিজের ভাষায় কথা বলতে অস্বস্তিতে ভোগে।”

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, “জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী বিশ্বের সব সম্প্রদায়ের মাতৃভাষায় পড়ালেখার অধিকার আছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ সনদে স্বাক্ষরকারী, জাতিসংঘের সদস্য।” এই স্কুলগুলোতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় শিক্ষক নিয়োগ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

নিজেদের ভাষায় লিখতে-পড়তে না পারায় প্রশ্নপত্র তৈরিতেও শিক্ষকরা সমস্যার মুখে পড়েন। কোন ভাষায় প্রশ্নপত্র তৈরি হবে সে নিয়ে নানারকম জটিলতায় পড়তে হয় শিক্ষকদের।

রাঙ্গামাটির একজন শিক্ষক জানিয়েছেন, “উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে জিগ্যেস করা হলে তারা আমাদেরকে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা দিতে পারেননি।”

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব আকরাম আল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, যদি আরও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয় তাহলে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করব।

পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা নেওয়া হবে না বলে জানান তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Extreme weather events threatening food security

Since May last year, Bangladesh faced more than a dozen extreme weather events -- four cyclones, nine incidents of floods, and multiple spells of heavy rains, heatwaves, and cold waves -- and now they threaten food security..These events not only harmed individual farmers and food security

4h ago