সিলেট বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র যেন ‘কনডেম সেল’
![Sylhet_Wildlife_Conservation_Centre Sylhet_Wildlife_Conservation_Centre](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/feature/images/sylhet_wildlife_conservation_centre.jpg?itok=DJ5XEKYY×tamp=1583212110)
সিলেটের টিলাগড় ইকো পার্ক প্রাণীদের জন্য এক ভয়ঙ্কর মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। বন বিভাগের কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েকমাসে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রে অন্তত ৩৩টি প্রাণী ও পাখি মারা গেছে।
টিলাগড় বিটের ভারপ্রাপ্ত বন কর্মকর্তা চয়নব্রত চৌধুরী জানান, এর মধ্যে চারটি হরিণ, চারটি চুকার প্যাট্রিজ, চারটি ময়ূর এবং একটি জলা মোরগ মারা গেছে। এ ছাড়া, ২০টি লাভ বার্ড মারা গেছে কিংবা খাঁচা থেকে পালিয়েছে।
তবে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি বলে জানিয়েছেন প্রাণীদের তদারকি করেন এমন এক কর্মচারী। তিনি বলেন, মৃত প্রাণীর সংখ্যা ৫০টিরও বেশি হবে। কমপক্ষে আরও ১০টি প্রাণীর কোনো খোঁজ নেই।
প্রতিষ্ঠার মাত্র দুই বছরের মধ্যে এতগুলো প্রাণীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে অভিজ্ঞ জনবল ও উপযুক্ত পরিবেশের অভাবকে দায়ী করছেন প্রাণী অধিকার কর্মীরা।
সংরক্ষণ কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, সেখানে কোনো ভেটেরিনারি সার্জনকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। একটি সার্জিক্যাল বেড পর্যন্ত নেই সেখানকার প্রাণী হাসপাতালে। দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী অধিকার সংস্থা প্রাধিকারের সভাপতি আহমদ রাফি বলেন, সংরক্ষণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনার জঘন্য অবস্থা। প্রাণীগুলোকে খাঁচায় এমনভাবে রাখা হয় যে, সেখানে বাঁচাই সম্ভব না। এছাড়াও, কেন্দ্রের ভেতরে গাড়ি চলাচল করাটা প্রাণীদের জন্য খুবই যন্ত্রণাদায়ক।
পরিবেশ ও প্রাণী অধিকারভিত্তিক সংস্থা ভূমিসন্তান বাংলাদেশ’র সমন্বয়ক আশরাফুল কবির সংরক্ষণ কেন্দ্রটিকে ‘প্রাণীদের জন্য কনডেম সেল’ হিসেবে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘কোনো স্পেশালিস্ট ভেটেরিনারি সার্জন নিয়োগ না দিয়েই সংরক্ষণ কেন্দ্রে প্রাণী এনে চূড়ান্ত অবহেলা দেখিয়েছে বন বিভাগ। এ ছাড়া, একটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কাছে সংরক্ষণ কেন্দ্রের ইজারা দেওয়াটাও আপত্তিকর।’
২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে সংরক্ষণ কেন্দ্রটি তানহা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ইকো পার্ক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের কাছে পাঁচ লাখ পাঁচ হাজার টাকায় এক বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের অক্টোবরে ওই একই প্রতিষ্ঠান সাত লাখ ৫৭ হাজার টাকায় আবারও এক বছরের জন্য সংরক্ষণ কেন্দ্রটি ইজারা নেয়।
তানহা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী আমাদের দায়িত্ব প্রবেশ ও পার্কিংয়ের টিকিট বিক্রি, পশুপালকদের পরিচালনা ও সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আমরা পশুর যত্ন নিতে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক থেকে দুজন প্রাণী রক্ষককে এনেছি। ফলে এ বিষয়ে কোনো সমস্যা নেই।’
তার অভিযোগ, সংরক্ষণ কেন্দ্রটি অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। এটাই যাবতীয় সমস্যার কারণ।
আনোয়ার হোসেন আরও বলেন, ‘সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন প্রাণী চিকিৎসক এখানে এসে নিয়মিত প্রাণীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। যেহেতু, বন বিভাগ ইতোমধ্যে একটি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিকল্পনা করেছে, তাই আমরা বেশ আশাবাদী। প্রকল্প শেষ হলে সব সমস্যার সমাধান হবে।’
বন বিভাগ সূত্র জানায়, কেন্দ্র পরিচালনা করার দায়িত্ব ইজারাদারের। প্রাণী রক্ষক ও প্রাণী চিকিৎসকের ব্যয় বহনের দায়িত্বও তাদের। প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র উন্নয়নে বন বিভাগ এক শ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে। প্রস্তাবনাটি মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।
সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এস এম সাজ্জাদ হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এই প্রকল্পের আওতায় খাঁচাগুলোকে পুনঃনির্মাণ করা হবে। জনবল বরাদ্দ করা হবে এবং আরও বেশ কয়েকটি বিষয়ে কাজ করা হবে যেন সংরক্ষণ কেন্দ্রটি প্রকৃত অর্থেই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করতে পারে।’
জনবলের ঘাটতি রয়েছে। ইজারাদার সঠিকভাবে কেন্দ্রটি পরিচালনা করতে পারছে না, বলেন সাজ্জাদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘প্রকল্পে আমরা একজন চিকিৎসক ও নয় জন প্রাণী রক্ষকসহ মোট ২৭ জনের জন্য বরাদ্দ চেয়েছি। কেন্দ্রটি উদ্বোধনের সময় অনেক কিছুকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এখন আমরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি, সেগুলো এড়াতে চাই। সংরক্ষণ কেন্দ্রটি প্রকৃত বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে আমরা আশাবাদী।
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক থেকে ৬২টি প্রাণী নিয়ে ২০১৮ সালের ২ নভেম্বর সংরক্ষণ কেন্দ্রটি চালু করা হয়। পরে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৪০টির বেশি প্রাণী আনা হয়। প্রাণী অধিকার সংস্থাগুলো কয়েকটি প্রাণী উদ্ধার করে কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে। সিলেটের টিলাগড় এলাকার মোট ৪৫ দশমিক ৩৪ হেক্টর বনকে ২০০৬ সালে টিলাগড় ইকো পার্ক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। দীর্ঘ অযত্ন-অবহেলার পর বন বিভাগ ২০১২ সালে সেখানে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্পটির প্রাথমিক বাজেট ছিল ৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ২০১৩ সালে সংরক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়। ২০১৬ সালের জুন মাসে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে নির্ধারিত সময়সীমা সংশোধন করে বন বিভাগ তড়িঘড়ি করে ২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে নির্মাণকাজ শেষ করে। সংরক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনায় প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় বন বিভাগ এটিকে ইজারা দেয়।
এত সমস্যার মধ্যেও সংরক্ষণ কেন্দ্রে দুটি চিত্রা হরিণ চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি ও ১৩ ফেব্রুয়ারি দুটি বাচ্চা দেয়।
Comments