নারীদের ৩৩ শতাংশ পদের শর্ত পূরণ করেনি রাজনৈতিক দলগুলো
বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী এবং অর্ধেক পুরুষ। সে হিসেবে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে নারী এবং পুরুষের সংখ্যা সমান থাকার কথা। কিন্তু, তা নেই। প্রত্যাশাও এত বেশি না। ২০০৮ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, চলতি বছরের মধ্যে দলের সর্বস্তরে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো রাজনৈতিক দল নিবন্ধিত হতে চায়, তবে নিম্নলিখিত শর্তগুলোর মধ্যে একটি পূরণ করবে— কেন্দ্রসহ সব পর্যায়ের কমিটিতে নারীদের জন্য কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ পদ সংরক্ষণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে এবং ধারাবাহিকভাবে ২০২০ সালের মধ্যে এই লক্ষ্য অর্জন করতে হবে।’
এই বিধানটি যোগ করার জন্য ২০০৮ সালে আইন সংশোধন করা হয়েছিল। ২০২০ সালের বাকি আছে নয় মাস। তবে, বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল এই লক্ষ্যমাত্রা এখনো পূরণ করতে পারেনি। দ্য ডেইলি স্টার দেশের ৪১টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৫টির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য পেয়েছে।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এখনো এই লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি। দলটির সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৭৪ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে মোট নারী আছেন ১৯ জন। যার অর্থ মাত্র ২৬ শতাংশ নারী আছেন দলটির কেন্দ্রীয় কমিটিতে। কমিটির সাতটি পদ এখনো খালি।
এই লক্ষ্য পূরণে বিএনপির খুব অল্প প্রচেষ্টা চোখে পরে। দলটির উপদেষ্টা পরিষদের ৭৩ জন সদস্যের মাত্র আট জন নারী। যা মাত্র ১১ শতাংশ।
এই সংবাদদাতা বারবার চেষ্টা করার পরও গতকাল রাত পর্যন্ত সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির নেতাদের কাছ থেকে সঠিক সংখ্যার বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেননি।
জাতীয় পার্টির (মঞ্জু) ১০১ সদস্যের কোর কমিটিতে ১৬ জন নারী আছেন বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব শেখ শহিদুল ইসলাম। অর্থাৎ, কমিটিতে নারী আছেন ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিও কোনো ইতিবাচক পরিসংখ্যান দিতে পারেনি। দলটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘পলিটব্যুরোর ১৫ সদস্যের মধ্যে একজন এবং কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৯০ জন সদস্যের মধ্যে ১০ জন নারী আছেন।’
লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ১৪৮ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৩৩ জন নারী আছেন বলে জানিয়েছেন পার্টিপ্রধান অলি আহমদ। সে হিসাবে কমিটিতে নারী আছেন ২২ শতাংশ।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক জানিয়েছেন যে, তাদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৪৯ জনের মধ্যে আট জন নারী রয়েছেন।
বাংলাদেশ মুসলিম লীগের সেক্রেটারি জেনারেল কাজী আবুল খায়ের জানিয়েছেন, তাদের ১০১ জনের শক্তিশালী কেন্দ্রীয় কমিটিতে মাত্র ১২ জন নারী আছেন।
প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলের ২৫১ জনের কেন্দ্রীয় কমিটির ৩৩ জন নারী সদস্য বলে জানিয়েছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক এম এ হোসাইন।
বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মহাসচিব এম এ মতিন বলেছেন, তাদের ৬১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিন জন নারী রয়েছেন।
দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে কেবল মাত্র পাঁচটি দল দাবি করেছে তাদের প্রতিটি কেন্দ্রীয় কমিটির ৩৩ শতাংশই নারী। তাদের মধ্যে আছে গণফ্রন্ট। দলটির চেয়ারম্যান মো. জাকির হোসেন বলেছেন, দলের ৫১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ১৭ জন নারী।
জাকের পার্টির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এজাজুর রসুল দাবি করেছেন, তাদের কেন্দ্রীয় কমিটি ৩৩ শতাংশ নারী নিয়ে গঠিত। তবে ঠিক কতজন নারী আছেন দলে তা জানা যায়নি।
ইসলামী রাজনৈতিক দল খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমেদ আবদুল কাদের বলেছেন, ‘আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৬২ জন পুরুষ ও ৩১ জন নারী আছেন।’
যদিও দলীয় কার্যক্রমে নারীদের খুব কমই দেখা যায়। ২০১৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত দলটির সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ছবি দেখা যায় খেলাফত মজলিসের ওয়েবসাইটে। যে কেউ লক্ষ্য করে থাকবেন, সেখানে মঞ্চে ও নিচে বসে থাকা সবাই পুরুষ, কোনো নারী নেই।
জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধান বলেন, আমাদের দলের কোর কমিটির ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশই নারী। ৮২ সদস্যের মধ্যে ৩০ জনই নারী।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাড়া আর মাত্র দুটি দলের প্রধান নারী। একটি জাগপা ও অন্যটি বাংলাদেশ মুসলিম লীগ। বাংলাদেশ মুসলিম লীগের নেতৃত্বে রয়েছেন বেগম জোবাইদা কাদের চৌধুরী।
নেতাদের প্রতিক্রিয়া
কমিটিগুলোতে নারীদের কম অংশগ্রহণ সম্পর্কে জানতে চাইলে কেউ কেউ বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে দায়ী করেন, কেউ আবার বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার দিকে আঙুল তোলেন। কেউ কেউ দল শুরু করার ক্ষেত্রে নারীদের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন করেন।
এলডিপি প্রধান অলি আহমদ বলেন, ‘প্রচলিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং তারা (নারী) প্রতিদিন জীবনে নানা সমস্যার মুখোমুখি হয়ে আর রাজনীতিতে যোগ দিতে আগ্রহী হন না। তাদের অনেকের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে এক ধরনের বিদ্বেষ তৈরি হয়েছে। তারা মনে করেন, তাদের বলার কিছুই নেই।’
বাংলাদেশ সাম্যবাদী দলের মূল কমিটিতে কোনো নারী সদস্য নেই। দলের প্রধান দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ‘শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান নারীরা রাজনীতিতে আসতে চান না।’
বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট এবং প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল তাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে নারীদের অর্ন্তভুক্ত করার ধারণাটি পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক এমএ হোসাইন এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা যদি কমিটিতে এত বেশি নারী আনি তাহলে দল আর চলবে না।’
বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মহাসচিব এমএ মতিন বলেন, ‘নারীরা নিজেরাই এটা চায় না। তারা নিজেদের মধ্যেই থাকতে চায়, যেভাবে পুরুষরাও নিজেদের মধ্যে থাকতে চায়। আমরা নির্বাচন কমিশনকে এই বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার প্রস্তাব দিয়েছি।’
রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের নির্বাহী পরিচালক মেঘনা গুহঠাকুরতা বলেন, ‘বেশিরভাগ পুরুষ মনে করেন, নারীরা নিজের জন্য পৃথক ইউনিট চান। নারীরা তা বলেন না। তাদেরকে দলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সুযোগ দেওয়া উচিত।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘আমরা দলের প্রাথমিক সদস্য হিসেবে আরও নারী আনতে পারছি না। গার্মেন্টস ও কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় অনেক নারী আছেন। কিন্তু আমরা মূল ধারার রাজনীতিতে মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে নারীদের বের করে আনতে পারছি না।’
ওয়ার্কার্স পার্টির বাংলাদেশ সম্পর্কে রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসার জন্য নারীদের বেশ কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করতে হয়।’
মেঘনা গুহঠাকুরতা বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীদের একটা নির্দিষ্ট ধাপ পর্যন্ত উঠতে দেয়, তার বেশি না। নারীরা রাজনীতির অংশ হতে চান। উদাহরণ হিসেবে দেখতে পারেন ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে নারীরা বেশ এগিয়েছে। তারা এখন উপজেলা পর্যায়ে তাদের মধ্যে কাউকে পাঠাতে চান। এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা খুবই ভালো।’
কয়েকটি দলের অভিমত, গৃহস্থালি দায়িত্ব পালনের কারণে তাদের দলে পর্যাপ্ত নারী নেই। গণ ফোরামের আজাদ হোসেন বলেন, ‘বিবাহিত নারীরা তাদের স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির কাজেই সময় ব্যয় করেন।’
২০১৭ সালের জুনে নির্বাচন কমিশন ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে চিঠি পাঠায়। এর জবাবে আওয়ামী লীগ জানিয়েছে, ২০২০ সালের মধ্যে তারা এই শর্ত পূরণ করতে সক্ষম হবে। বিএনপি জানায়, তারা আশা করেছে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে।
যোগাযোগ করা হলে নির্বাচন কমিশনের উপসচিব আবদুল হালিম খান বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর কেন্দ্রীয় ও অন্যান্য কমিটিতে কতজন নারী আছেন সে বিষয়ে কমিশনের কাছে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তিনি বলেন, ‘আমরা শিগগির নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলের কাছে অগ্রগতির তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠাব।’
সূত্র জানায়, ৩৩ শতাংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার সময়সীমা ২০২০ সালই থাকছে। এই সময়সীমা বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নির্বাচন কমিশনের নেই।
কোনো রাজনৈতিক দল যদি এই শর্ত পূরণ করতে না পারে তাহলে কী হবে— এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুল হালিম খান বলেন, ‘আরও তো প্রায় এক বছর হাতে আছে, দেখা যাক কী হয়।’
Comments