একজন নীলিমা দাস

Neelima_Das_8Mar2020
নীলিমা দাস। ছবি: স্টার

নীলিমা দাসের জীবনের গল্প যেন কোনো চলচ্চিত্রের কাহিনী। সেই গল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে তার চলার পথ বাঁক নিয়ে অকারণ দীর্ঘ হয়ে গেছে। যাকে ভাগ্য বলে ধরে নেওয়াই স্বস্তিকর। সেই সঙ্গে ছায়ার মতো সঙ্গী হয়ে ছিল নানা সমস্যা। নীলিমার বয়স যখন ছয় মাস, তখন তার মায়ের মৃত্যু হয়। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় ইচ্ছার বিরুদ্ধে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। ১৯৯৮ সালে বাবাকেও হারান।

নীলিমার স্বামীর নাম পরান রবি দাস। পরানের বয়স যখন আট বছর, তখন তিনি বাবাকে হারান। পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় সব দায়িত্ব তিনিই পালন করেন। সেই দায়িত্ব যতটা ছিল পরানের—ততটাই ছিল নীলিমার।

এই দম্পতির ঘরে প্রথম সন্তান আসে ১৯৯৩ সালে। নাম রাখা হয় বিপ্লব দাস বাপ্পী। দ্বিতীয় সন্তান পল্লব দাস নিলয়ের জন্ম হয় ১৯৯৯ সালে। ২০০৪ সালে তৃতীয় সন্তান প্রান্ত দাস প্রেম ও ২০০৭ সালে মেয়ে মৌ দাসের জন্ম হয়।

পরান রবি দাস পেশায় চর্মকার। দুজনের স্বল্প আয়ে চলে সংসার। তবে নীলিমার মতে, সন্তান তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৪ সালে এসএসসি, ২০০৯ সালে এইচএসসি, ২০১৩ সালে স্নাতক ও ২০১৮ সালে খোন্দকার নুরুল হোসেন ল’ কলেজ থেকে তিনি এলএলবি পাস করেন।

সন্তানদের পড়ালেখার বিষয়েও সমান মনোযোগী তারা। ২০১৬ সালে আর্থিক অনটনে বাপ্পীর স্নাতক পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। তবে হাল ছাড়েননি তারা। এবার পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বাপ্পী। নিলয় মানিকগঞ্জ টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ৬ষ্ঠ সিমেস্টারে পড়ছেন। প্রান্ত দাস প্রেম ও মৌ দাস খান বাহাদুর আওলাদ হোসেন খান উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। প্রেম দশম শ্রেণিতে ও মৌ সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছিল মৌ।

Neelima_Das_Family_8Mar2020
নীলিমা ও পরান রবি দাসের পরিবার। ছবি: স্টার

বিয়ের পরেই স্কুলে ভর্তি হতে চেয়েছিলেন নীলিমা। তবে শাশুড়ির আপত্তির মুখে সেটা সম্ভব হয়নি। এক পর্যায়ে পরিবারের কাউকে না জানিয়ে তিনি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। টিউশনির টাকা দিয়ে চলতো তার লেখাপড়ার খরচ। এসএসসি পাস করার পরে পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি জানতে পারেন।

দুই বছর পরে ২০০৭ সালে বেসরকারি সংস্থা বারসিক-এ ২ হাজার ৫ শ টাকা বেতনে চাকরি পান নীলিমা। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়ানোর দায়িত্ব পড়ে তার ওপর। ভোরে ঘুম থেকে উঠে গৃহস্থালি কাজ সেরে সকাল ৯টায় তাকে পৌঁছাতে হতো স্কুলে। তিন ঘণ্টা পড়িয়ে বাড়ি ফিরে আবার সংসারের কাজ।

শহরের পশ্চিম দাশড়া এলাকায় মানিকগঞ্জ বাজার ঘেঁষে বয়ে যাওয়া খালের পাশে খাস জমিতে তাদের ঘর উচ্ছেদ করে দেয় তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। শহরে জুতা সেলাই করে পরান যা আয় করেন আর নীলিমার টাকায় আবারও ঘুরে দাঁড়ান তারা। ২০০৯ সালে তিনি সুপারভাইজার পদে পদোন্নতি পান। ২০১১ সালে সেই প্রকল্প শেষ হলে বারসিক নীলিমাকে কৃষি প্রকল্পের সহকারী কর্মসূচি কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেয়। এক বছর পর বেতন বেড়ে হয় ১০ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে প্রকল্পটি শেষ হয়ে যায়।

এরপর দুই মাস তিনি গণকল্যাণ ট্রাস্ট নামে একটি বেসরকারি সংস্থায় মাইক্রো ক্রেডিট কর্মসূচির মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করেন। তবে মেয়ের পিইসি ও ছেলের জেএসসি পরীক্ষা চলে আসায় চাকরি ছেড়ে দেন। এখন তিনি মানিকগঞ্জ শহরের একটি ক্লিনিকে কাজ করছেন। পাশাপাশি প্রতি রোববার মানিকগঞ্জ জেলা জজ কোর্টের জ্যেষ্ঠস্থানীয় আইনজীবী আব্দুর রশীদের কাছে শিক্ষানবীশ আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন।

নীলিমা দাস জানান, তিনি সেলাইয়ের কাজ শিখেছেন। নিজের ও পরিবারের সবার পোশাক তিনিই তৈরি করেন। তিনি বলেন, সমস্যা থাকবেই। সব বাধাকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে হবে।

বারসিকের আঞ্চলিক কর্মকর্তা বিমল রায় দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে নীলিমা এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি সমাজে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর একজন হয়ে নীলিমা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন, তা অন্যান্যদের জন্য অনুকরণীয়।

মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক এস এম ফেরদৌস বলেন, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে সফল নারী উদ্যোক্তাদের মধ্য থেকে প্রতিবছর জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ‘জয়ীতা’ পুরস্কার দেওয়া হয়। ২০১৮ সালে নীলিমা দাসকে আমরা ‘জয়ীতা’ নির্বাচিত করি।

Comments

The Daily Star  | English

What are we building after dismantling the AL regime?

Democracy does not seem to be our focus today. Because if it were, then shouldn’t we have been talking about elections more?

7h ago