স্কুলে শিক্ষার্থীরা কতটা নিরাপদ?
করোনাভাইরাস নিয়ে গোটা দেশ উদ্বিগ্ন হওয়া সত্ত্বেও এটির সংক্রমণ ঠেকাতে যথাযথ প্রস্তুতির ঘাটতি রয়েছে রাজধানীর স্কুলগুলোতে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ১০টি স্কুলে গিয়েছেন দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদকরা। তারা দেখতে পান, হাত ধোয়ার অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা, শ্রেণিকক্ষগুলোতে ভিড় ও স্কুলগুলোর প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থীরা খেলছিল।
এ চিত্র রাজধানীর অন্যান্য স্কুলগুলো থেকে ভিন্ন নয়, এমনটিই বলছিলেন স্কুলগুলোর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে চিকিৎসকসহ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ— ঘন ঘন হাত ধোয়া, স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখা ও অন্যদের থেকে কমপক্ষে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখা।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্তত ১১৫টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। চলমান পরিস্থিতিতে গত ১১ মার্চ করোনাভাইরাসকে বিশ্বব্যাপী মহামারি ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তিন জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া, হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে অনেককেই।
স্কুলগুলোর কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত হ্যান্ডওয়াশ ও সাবান সরবরাহের চেষ্টা করছে। শিক্ষার্থীদের ঘন ঘন হাত ধোয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। একইসঙ্গে তাদের জনসমাগম এড়িয়ে চলার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।
অন্তত পাঁচটি স্কুলের কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের বলেছে, তাদের মধ্যে কারো ঠাণ্ডাজনিত লক্ষণ দেখা দিলে যাতে স্কুলে না আসে।
তবে, কোনো শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থী যদি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন, তাহলে এ পদক্ষেপগুলো যথেষ্ট নয় বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষকরা।
করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে গত ১০ মার্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের ঘন ঘন হাত ধুতে ও যেকোনো ধরনের ভিড় এড়িয়ে চলতে বলেছে।
শিক্ষকদের কয়েকজন বলছেন, এ ধরনের নির্দেশনা বাস্তবসম্মত নয়। তহবিল ঘাটতির কারণে স্কুলগুলোতে দিনব্যাপী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা সম্ভব না। তারা বলছেন, সরকারের উচিত শিগগিরই বিদ্যালয়গুলোর জন্য আলাদা তহবিল বরাদ্দ দেওয়া।
মোহাম্মদপুর কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, ‘প্রায় ৬০০ শিক্ষার্থীর জন্য হাত ধোয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা আমাদের পক্ষে সত্যিই কঠিন। এটি পর্যবেক্ষণ করবে কে? আমরা ১৮টি টয়লেটে সাবান রাখার দুই ঘণ্টার মধ্যেই সেগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে।’
এ বিষয়ে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘হাত ধোয়ার ব্যবস্থা না থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এ জন্যই বাবা-মার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আমরা সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘অ্যান্টিস্যাপটিক, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল হ্যান্ডওয়াশ ও সাবান কেনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো তহবিল বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।’
স্কুলগুলোতে হাত ধোয়ার জন্যে সাবান বা লিকুইড সোপ কিনতে সরকারের পক্ষ থেকে অর্থ দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) আমাদের এমন পরামর্শ দেয়নি। আমরা কেন এটি নিয়ে চিন্তা করবো?’
‘দেশে করোনা আক্রান্ত তিন জনের মধ্যে দুই জন সুস্থ হয়ে গেছেন’, উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে করোনা পরিস্থিতি এখনো মহামারি পর্যায়ে যায়নি।’
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে গিয়ে দেখা যায়, অনেক শিক্ষার্থীই মাস্ক পরে আছে। শ্রেণিকক্ষেই প্রাত্যহিক সমাবেশ করাচ্ছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। তবে অনেক স্থানেই স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অভাব দেখা গেছে। যেমন: প্রতিষ্ঠানটির প্রার্থনা কক্ষের পাশেই একটি টয়লেট রয়েছে, যেখানে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ব্যবস্থা বলতে প্লাস্টারবিহীন একটি দেয়ালে ঝুলছে পানির কল। দেয়ালটিতে শেওলা পড়ে আছে। শিক্ষার্থীদের ব্যবহারের টয়লেট ও বেসিনগুলো অস্বাস্থ্যকর ছিল এবং কোথাও কোনো সাবান ছিল না।
তবে, শিক্ষকদের টয়লেটগুলো ঠিক ছিল।
এক শিক্ষার্থী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছে, ‘স্কুল থেকে আমাদের কোনো সাবান দেওয়া হয়নি। আমি বাসা থেকে সাবান নিয়ে এসেছি। সেটিই বন্ধুদেরও ব্যবহার করতে দিচ্ছি।’
এ বিষয়ে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগমকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘টয়লেটে সাবান রাখলে তা ফ্লোরে পড়ে সেটি পিচ্ছিল হয়ে যাবে। এতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই আমরা সাবান রাখছি না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের তিনটি শাখায় ২৫ হাজারের মতো শিক্ষার্থী রয়েছে। সব সময় যাতে তাদের জন্য সাবান থাকে, এটি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে যখন বাজারে সাবান ও হ্যান্ডওয়াশের সংকট দেখা দিয়েছে।’
‘এ জন্য ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য আমরা শিক্ষার্থীদের বাসা থেকে সাবান নিয়ে আসতে বলেছি’, যোগ করেন তিনি।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের (ভিএনএসসি) এক শিক্ষার্থীর মা জাহান আরা বলেছেন, ‘আমার মেয়ে বলেছে, তার স্কুলের ওয়াশরুমে নিয়মিত সাবান সরবরাহ করা হয় না।’
জানতে চাইলে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ফাওজিয়া বলেন, ‘ব্যবহার বাড়ার কারণে সাবানগুলো দ্রুত শেষ হয়ে যায়। আমরা পর্যাপ্ত সাবান কিনেছি।’
এক প্রশ্নের জবাবে ফাওজিয়া বলেন, ‘করোনাভাইরাসের বিপর্যয়ের কারণে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমেছে।’
মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়েও গত কয়েকদিন শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার কম দেখা গেছে।
আফতাব আহমেদ নামে এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার মেয়েকে স্কুলে পাঠাচ্ছিলাম না। তবে গতকাল পরীক্ষা থাকায় সে গিয়েছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি মেয়েকে তার স্কুলব্যাগে একটি হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে দিয়েছি।’
মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজমুন নাহার শাহিন বলেন, ‘ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছেন শিক্ষকরা।’
বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ পাবলিক কলেজের শিক্ষকরা বলেছেন, কলেজে কোনো সমাবেশ, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে না। এ ছাড়া, শিক্ষার্থীদের কেউ অসুস্থ বোধ করলে কলেজে না আসার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।
তারা এও জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানটিতে হাত ধোয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই।
কলেজের অধ্যক্ষ লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাফেজ মো. জোনায়েদ আহমেদ বলেন, ‘কলেজটিতে দুটি শিফটে প্রায় আট হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। সারাদিন সব শিক্ষার্থীর হ্যান্ডওয়াশ ব্যবহার নিশ্চিত করা আমাদের পক্ষে কঠিন।’
‘যেদিন আমরা হাত ধোয়ার জন্য লিকুইড সাবান রাখা শুরু করেছিলাম, এক ঘণ্টার মধ্যেই সব শেষ হয়ে গিয়েছিল’, যোগ করেন তিনি।
‘স্কুল বন্ধ’
ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে কমপক্ষে ১০ জন শিক্ষক ও এক ডজন অভিভাবক বলেছেন, দেশে করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারের উচিত একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সব স্কুল বন্ধ করে দেওয়া।
মোহাম্মদপুর কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছি না যে কর্তৃপক্ষ কেন বিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দিচ্ছে না। ডব্লিউএইচও করোনাভাইরাসকে বিশ্বব্যাপী মহামারি ঘোষণা করেছে।’
‘অনেক অভিভাবক প্রতিদিন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে চাচ্ছেন, কেন আমরা সাধারণ সময়ের মতো অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চালাচ্ছি’, যোগ করেন তিনি।
বিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষক বলেন, ‘আমাদের বলা হয়েছে যে প্রত্যেকেরই অন্যের থেকে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখা উচিত। কিন্তু, আমাদের স্কুলের শ্রেণিকক্ষের একটি ছোট বেঞ্চে তিন শিক্ষার্থীকে বসতে হয়।’
পুরান ঢাকার সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক রোকসানা ইয়াসমিন তিথি বলেন, ‘সরকারের উচিত অন্তত ১৫ দিনের জন্য হলেও সব স্কুল বন্ধ রাখা।’
তিনি বলেন, ‘জম্মু-কাশ্মীরে দুই জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় সেখানকার সরকার সব প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়েছে। জম্মুর চেয়েও ঢাকা জনবহুল।’
ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী, করোনভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে ১১ মার্চ পর্যন্ত বিশ্বের অন্তত ৩৯টি দেশে স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২২টি দেশ সব স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে ৩৭ কোটিরও বেশি শিশু ও তরুণের ওপর।
স্কুল বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শিক্ষা উপমন্ত্রী বলেন, ‘আতঙ্ক থেকে এ ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে... আইইডিসিআর এর ঘোষণা দেবে। আমরা নয়। এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার যথাযথ কর্তৃপক্ষ তারা।’
তিনি আরও বলেন, ‘জনগণের আতঙ্কের ভিত্তিতে সরকার তার কার্যক্রম পরিচালনা করে না। রোগের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মত ও বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে সরকার তার কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।’
নতুন নির্দেশনা
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. গোলাম ফারুক বলেন, ‘গতকাল অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সারা দেশের স্কুল ও কলেজগুলোকে শ্রেণিকক্ষে প্রাত্যহিক সমাবেশ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, পরবর্তী নির্দেশের আগ পর্যন্ত সব ধরনের সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া ও অন্যান্য কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।’
গতকাল প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের দেওয়া নির্দেশনায় প্রাথমিকের সব শিক্ষার্থীদের ঘন ঘন হাত ধোয়া ও জনসমাগম এড়িয়ে চলার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষকদের বলা হয়েছে, তারা যাতে এ নির্দেশনা শিক্ষার্থীদের পড়ে শোনায়।
Comments