‘বঙ্গবন্ধু ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে হাত নাড়ালেন’
‘ক্যামেরার কবি’ নাসির আলী মামুন দেশ-বিদেশে বহু বিখ্যাত মানুষের ছবি তুলেছেন। তিনি ক্যামেরায় ধরেছেন বঙ্গবন্ধুর বিশেষ মুহূর্তগুলো। ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামে বঙ্গবন্ধুর সেই ছবিগুলো প্রদর্শন করা হবে ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেসের লা গ্যালারিতে। আগামীকাল শুক্রবার শুরু হতে যাওয়া ১৯ দিনের এই প্রদর্শনী শুরুর প্রাক্কালে নাসির আলী মামুন কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের সঙ্গে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কথা এলে আপনার মানসপটে কোন ছবিটি ভেসে উঠে?
বঙ্গবন্ধুকে আমি প্রথম দেখি ১৯৬৪ সালে। তৎকালীন পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতেমা জিন্নাহ নির্বাচন করেছিলেন। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু তাকে সমর্থন দিয়েছিলেন। তখন বাবার কর্মসূত্রে আমরা ঢাকার গ্রিনরোডে থাকতাম। আমার বয়স ছিল ১১ বছর। বঙ্গবন্ধু তখন ঢাকায় ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে অনেকগুলো জনসভা করেছিলেন। একটা সভায় বঙ্গবন্ধু খোলা জিপে চড়ে এসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন মহিউদ্দিন আহমেদ ও গাড়িচালক। সভাটি হয়েছিল ধানমন্ডি ৮ নং রোডের কাছে। তার সঙ্গে কোনো কর্মীবাহিনী ছিল না। বঙ্গবন্ধুর পরনে ছিল পায়জামা-পাঞ্জাবি ও কোট। তিনি দরাজ কণ্ঠে ভাষণ দিয়েছিলেন। অনেক লোক সমাগত হয়েছিল। আমার চোখের সামনে সেই দৃশ্যই ভেসে উঠে।
বঙ্গবন্ধুর ছবি প্রথম কবে তুলেছিলেন?
গাজীপুরের টঙ্গী ও দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে যারা নিহত হয়েছিলেন তাদের স্মরণে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভায় ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেদিন বিকাল ৪টার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমি বঙ্গবন্ধুর ছবি প্রথম তুলি। বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোনের সামনে দুই হাত তুলে মোনাজাত করছিলেন এমন ছবি তুলেছিলাম। বিকালের রোদে আকাশ খুব ঝলমল করছিল।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার প্রথম কথা হয়েছিল কবে?
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কোনোদিন কথা হয়নি। এটা একটা বড় আফসোস। একান্তে তার ছবি তোলার সুযোগও হয়েছে। কিন্তু, কোনোদিন কথা হয়নি।
সেটা কেমন?
১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে গণভবনে গিয়েছিলাম। তিনি একটি রুশ প্রতিনিধি দলকে বিদায় দিয়ে তার রুম থেকে বের হয়ে এসেছেন। পড়নে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি, হাতে পাইপ। সেখানে শুধু ছিলেন মহিউদ্দিন সাহেব। আর কেউই ছিলেন না। নিরাপত্তা কর্মীরাও ছিলেন না।
মাঝেমধ্যে উনার একান্তসচিব রফিকুল্লাহ চৌধুরী এসে দেখতেন বঙ্গবন্ধু কী করছেন। বঙ্গবন্ধু বাগানে ফুলের পরিচর্যা করছিলেন। প্রেসসচিব তাজুল ইসলাম হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে এলেন। বঙ্গবন্ধু তখন হরিণকে খাওয়াতে যাচ্ছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। ক্যামেরা হাতে কাঁপছিলাম। আমি দূর থেকে তাজুল ইসলামকে সালাম দিলাম। তিনি আমাকে চিনতেন। বঙ্গবন্ধু যখন হরিণকে খাবার দিচ্ছিলেন সেই ছবি আমি তুলেছি। কিন্তু, কোনো কথা হয়নি।
এর আগে ১৯৭২ সালের ৬ জুন। ছয় দফা আন্দোলনের ৬ষ্ঠ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠান। প্রধান অতিথি বঙ্গবন্ধু। আমি ঢাকা ক্লাবের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখি বঙ্গবন্ধুর গাড়ি আস্তে আস্তে যাচ্ছে। তার গাড়ির সামনে পুলিশের একটা গাড়ি। আর পেছনে পুলিশ। রাস্তায় অগণিত মানুষ। ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউটের আগে বড় তোরণ বানানো হয়েছিল। সেখানে এসে গাড়িটি যখন বাঁক নেয় তখন আমি দূর থেকে দেখলাম বঙ্গবন্ধুর বাম পাশে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান। গাড়িচালকের পাশে একজন নিরাপত্তা কর্মী। আমি আনন্দে ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘বঙ্গবন্ধু’ বলে ক্যামেরা হাতে দৌড়ে গাড়ির কাছে গেলাম। নেতাকর্মীরাও সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এমন সময় আমি দেখি গাড়ির ভেতর থেকে বঙ্গবন্ধু হাত নাড়ছেন। গাড়ির কাঁচ নামালেন বঙ্গবন্ধু। গাড়ির অন্যান্য কাঁচ বন্ধ আর একটা কাঁচ খোলা। আমি বলছিলাম, ‘বঙ্গবন্ধু, এইভাবে... এইভাবে’। আমি হাত উঁচু করে তাঁকে বলছিলাম, ‘আপনি এইভাবে হাত নাড়ান’। তখন আমার বয়স ২০ বছর। প্রোটোকল কী জিনিস আমি বুঝি না। বঙ্গবন্ধু তখন ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে হাত নাড়ালেন।
এই প্রদর্শনীতে বঙ্গবন্ধুর কতগুলো ছবি থাকবে?
প্রদর্শনীতে বঙ্গবন্ধুর ২৩টা ছবি থাকবে। গ্যালারিটা ছোট, এর চেয়ে বেশি ছবি রাখার জায়গা হয়নি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার কথা যখন শুনলেন তখন আপনি কোথায় ছিলেন? সেই সময়ের ঘটনা একটু বলেন।
সেই সময় আমি ঢাকায় ছিলাম। দুঃসংবাদ শোনার পর প্রথমে গেলাম মুক্তিযোদ্ধা ও প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দীন ভাইয়ের বাসায়। আমরা বিবিসিতে এই সংবাদ শুনেছিলাম। তারপর ধানমন্ডির দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু, কলাবাগান পর্যন্ত যেতে পেরেছিলাম। সেখানে কালো পোশাক পড়া লোকজন দেখেছিলাম। দুইটা ট্যাংক একসঙ্গে মিরপুর রোড দিয়ে নিউমার্কেটের দিকে যেতে দেখলাম। কলাবাগান থেকে আমি কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে শাহবাগে গেলাম।
কলাবাগান থেকে শাহবাগ পর্যন্ত ঢাকার চিত্র কেমন ছিল?
ঐ দিনের পরিবেশ ছিল থমথমে। রাস্তা ফাঁকা ছিল। গলি থেকে মানুষ উঁকি দিয়ে দেখছিল। শাহবাগ রেডিও অফিসের সামনে এসে দেখলাম হাজার হাজার মানুষ। সেখানে ট্যাংক ছিল। দেখলাম সেখানে লোক বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছে। তাদের কয়েকজনকে আমি চিনতাম। তাদের পরিবারের অনেকেই মুসলিম লিগ, জামায়াতে ইসলামী করতো। সেখানে আমার পরিচিত আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের কাউকে দেখিনি।
এত বছর পর আপনি বঙ্গবন্ধুর ছবিগুলো নিয়ে প্রদর্শনী করছেন। বিশেষ করে, বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবর্ষ বা মুজিববর্ষ উপলক্ষে। এর তাৎপর্য কী?
মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও মহিমান্বিত হয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে পটপরিবর্তন হয়েছে। অনেক বাঁক এসেছে, সামরিক শাসন এসেছে। বঙ্গবন্ধু এখন আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়েছেন। মানুষ বলছে— বঙ্গবন্ধু আমাদের প্রধানতম নেতা।
আমি এতো রাজনীতিকের ছবি তুলেছি, বাংলাদেশকে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের ছবি তুলেছি। সামরিক নেতাদেরও ছবি তুলেছি। আমার কাছে বঙ্গবন্ধু ও মাওলানা ভাসানীর ছবি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
আমি যেহেতু ইমেজ মেকার, ক্যামেরার মধ্য দিয়ে দেখি, আমার হাইপোথেটিক্যাল স্ট্যাডি হলো— বঙ্গবন্ধু প্রকৃত বাঙালি, প্রকৃত মাটির মানুষ, এই দেশের জনগণের, রাজনীতির তিনি প্রধানতম কাণ্ডারি।
Comments