শহীদ মিনার নেই দেশের ৭৭ শতাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে

ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ফুল দেওয়ার জন্য শহীদ মিনার নেই দেশের ৭৭ শতাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
Shahid Minar
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ফুল দেওয়ার জন্য শহীদ মিনার নেই দেশের ৭৭ শতাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৬২০। শহীদ মিনার রয়েছে ১৪ হাজার ৯১৩ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

ডিপিই’র বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা যায়, দেশের বেশকিছু জেলার শতকরা ৯০ ভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই শহীদ মিনার নেই।

বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শহীদ মিনার না থাকার কারণ হিসেবে তহবিল ঘাটতির কথা বলছেন বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক এবং জেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা। তবে, শহরের বিদ্যালয়গুলোতে শহীদ মিনার না থাকার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে জায়গার সংকটের কথা।

বাঙালি জাতিসত্তার গৌরবোজ্জ্বল ও স্মৃতিবিজড়িত বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের স্মরণে প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি সারাবিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়।

সরকারি ছুটির দিন হলেও, দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয় খোলা থাকে এই দিনে। ভাষা শহীদদের স্মরণে সর্বস্তরের মানুষ একুশে ফেব্রুয়ারি প্রভাতফেরিতে বের হন শহীদ মিনারে ফুল দিতে।

যেসব বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নেই, সেখানে তৈরি করা হয় অস্থায়ী শহীদ মিনার। ভাষা শহীদদের স্মরণে বিদ্যালয়গুলোতে দিনব্যাপী আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, শিক্ষা কর্মকর্তা সবাই মিলেই বিদ্যালয়গুলোতে উদযাপন করে থাকেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

রাজধানীর মিরপুর চম্পা পারুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৮৩। শিক্ষার্থীরা দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছে, তাদের বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নেই।

বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী মোহাম্মদ রহিম জানায়, ২১ ফেব্রুয়ারি তারা বিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। কিন্তু, বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শহীদ মিনার না থাকায়, ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানানো হয় না।

বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুরাইয়া মজুমদার জানিয়েছেন, জায়গা না থাকায় বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শহীদ মিনার তৈরি করা যাচ্ছে না।

এ চিত্র শুধু চম্পা পারুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই নয়। ঢাকা বিভাগের অধীনে ১০ হাজার ৯৩০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৭১ শতাংশ বিদ্যালয়েই শহীদ মিনার নেই।

সবচেয়ে কম শহীদ মিনার রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে। বিভাগের শতকরা ৮৬ ভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই শহীদ মিনার নেই।

শহীদ মিনার না থাকা জেলাগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে ঠাকুরগাঁও। জেলার ৯৯৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে শহীদ মিনার নেই শতকরা ৯৬ ভাগ বিদ্যালয়ে।

ভোলা জেলার ১ হাজার ৪৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৯৫ ভাগ বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নেই। মেহেরপুর জেলার মোট ৩০৯ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৯২ ভাগ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনার থেকে বঞ্চিত।

তবে, এই দুই জেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নিখিল চন্দ্র হালদার ও ফজলে রহমান জানিয়েছেন, বিদ্যালয়গুলোতে শহীদ মিনার স্থাপন বাধ্যতামূলক করা উচিত।

ফজলে রহমান বলেন, “বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শহীদ মিনার স্থাপন করা হলে শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন এটি দেখবে। পাঠ্যপুস্তক থেকে ভাষা আন্দোলনের বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি এর মাধ্যমেও তারা জ্ঞান অর্জন করতে পারে।”

“শহীদ মিনার নির্মাণে সরকারের পক্ষ থেকে বরাদ্দ নেই,” যোগ করেন তিনি।

বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শহীদ মিনারের প্রয়োজন কেন?

শিক্ষার্থীদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে ও এর তাৎপর্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে বিদ্যালয়গুলোতে শহীদ মিনারের প্রয়োজনীয়তার কথা জোর দিয়ে বলেছেন ভাষাসৈনিক ও শিক্ষাবিদেরা।

ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ছিল ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি করে শহীদ মিনার থাকা উচিত।”

তার মতে, “এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে। শহীদদের উদ্দেশ্যে নির্মিত স্মৃতিসৌধ শৈশব থেকেই তাদের দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করবে।”

আহমদ রফিকের অভিযোগ, শহীদ মিনার নির্মাণের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ উদাসীন। তিনি বলেন, “বাংলা ইতোমধ্যে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা অর্জন করেছে বলে শিক্ষা বিভাগের লোকেরা মনে করেন, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস মনে রাখার দরকার নেই।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “দেশের এতগুলো বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার না থাকাটা দুর্ভাগ্যজনক। ভাষা আন্দোলনের ঘটনা আমাদের জাতীয়তাবোধ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম তথা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণার উৎস-প্রতীক।”

“ভাষা আন্দোলনের মর্যাদা-তাৎপর্য ধীরে ধীরে মানুষ ভুলে যাচ্ছে। ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের শিক্ষা কমে যাওয়ায় শহীদ মিনারকে তারা আর গর্বের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করছে না। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং, এটা তাদের মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ,” যোগ করেন তিনি।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) কর্মকর্তারা দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, ইতোমধ্যেই তারা দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার স্থাপনের কথা ভাবছেন।

ডিপিই মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ বলেন, “আমরা সব বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার স্থাপন করবো। ডিপিইর ‘স্কুল লেভেল ইম্প্রুভমেন্ট প্ল্যান’ প্রকল্পের আওতায় প্রাপ্ত অনুদান থেকে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটা নির্মাণ করতে পারবে।”

বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৪৮ সালে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৯ বাংলা সাল) যারা আন্দোলনে নামেন, তাদের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। গুলিতে আবুল বরকত, আবদুল জব্বার ও আবদুস সালামসহ বেশ কয়েকজন ছাত্রযুবা নিহত হন। এর পরেই, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

যে চেতনায় উদ্দীপিত হয়ে বাঙালিরা রক্ত দিয়ে মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, আজ তা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত। বিশ্বব্যাপী জাতিগোষ্ঠীর ভাষাগত অধিকার উদযাপন ও ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর ২০০০ সাল থেকে প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিকভাবে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে।

Comments

The Daily Star  | English

40 garment factories closed in Ashulia amid labour unrest

Negotiations between the owners and workers are still in progress in a bid to resolve the issues

10m ago