আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের আদেশ যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ
রোহিঙ্গা গণহত্যা অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে হওয়া মামলায় জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) গত ২৩ জানুয়ারি অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপের আদেশ দিয়েছেন। আদেশে যা বলা হয়েছে তা সাধারণ মানুষের কাছে আইনের দুর্বোধ্য ভাষা মনে হতে পারে। কিন্তু আমার মতো যে রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, এই আদেশ তাদের জন্য বিশাল কিছু।
আইসিজে অং সাং সু চির সরকারকে কার্যকরভাবে এই কথাই বলেছে যে ১৯৪৮ সালের গণহত্যার কনভেনশন মোতাবেক রোহিঙ্গাদের ওপর সেনা অভিযান বন্ধ করতে হবে। দশকের পর দশক ধরে আমরা নির্যাতিত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক গুরুত্ব রাখে এমন একটি সংস্থা বলল, যথেষ্ট হয়েছে, আর না।
রোহিঙ্গাদের দুর্গতির কথা বিশ্ববাসী জানতে পারে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তখন নির্মূল অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে হাজার হাজার মানুষ হত্যা, ব্যাপক হারে ধর্ষণ, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। প্রাণে বাঁচতে সাত লাখের বেশি মানুষকে আশ্রয় নিতে হয় বাংলাদেশে।
কিন্তু ওই ঘটনাটি ছিল পানির ভাসা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। রোহিঙ্গারা দশকের পর দশক ধরে রাখাইনে খোলা কারাগারে দিন কাটিয়েছেন। ১৯৮২ সালে আমাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নিয়ে কার্যত রাষ্ট্রহীন করে দেওয়া হয়। মিয়ানমারের ভেতরেও আমাদের চলাচলের স্বাধীনতা নেই। গ্রাম ছেড়ে কোথাও যেতে অনুমতিপত্র জোগাড় করতে হয় সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে। শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবা ধরাছোঁয়ার বাইরে। মিয়ানমার সরকারের সব আয়োজনই ছিল আমাদেরকে মানবেতর জীবনের দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য। এমন এক পরিস্থিতিতে তারা আমাদের ফেলতে চেয়েছিল যখন দেশ ছেড়ে পালানো ছাড়া উপায় থাকে না।
কিন্তু যেই মানুষগুলোর সম্পদ বলতে প্রায় কিছুই নেই দেশ ছেড়ে যাওয়া তাদের জন্য সহজ নয়। বেশিরভাগ রোহিঙ্গাকেই বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়ার জন্য ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আর খুব সামান্য সংখ্যক পেরেছে বিদেশে ভবিষ্যৎ গড়তে। সেরকম খুব অল্প কিছু মানুষের মধ্যে আমি একজন। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে আমি রাখাইন ছাড়ি যখন শুধুমাত্র রোহিঙ্গা হওয়ার কারণে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হলো না। তখন থেকে দূরে বসে আমি দেখছি কিভাবে আমার স্বজাতির মানুষের ওপর গণহত্যা চালিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে মিয়ানমার সরকার-সেনাবাহিনী।
এ কারণেই আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের আদেশ আমাদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ। আদেশের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলাম আমি। খুব কষ্টে তখন চোখের জল ধরে রাখতে হয়েছে। আদালত প্রকাশ্যে যখন মিয়ানমারের ওপর দোষারোপ করছিল আমি ভাবছিলাম আমার বন্ধু, পরিবার-পরিজনের কথা যাদের সীমাহীন নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। আমার মনে পড়ছিল তাদের বেদনার কথা যাদের আপনজনদের জীবন দিতে হয়েছে রাখাইনে।
মিয়ানমার সরকারকে কাঠগড়ায় টেনে এনেছে গাম্বিয়া। গাম্বিয়ার নেতারা নিজেদের সম্পর্কে বলেছেন, “আয়তনে তাদের দেশ ক্ষুদ্র হলেও মানবাধিকার সুরক্ষায় উচ্চকণ্ঠ।” এই মামলার বিচার প্রক্রিয়া শেষ হতে বহু বছর লেগে গেলেও অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ এই জয়ের পথে গুরুত্বপূর্ণ একটি অগ্রগতি।
আইসিজের আদেশ মেনে চলতে মিয়ানমার আইনত বাধ্য। মিয়ানমার যে আদালতের আদেশ মেনে চলছে তা প্রতিবেদন আকারে নিয়মিত জানাতে হবে।
কিন্তু আদেশ মেনে মিয়ানমার সত্যিই কিছু করছে কিনা এটা দেখতে আমাদের আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে মিয়ানমার সরকার একরকম কুলুপ এঁটে রয়েছে। আইসিজের আদেশের ব্যাপারে শুধু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, “আদেশে পরিস্থিতির আসল চিত্র উঠে আসেনি।”
দুর্ভাগ্যজনকভাবে দায় এড়িয়ে মিয়ানমার সরকার হয়ত এবারও সেটাই করবে যেটা তারা এতদিন ধরে করে এসেছে—ফাঁকা বুলি, অস্বীকার, অহেতুক বিলম্ব, আর সময় চেয়ে আবেদনের পর আবেদন। অং সান সু চি নিজেই তার সরকারের জনসংযোগের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো বহু রোহিঙ্গা এই মানুষটিকে বছরের পর বছর সমর্থন দিয়েছে—যিনি কিনা এখন সেনাবাহিনীর কৃতকর্মের সাফাই দিচ্ছেন।
এর পরও সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে আলোর আভাস আছে।
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরিতে মিয়ানমার কী কী করছে তা প্রতিবেদন আকারে নির্দিষ্ট সময় পর পর আইসিজেকে জানাতে হবে। নির্দেশনা অনুযায়ী মিয়ানমার কাজ না করলে বিষয়টি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পর্যন্ত গড়াতে পারে। নিরাপত্তা পরিষদে চীন এতদিন মিয়ানমারকে রক্ষা করে গেলেও আদালতের আদেশ থাকায় রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় আরও বাড়তি পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী হবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে ন্যায়বিচারের চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। গত নভেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে। একই সময়ে আমার নিজস্ব সংস্থা ‘বার্মিজ রোহিঙ্গা অরগানাইজেনশন ইউকে’ও আর্জেন্টিনায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটি ‘ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশন’ মামলা করে। কিছু কিছু অপরাধ এতোটাই ভয়াবহ যে সামগ্রিকভাবে পুরো ঘটনাকে ‘মানবতাবিরোধী’ বলে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে। যেখানেই অপরাধ ঘটুক না কেন মানবতাবিরোধী অপরাধের ক্ষেত্রে বিশ্বের যেকোনো জায়গা থেকেই বিচারের জন্য মামলা করা যেতে পারে। এর ফলে মিয়ানমারের নেতৃত্বের ওপরও চাপ বাড়ছে।
গত কয়েক বছরে রাখাইন রাজ্যে ঘটে যাওয়া অপরাধ নিয়ে ২০ জানুয়ারি মিয়ানমার নিজস্ব একটি তদন্তের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রথমবারের মতো তারা যুদ্ধাপরাধ এবং গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা স্বীকার করে নেয়।
তবে প্রতিবেদনটিতে অনেক মারাত্মক অপরাধের কথা উল্লেখ করা হয়নি। এটি আইসিজকে ভুল বোঝানোর একটি প্রচেষ্টা ছিল।
এটা পরিষ্কার যে, তদন্তের জন্য মিয়ানমারকে বিশ্বাস করা যায় না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। ২০১৭ সালে লাখো মানুষ রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে যায়। আমি নিজে বাংলাদেশে এক মাস কাটাই। সেসময় আমি অসংখ্য শরণার্থীদের গল্প শুনেছি। তাদের দুঃখ কষ্ট দেখেছি। সীমান্তের দিকে পালানোর সময় কিভাবে তাদের দিকে গুলি ছোঁড়া হয়েছিল তারা আমাকে সেসব কথা জানিয়েছেন। জানিয়েছেন, কত অসহায়ভাবে তারা চোখের সামনে পরিবারের সদস্যদের মেরে ফেলতে, গ্রামগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিতে দেখেছেন। তবুও কখনো তারা প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ভাবেনি। তারা কেবল ন্যায়বিচার চান।
নিজের সঙ্গে, প্রিয়জনের সঙ্গে, হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর সঙ্গে এবং গোটা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের বিচার চান তারা। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য হেগে যখন মিয়ানমারকে তিরস্কার করা হচ্ছিল তখন আমি সেই শরণার্থীদের কথা ভাবছিলাম।
আমি ভাবছিলাম, এই সিদ্ধান্ত কীভাবে তাদের পক্ষে ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য আরেক ধাপ সামনে এগিয়েছে। আমরা, রোহিঙ্গারা আমাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে চাই। জীবন হারানোর ভয় ছাড়া অন্য সব সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে চাই। গত মাসে, আইসিজে আমাদেরকে আশার আলো দেখিয়েছে যে, আমাদের এই স্বপ্ন একদিন বাস্তবে পরিণত হবে। আমাদের মানুষের ভবিষ্যতকে নিরাপদ ও সুরক্ষিত করার জন্য বিশ্বের সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।
সূত্র: আল জাজিরা
Comments