রংপুর: ইতিহাসকে কাছ থেকে দেখা
যমুনা সেতু পার হওয়ার পর থেকে যে পথটি রংপুরের দিকে চলে গেছে, সেই পথে যেতে যেতে দু’পাশে যেদিকেই চোখ যায় শুধু দিগন্ত প্রসারিত ক্ষেত। কাঁচাপাকা ধান ক্ষেত, পাট ক্ষেত, হলুদ সরিষা ক্ষেত, সোনালি ভুট্টা ও আখ ক্ষেত। কিছু দূর পরপর চোখে পড়বে ছোট ছোট গ্রাম, সুপারি-নারকেল বীথির সারি ও ছোটখাট নদীনালা। চমৎকার রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে অল্প সময়েই আপনি পৌঁছে যেতে পারেন উত্তরাঞ্চলের ইতিহাস সমৃদ্ধ জেলা রংপুরে।
ছিমছাম সুন্দর একটি জনপদ এই রংপুর। এর পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে তিস্তা নদী। এই রংপুরের খুব পুরোনো ইতিহাস আছে। শোনা যায় ১৫৭৫ সালে সম্রাট আকবরের সেনাপতি রাজা মানসিংহ রংপুর দখল করলেও ১৬৮৬ সাল পর্যন্ত এটি মুঘল সাম্রাজ্যের সঙ্গে পুরোটা একীভূত হয়ে যায়নি। তবে ১৬৮৭ সালে এই এলাকার ঘোড়াঘাটে মুঘলদের একটি প্রশাসনিক দপ্তর ছিল। এরপর আছে আরও অনেক ইতিহাস, অনেক গল্প। তবে ২০১০ সালে এসে রংপুর বিভাগ হয় আটটি জেলা নিয়ে।
রংপুর এলাকার জমিতে খুব ভাল নীল চাষ হতো। স্থানীয় লোকেরা নীলকে বলতো রঙ্গ। এই ’রঙ্গ’ থেকেই রঙ্গপুর বা রংপুর নামের উৎপত্তি। ব্রিটিশ শাসকরা এই এলাকায় এসে জোর করে চাষিদের দিয়ে নীল চাষ করাতো। ইতিহাসের স্মৃতি বহন করে এখনো সেখানে নীলকুঠির চিহ্ন রয়ে গেছে। খুব সম্প্রতি নতুন করে বাণিজ্যিকভাবে নীলচাষ শুরু হয়েছে।
রংপুরে বেড়াতে গিয়ে আপনি একদিকে দেখতে পারছেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অন্যদিকে রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন। যারা ইতিহাস ভালোবাসেন, তাদের জন্য দেখার আছে অনেক কিছু। শহরে ঘুরতে বেড়িয়ে দেখতে পারেন রংপুর কারমাইকেল কলেজ। দেশের সবচেয়ে প্রাচীন কলেজগুলোর মধ্যে কারমাইকেল কলেজ একটি। কলেজটি ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মূল ভবনটির যে নির্মাণশৈলী তা এর ঐতিহাসিক পরিচয় বহন করে। বিশাল এই কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকলে সবুজের সমারোহ দেখে চোখ জুড়িয়ে যাবে।
১৭৬৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর রংপুরকে জেলা সদর ঘোষণা করা হয়েছিল এবং ১৮৬৯ সালে একে মিউনিসিপালিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। দেশের অন্যতম পুরোনো মিউনিসিপালিটি এটি। ১৮৯২ সালে রাজা জানকী বল্লভ সেনের তত্ত্বাবধানে এই মিউনিসিপালিটি ভবনটি তৈরি হয়েছিল। ১৮৯০ সালে রংপুর শহরের উন্নয়নকল্পে তিনিই মাতা শ্যামা সুন্দরীর খালটি খনন করিয়েছিলেন। কথিত আছে, পীড়ার আকরভূমি ছিল এই রঙ্গপুর। প্রণালী কেটে তা দূর করার আদেশ দিয়েছিলেন মাতা শ্যামা সুন্দরী। এই খালটি এখনো আছে, তবে তা নামমাত্র।
রংপুরে পৌঁছে আপনি দেখতে যেতে পারেন তাজহাটের মহারাজার বাড়ি। তাজহাটের মহারাজার বাড়ি শহর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে। এখানে রাজার যে বাড়ি, সেটি মনে হয় ৪/৫ তলা সমান উঁচু। এর গঠনশৈলী অনেকটাই মুঘল স্থাপত্যরীতির সঙ্গে মিলে যায়। রাজবাড়ির পাশে বিশাল মাঠ, গাছের সারি ও পুকুর আছে। এর দোতলায় আছে রংপুর মিউজিয়াম। এখানে আছে দশম ও একাদশ শতাব্দীর টেরাকোটার শিল্পকর্ম, সংস্কৃত ও আরবি ভাষায় লেখা বেশকিছু প্রাচীন পাণ্ডুলিপি। আছে সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ের কুরআন, মহাভারত-রামায়ণ ও বিষ্ণু মূর্তি।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মহারাজা কুমার গোপাল লাল রায় ১০ বছর ধরে এটি তৈরি করেন। কুমার গোপাল রায় একজন স্বর্ণকার ছিলেন। তার সময়ে নির্মিত একটি অসাধারণ তাজ বা মুকুটের কারণেই এই এলাকার নাম তাজহাট হয়েছিল। শোনা যায় এই রাজবাড়ির ভেতরে নাকি একটি গুপ্ত পথ আছে ঘাঘট নদী পর্যন্ত। তবে এই পথ এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
বাংলার নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্মভূমি এই রংপুর। শহর থেকে কিছুটা দূরে পায়রাবন্দ গ্রামের সাবের পরিবারে বেগম রোকেয়া জন্মেছিলেন। বেগম রোকেয়ার বাড়ির কিছুটা ভাঙা অংশ এখনো তাঁর স্মৃতি বহন করে চলেছে। তাছাড়া, সরকার এখানে মেয়েদের জন্য ট্রেনিং সেন্টার খুলেছে। আছে বড় একটি অডিটোরিয়াম। এই মহীয়সী নারীর নামে রংপুরে স্থাপিত হয়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়।
শহরের ভেতরেই আছে ‘জাদু নিবাস’। রাজনীতিবিদ মশিউর রহমান যাদু মিয়ার বাসাটি প্রায় ১৫০ বছরেরও বেশি সময় আগে রাজা গোপাল রায় বাহাদুর তৈরি করেছিলেন। রংপুর টাউন হল ভবন, পুরোনো জজকোর্ট ভবনটিও একই সময়ে তৈরি।
শহরের ভিতরেই আছে রংপুর চিড়িয়াখানা। এটি ১৮৮০ সালে স্থাপিত হলেও অনেক পরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এর ডিজাইন শেষ করেছে। রংপুর শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে আছে ভিন্নজগৎ। এখানে বাচ্চাদের জন্য অনেককিছু আছে মজার মজার। এখানকার বিরাট লেক, সবুজ বনবনানীতে কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে একটি দিন।
দেখতে যেতে পারেন পীরগাছার মন্থানা সাম্রাজ্য। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১১০০ সালের দিকে। শেষের দিকে এসে মহারাণী জয় দুর্গা দেবী চৌধুরানী ছিলেন অন্যতম প্রভাবশালী শাসক। রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর মৃত্যুর পর মন্থানা সাম্রাজ্য দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এই রাজবাড়িকে সবাই ‘মন্থনা প্রাসাদ’ বা ‘মন্থনা রাজবাড়ি’ বলে চেনে। ১০০ একর জমি, ভেঙে যাওয়া রাজপ্রাসাদ, পুকুর, মন্দির আছে। রাজকুমারী কবিতা রাণী রায় চৌধুরী পুরো সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী। কাচারি ঘরটা বর্তমানে পীরগাছা রেজিস্টার অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
কেলাবন্দ মসজিদটি দাঁড়িয়ে আছে রংপুর-দিনাজপুর হাইওয়েতে। প্রায় ২০০ বছর আগে তৈরি তিনগম্বুজ মসজিদ এটি। অনেক পুরোনো একটি কবরস্থান রয়েছে এই মসজিদের পেছনে।
এই রংপুরে এসেই আপনি দেখতে যেতে পাবেন ইতিহাসখ্যাত দেবী চৌধুরানীর প্রাসাদ। বঙ্কিমচন্দ্র ব্রিটিশ রাজের আমলে রংপুরের কালেক্টর হিসেবে কাজ করতেন। এখানে কাজ করার সময়েই তিনি তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘দেবী চৌধুরানী’ লিখেছেন। মন্থনা এস্টেটের রাজা রাঘবেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী ১৭৬৫ সালে মারা যাওয়ার পর তার স্ত্রী মহারাণী জয় দুর্গা দেবী চৌধুরানী তিন দশক ধরে এই রাজ্যটা রক্ষা করেন। তিনি খুব সফল ও জনপ্রিয় শাসক ছিলেন। ব্রিটিশরা মহারাণীর কাছ থেকে রাজত্ব নিয়ে নিলেও সেটা আটকে রাখতে পারেনি। অবশ্য সেই প্রাসাদের অনেকটাই ভূমিকম্পে ধ্বসে গেছে।
ডাকাত সর্দার, গরিবের বন্ধু ও ইংরেজ বাহিনীর শত্রু ভবানী পাঠকের সঙ্গে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করেছেন দেবী চৌধুরানী। তিনি ভবানী পাঠকের সঙ্গে সন্ন্যাসী বিদ্রোহেও অংশ নিয়েছিলেন। এরও বহু বছর পর ১৯৪৬ সালে এই রংপুর থেকেই শুরু হয়েছিল ব্রিটিশবিরোধী তেভাগা আন্দোলন।
ইটাকুমারি ও দেওয়ানবাড়ি জমিদার বাড়ি এখনো কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। উনিশ ও আঠারো শতকের এই দুটি জমিদার বাড়ির আর কিছুই অবশিষ্ট নাই। ইটাকুমারির জমিদার বাড়িতে আছে একটি বড় পুকুর, আর খুব পুরোনো একটি ভবন। দেওয়ানবাড়ি জমিদার বাড়িতে দেখার মতো আছে এই বাড়ির প্রবেশ দ্বার, যা মুঘল রীতিতে তৈরি করা হয়েছিল।
এই রংপুর থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম বাংলা পত্রিকা ‘রঙ্গপুর বার্তাবহ’, ১৮৪৭ সালে। পরগণা কুন্ডির জমিদার কালীচন্দ্র রায়ের আর্থিক সহায়তায় এই সাপ্তাহিক পত্রিকাটি বের করেছিলেন গুরুচরণ শর্মা রায়। উনিই ছিলেন প্রথম সম্পাদক।
মহতী পুরুষ রাজা রামমোহন রায় ১৮০৯ সাল থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত রংপুরে অবস্থান করেছিলেন। রংপুরে তার এই অবস্থানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এখানে আছে রাজা রামমোহন ক্লাব। একবার ঘুরে আসতে পারেন সেই ক্লাব চত্বর।
ইতিহাসের এসব জায়গা দেখতে দেখতে যখন আপনি ক্লান্ত হয়ে যাবেন, তখনই একবার ঘুরে আসতে পারেন তিস্তা ব্যারেজ এলাকায়। অপূর্ব সুন্দর তিস্তা নদী, তার পাড় ঘেঁষে পায়ে চলার পথ। গাড়ি একটা পয়েন্টে রেখে ঘুরে দেখতে পারেন এলাকাটি। বিকালে ছোট একটা বাজারও বসে তিস্তার পাড়ে।
ঢাকা থেকে রংপুর আপনি বাসে, ট্রেনে বা প্লেনে যেতে পারেন। খুব ভাল লাক্সারি বাস আছে। রংপুর বেড়াতে যাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময় সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল। এ সময়টাতে বেড়ানোর জন্য সঙ্গে শীতের কাপড় রাখবেন। থাকার জন্য ভালো ভালো বেশ কয়েকটা হোটেল আছে, আছে পর্যটন মোটেল, সার্কিট হাউজ ও আরডিআরএসের রিসোর্ট।
শাহানা হুদা: যোগাযোগকর্মী
Comments