লবণ চাষিদের নোনা কান্না

আবদুল করিমের মন আনন্দে ভরে উঠে যখন তিনি তার লবণ খেতের দিকে তাকান। স্তূপীকৃত সাদা লবণ তাকে স্বপ্ন দেখায়। কিন্তু এই আনন্দ শিগগির ম্লান হতে শুরু করে যখন তিনি লবণ বিক্রির কথা চিন্তা করেন।
Salt.jpg
কক্সবাজারের চৌফলদন্ডি গ্রামের লবণ খেতে কাজ করছেন চাষিরা। ছবি: মোকাম্মেল শুভ/স্টার

আবদুল করিমের মন আনন্দে ভরে উঠে যখন তিনি তার লবণ খেতের দিকে তাকান। স্তূপীকৃত সাদা লবণ তাকে স্বপ্ন দেখায়। কিন্তু এই আনন্দ শিগগির ম্লান হতে শুরু করে যখন তিনি লবণ বিক্রির কথা চিন্তা করেন। 

কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডি গ্রামের এই কৃষক ১ দশমিক ৬ একর জমিতে লবণ চাষ করছেন। সবমিলিয়ে তার এই জমিতে খরচ হবে প্রায় ১ দশমিক ৬ লাখ টাকা, আর মৌসুম শেষে পাবেন প্রায় ৮০০ মণ লবণ।

মাঠ পর্যায়ে এখন লবণ বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ দেড়শ টাকা দরে। এই দাম চলতে থাকলে মৌসুমের শেষে তার মোট লোকসান দাঁড়াবে প্রায় ৪০ হাজার টাকা।

‘কম দামের কারণে এই মৌসুমে আমদের উৎপাদন ব্যয়ও উঠবে না। আর দামের পতন যদি দীর্ঘদিন অব্যাহত থাকে, তাহলে পরিবারের মুখে ভালো খাবার তুলে দেওয়া কষ্টসাধ্য হবে’, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করিম বলেছিলেন।

তিনি বলেন, ‘গত মৌসুমে এক মণ লবণ ২০০ টাকায় বিক্রি করেও তাদের লোকসান হয়েছে। এবারের পরিস্থিতি আরও খারাপ। কারণ প্রতি মণ লবণের দাম ১৫০ টাকায় নেমেছে।’

করিমের মতো কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের প্রায় ৩০ হাজার লবণ চাষি তাদের উৎপাদনের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না বলে জানা গেছে।

লবণ চাষি ও সরকারি কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন যে, অসাধু ব্যবসায়ী ও মিল মালিকদের একটি সিন্ডিকেট লবণের দাম নিয়ে কারসাজি করছে।

তারা বলেছেন, ভোজ্য লবণের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞার পরেও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী চীন ও ভারতের মতো দেশগুলো থেকে শিল্প লবণ হিসেবে পরিচিত সোডিয়াম সালফেটের নামে প্রচুর পরিমাণে ভোজ্য লবণ আমদানি করছে।

সোডিয়াম ক্লোরাইড ভোজ্য লবণের রাসায়নিক নাম এবং সোডিয়াম সালফেট প্রধানত ডিটারজেন্ট, শিল্প রঞ্জক এবং কাগজের মণ্ড তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিএসসিআইসি) সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপক সারওয়ার হোসেন বলেন, ‘মিল মালিকদের কাছে দুবছর আগের আমদানিকৃত বিপুল পরিমাণ ভোজ্য লবণের মজুদ রয়েছে।’

‘তাদের অনেকে স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে লবণ কিনছেন না, ফলে চাষিদের উৎপাদিত লবণের মূল্য কমে যাচ্ছে’, বলেন তিনি।

কক্সবাজার লবণ চাষি সমিতির সভাপতি মো. হান্নান মিয়া বলেছেন, ‘মিল মালিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে লবণের দাম নিয়ে কারসাজি করছেন।’

বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি কবির আহমেদ এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘মূল্য হ্রাসের জন্য ভোজ্য লবণের আমদানি দায়ী।’

তিনি বলেন, ‘এই আমদানি কারসাজির ফলে অনেক মিল মালিকও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।’

তিনি লবণ আমদানির ক্ষেত্রে সরকারের নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে অনুসরণ করার দাবি জানিয়েছিলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিভিন্ন ধরনের লবণের আমদানি হয়েছিল প্রায় ২২ লাখ ৮৩ হাজার মেট্রিক টন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ১৮ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২২ লাখ ৫২ হাজার মেট্রিক টন এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সাত লাখ ৫৮ হাজার মেট্রিক টন।

বিএসসিআইসি বলছে, শিল্প খাতে ব্যবহারের জন্য দেশে প্রতি বছর লবণের চাহিদা প্রায় নয় লাখ পাঁচ হাজার মেট্রিক টন।

কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলাতে ৬০ হাজার ৭৯৬ একর জমিতে লবণ উৎপাদিত হয় এবং যেখানে কয়েক হাজার মানুষ জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে লবণ বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল।

দেশে মধ্য নভেম্বর থেকে মধ্য মে পর্যন্ত ছয় মাস লবণ উৎপাদিত হয়।

কক্সবাজার বিসিকের লবণ উন্নয়ন অফিসের সম্প্রসারণ কর্মকর্তা শামীম আলম জানান, গত মৌসুমে ১৬ দশমিক ৫৭ লাখ মেট্রিক টন চাহিদার বিপরীতে লবণের উৎপাদন ছিল ১৮ দশমিক ২৪ লাখ মেট্রিক টন। 

‘এ মৌসুমে ইতোমধ্যে প্রায় ৪ লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হয়েছে এবং এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ১৮ দশমিক ৪৯ লাখ মেট্রিক টন’, বলেন তিনি।

বিসিকের মতে, সারাদেশে ২১৩টি লবণের শিল্প রয়েছে।

বিসিক কর্মকর্তারা বলেছেন, ‘দেশে লবণের উৎপাদন ব্যয় বেশি। কারণ কৃষকরা জমির ইজারা দেওয়ার জন্য প্রায় ৬০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করেন।’

তবে প্রতিবেশী দেশ ভারতে বিষয়গুলো ভিন্ন। গুজরাট ও চেন্নাইয়ের চাষিরা লবণ উৎপাদনের জন্য সরকারি জমি ব্যবহার করে বলেও জানান তিনি।

‘আমাদের মৌসুমের দৈর্ঘ্য ছয় মাস হলেও তাদের আট মাস। তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা সেখানে আমাদের চেয়ে আরও বেশি অনুকূল’, বলেন শামীম।

বিসিকের কর্মকর্তারা অবশ্য বিশ্বাস করেন শিগগির লবণের দাম বাড়বে।

বিসিকের সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপক সারওয়ার হোসেন আরও বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে বড় মিল মালিকদের সঙ্গে বসেছি, যারা মার্চ মাসে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কক্সবাজারের কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি লবণ কিনবেন।’ 

‘বড় মিল মালিকরা কৃষকদের কাছ থেকে লবণ কেনা শুরু করলে দাম বাড়বে’, যোগ করেন তিনি।

(আমাদের চট্টগ্রাম ব্যুরো অফিসের মো. সুমন মিয়া এবং কক্সবাজারের মোহাম্মদ আলী জিন্নাত এই প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন)

Comments