ত্বকী হত্যা মামলা: র‌্যাবের প্রতিবেদন জমার ‘যে কোনো দিন’ শেষ হয় না

ত্বকীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর একদিন আগে ২০১৪ সালের ৫ মার্চ র‌্যাবের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘ত্বকী হত্যায় আজমেরী ওসমানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। যে কোনো দিন এই মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।’
Taqi
তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। ছবি: সংগৃহীত

ত্বকীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর একদিন আগে ২০১৪ সালের ৫ মার্চ র‌্যাবের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘ত্বকী হত্যায় আজমেরী ওসমানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। যে কোনো দিন এই মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।’

তারপর... কেটে গেছে সাত বছর। কবে দেওয়া হবে প্রতিবেদন? এখনও বলতে পারছে না র‌্যাব।

আজ শুক্রবার (৬ মার্চ) নারায়ণগঞ্জের আলোচিত তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার সাত বছর পূর্তিতে তদন্তের অগ্রগতি বিষয়ে র‌্যাবের তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ত্বকীর বাবা দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন।

ত্বকী অপহরণ ও হত্যা

তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটি জেলা শাখার আহ্বায়ক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বির দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী।

ত্বকী শহরের চাষাঢ়ায় এবিসি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ছাত্র ছিলেন। নিখোঁজের একদিন পর ‘এ’ লেভেল পরীক্ষার ফলে পদার্থবিজ্ঞানে ৩০০ নম্বরের মধ্যে ২৯৭ পান, যা সারাদেশে সর্বোচ্চ। এছাড়া ‘ও’ লেভেল পরীক্ষাতেও পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়নে দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন।

২০১৩ সালের ৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু সড়ক থেকে ত্বকীকে অপহরণ করা হয়। ওই রাতেই ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি এবং র‌্যাব-১১ এর কার্যালয়ে চিঠি দেন। দুই দিন পর ৮ মার্চ সকালে শীতলক্ষ্যা নদীর খালের পাড় থেকে পুলিশ ত্বকীর মরদেহ উদ্ধার করে।

সেদিন রাতে রফিউর রাব্বি বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় দণ্ডবিধি ৩০২/৩৪ ধারায় আসামি অজ্ঞাত উল্লেখ করে হত্যা মামলা করেন এবং ১৮ মার্চ জেলা পুলিশ সুপারের কাছে ত্বকী হত্যায় শামীম ওসমান ও তার ছেলে অয়ন ওসমানসহ আট জনের নাম উল্লেখ করে একটি অবগতিপত্র দেন।

তদন্তে মামলাটির আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ায় ২০১৩ সালের ২৮ মে উচ্চ-আদালতের নির্দেশে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র‌্যাব) ত্বকী হত্যা মামলার তদন্তভার গ্রহণ করে।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পরই তদন্ত বন্ধ: ত্বকীর বাবা

ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বীর দাবি, ‘তদন্ত প্রতিবেদন জমায় দেরি হওয়ার মূল কারণ র‍্যাবের তদন্ত বাকি রয়েছে এমন নয়। তারা তদন্ত কাজ শেষ করেছে এক বছর না যেতেই। ২০১৪ সালের ৫ মার্চ সংবাদ সম্মেলন করে তারা জানিয়েছে, ত্বকী হত্যার সব রহস্য তারা উদঘাটন করেছে। আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে ১১ জন হত্যা করেছে। কেন করেছে, কোথায় করেছে, কখন করেছে, কীভাবে করেছে সবই তারা সংবাদ কর্মীদের জানিয়েছে এবং একটি খসড়া অভিযোগপত্র সরবরাহ করেছে। যা তারা আদালতে জমা দেবে। কিন্তু সেই সংবাদ সম্মেলনের পর ৬ বছর শেষ হয়েছে। সেই অভিযোগপত্র তারা আদালতে দাখিল করেনি।’

তিনি বলেন, ‘এটি না দেওয়ার কারণ হচ্ছে, সংবাদ সম্মেলনের প্রায় ৩ মাস পরই ২০১৪ সালের ৩ জুন প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে যখন বললেন, ‘আমি ওসমান পরিবারের পাশে আছি, থাকব।’ এরপর থেকেই তদন্ত বন্ধ হয়ে আছে। মামলার সমস্ত কাজ বন্ধ হয়ে আছে। যেজন্য তারা তদন্ত চলছে বলে সময় নেয় এবং বোঝাতে চায় আমরা এটা নিয়ে আছি একটা সময় আদালতে জমা দেব।’

আজমেরী ওসমান নারায়ণগঞ্জের প্রয়াত এমপি নাসিম ওসমানের ছেলে এবং আওয়ামী লীগ নেতা সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ও জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের ভাতিজা।

খুব শিগগির তদন্ত কাজ শেষ হবে: র‌্যাব

র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘তদন্ত যথার্থ অগ্রগতির পর্যায়ে আছে। আমি এখানে নতুন যোগ দিয়েছি। অনেক বার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছেন। যে তারণে তদন্ত কাজ বিলম্ব হয়েছে। আমি যোগদানের পর আবারও নতুন করে কাজ শুরু করেছি।’

তিনি বলেন, ‘কবে তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়া হবে এ মুহূর্তে বলতে পারছি না। আমি তদন্ত কর্মকর্তাকে দ্রুত প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছি। আমার মনে হয় খুব বেশি দেরি হবে না। খুব শিগগির তদন্ত কাজ শেষ হয়ে যাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘অভিযুক্ত অনেকে রয়েছেন। যাদের মধ্যে অনেকেই পলাতক। তাছাড়া যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা কতটুকু আছে এ ব্যাপারগুলো বার বার খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এজন্যই তদন্তে দেরি হচ্ছে।’

র‌্যাব সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিল আজমেরী ওসমানের নির্দেশে ১১ জন ত্বকীকে হত্যা করে? আপনারা কি তাদের বিষয়ে নতুন করে তদন্ত করছেন?

তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছুই বলতে পারছি না। কারণ তখন আমি ছিলাম না। চলমান যে প্রক্রিয়া আছে আমরা সেটাই অব্যাহত রাখছি। আসামিদের ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে। এটা চলমান থাকবে।’

তার মতে, ‘আমাদের ওপর কোনো চাপ নেই। আমরা আইনগত প্রক্রিয়ায় তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে।’

আইনজীবীর বক্তব্য

ত্বকী হত্যা মামলায় বাদীর আইনজীবী প্রদীপ ঘোষ বাবু দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা গত ২০ জানুয়ারি আদালতে একটি আবেদন করেছিলাম, ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে যাদের নাম এসেছে তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার এবং অভিযোগপত্র দাখিলে তদন্তকারী কর্মকর্তা র‌্যাবকে নির্দেশ দেওয়ার জন্য। তখন আদালত তাগিদ দিয়েছিলেন। তবে কতদিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবেন এমন কোনো নির্দেশনা দেননি। আগামী ৯ মার্চ আসামিদের হাজির ও অভিযোগপত্র দাখিলের দিন ধার্য আছে।’

এবারও র‌্যাব যদি তদন্ত প্রতিবেদন না দেয়?

‘আমরা বিগত ৬ বছর ধরে ৬টি দরখাস্ত দিয়েছি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য। আদালত তাগিদ দেয় শুধু। তাই আদালতে দরখাস্ত দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো কিছুই করার নেই।’ জানান তিনি।

বিচার না হলে, এমন হত্যাকাণ্ড আরও হবে: আইভী

ত্বকী হত্যার বিচার দাবিতে সোচ্চার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ত্বকী হত্যার বিচার হওয়া জরুরি। বিচারের সংস্কৃতি যদি নারায়ণগঞ্জে চালু না হয় তাহলে এরকম হত্যাকাণ্ড ঘটতে থাকবে। সেটি আমাদের কারোরই কাম্য নয়। সম্প্রতি অনেক আলোচিত হত্যা মামলার বিচার হয়েছে। আমরা আশা করি সরকার ত্বকী হত্যাকারীদের বিচার করবে এবং যারা প্রকৃত অপরাধী তাদের গ্রেপ্তার করে শাস্তি নিশ্চিত করবে।

বিচার ব্যবস্থার এমন দুর্গতি আশা করিনি: ত্বকী মঞ্চ

সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের সদস্য সচিব হালিম আজাদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সাত বছরেও একটি হত্যা মামলার বিচার করা যায় না, বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার এমন দুর্গতি আমরা কামনা করিনি। ত্বকীকে হত্যা করার পরে এ সাত বছরে আমরা বহুবার দ্রুত বিচার দাবি জানিয়ে এসেছি। আমরা মনে করি, এমন হত্যা মামলার তদন্ত কাজ এবং তদন্ত প্রতিবেদন আটকে রেখে বিচার আটকে রাখা সু-বিচারের লক্ষণ নয়। আমরা এখনও বিশ্বাস করি ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আহ্বান জানাই তদন্ত শেষ করে দ্রুত প্রতিবেদন দাখিল করতে।

সামাজিক সংগঠনের বক্তব্য

সামাজিক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী’ এর সভাপতি নূর উদ্দিন বলেন, ‘র‌্যাব একটি খসড়া প্রকাশ করেছিল ত্বকী হত্যায় কারা জড়িত, সে হিসেবে ত্বকী হত্যার মূল আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার অনেকে পালিয়ে গেছে। তাই প্রশাসনের কাছে জোর দাবি তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হোক।’

তিনি বলেন, ‘সাত বছরেও ত্বকী হত্যার বিচার হবে না সেটা আইনের শাসনের পরিপন্থি। বিচার পাওয়ার অধিকার আমাদের সবার আছে। সবার বিচার হয় এটা হচ্ছে না তার মানে এখানে কারো কালো হাত রয়েছে যাতে বিচার না হয়। যাতে একদিন আমরা ভুলে যাই। কিন্তু ত্বকী হত্যার বিচার হতে হবে। তারা যত ক্ষমতাবান হোক আজকে বিচার আটকে রাখলেও একদিন বিচার ঠিকই হবে।’

নূরউদ্দিন আরও বলেন, অপরাধী ঘুরে বেড়াবে আর ভুক্তভোগী বিচার পাবে না এ সংস্কৃতি হলে নগরবাসী তথা নগরের বাইরে যারা আছে আমরা সবাই শঙ্কিত। কারণ আমার সন্তানেরও ক্ষতি হতে পারে তখন আমিও বিচার পাবো না।’

চার দিনের কর্মসূচি

ত্বকী হত্যার সাত বছর পূর্তিতে ৬, ৭, ৮ ও ১৩ মার্চ নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।

সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ৬ মার্চ শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টায় ত্বকীর কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ, ফাতেহা পাঠ ও মিলাদ মাহফিল, বিকাল ৩টায় শেখ রাসেল পার্কে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, শিশু সমাবেশ, আলোচনা ও পুরস্কার বিতরণ করা হবে। ৭ মার্চ সকাল ১০টায় ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘ত্বকী হত্যা ও বিচারহীনতার সাত বছর’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক। ৮ মার্চ বিকাল সাড়ে ৫টায় শীতলক্ষ্যা নদীর ৫নং খেয়াঘাটে নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে ‘আলোর-ভাসান’ এবং ১৩ মার্চ বিকাল ৩টায় আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও মিলনায়তনের সামনে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।

Comments

The Daily Star  | English

The story of Gaza genocide survivor in Bangladesh

In this exclusive interview with The Daily Star, Kamel provides a painful firsthand account of 170 days of carnage.

1d ago