ঘরে বন্দি রোম
ইতালির রাজধানী রোমের বাংলাদেশি কমিউনিটি ইউরোপের অন্যতম বড় কমিউনিটি। প্রায় ৪০ হাজার বাংলাদেশির এই শহরের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ। প্রাচীন সভ্যতার এই বিশ্বজননীর সঙ্গে বাংলাদেশিদের হৃদ্যতা প্রায় চার দশকের পুরনো।
বর্তমান সময়ের রোমের সঙ্গে অনেক কিছুতে মিশে আছে বাংলাদেশি কমিউনিটি। গড়ে উঠেছে শতশত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। অনেকগুলো মসজিদসহ বহু কিছু। রোমানরা এখন বৈশাখ বরণ বোঝেন, বৈশাখী মেলা চেনেন এই কমিউনিটির হাত ধরে।
প্রতিদিন সকাল হলে রোম শহর মুখরিত হয়ে ওঠে বাংলাদেশি অভিবাসীদের কলকাকলিতে। ভিক্টোরিয়া বা তরপিনাতায় হয়তো একটা গাছের পাতাও পাওয়া যাবে না যার সঙ্গে অভিবাসী বাংলাদেশিদের পরিচয় নেই। হরেক রঙ্গের মানুষের ভিড়ে সদাচঞ্চল এ শহরটি হঠাৎ করে ঘুমিয়ে পড়েছে।
দিনমণি মধ্য আকাশে উঠলেও শহরের ব্যস্ততা বাড়ে না। হকারের হাঁকডাক শোনা যায় না। রাস্তার ধার দিয়ে সারি-সারি বারগুলো থেকে গরম ব্রিয়শের ঘ্রাণ আসে না। মুখে লেগে থাকা কাপোচিনো বা এসপ্রেচ্ছোর ধুয়া ওড়ে না। কাপ-পিরিচের টুংটাং শব্দ পাওয়া যায় না। ঊর্ধ্বশ্বাসে কাউকে আর গন্তব্যে ছুটতে দেখা যায় না। সবাই ঘরের দরজার বন্ধ করে বসে আছে। এক অদ্ভুত আতঙ্কে হাঁসফাঁস করছে গোটা শহর। মনে হচ্ছে ৩ হাজার বছরের বেশি সময় ধরে শৌর্যবীর্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা শহরটা আজ পরাজিত এক অদৃশ্য শক্তির কাছে।
ইতালির প্রধানমন্ত্রী অধ্যাপক জুযেপ্পে কোনতে গোটা দেশকে ১৫ দিনের হোম কোয়ারেনটায়েন ঘোষণা করার পর থেকে কেউ ঘর থেকে বের হয় না। দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে থাকে। শীতের দিনে ইউরোপের গাছগুলো যেমন ফুল পাতা হারিয়ে মরার মতো দাঁড়িয়ে থাকে, ঠিক তেমনি রোম এখন দাঁড়িয়ে আছে প্রাণহীন মূর্তির মতো।
দর্শনীয় স্থানগুলোয় কেউ নেই। কোনো টুরিস্ট নেই। কোলচ্ছেয়, ফোনতানা দি ত্রেভি, পিয়াচ্ছা নাভানা, পিয়াচ্ছা ভেনেসিয়া, মিউজিয়াম সব বন্ধ, জনমানবশূন্য।
ভ্যাটিকানের ইতিহাসে গত রোববার ক্যাথলিক ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিসকো জানালায় দাঁড়িয়ে সাপ্তাহিক বক্তৃতা করেননি। গির্জার ভেতর থেকে তার বক্তৃতা দেখানো হয়েছে বড় মনিটরে।
২.
ইতালির করোনা সংকট প্রবাসীদের দুইভাবে প্রভাবিত করেছে। প্রায় সবাই বেকার হয়ে পড়েছে। যারা সিজন্যাল কন্ট্রাক্টে চাকরি করেন তারা কর্মহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা বেশি করছেন। যারা নিয়মিত চাকরি করেন না তাদের অবস্থা খুব সংকটময়। তবে আশার কথা হলো প্রধানমন্ত্রী সিনোর কোনতে বলেছেন— করোনা সংকটের জন্য ইতালিতে কেউ চাকরি বা ব্যবসা হারাবে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সবাই নিজ নিজ চাকরি, ব্যবসায় যোগ দিতে পারবেন।
অনেক প্রবাসী আছেন যারা প্রতিমাসে দেশে টাকা পাঠান, সেই টাকায় তাদের সংসার চলে। বাচ্চাদের বা ছোট ভাই-বোনের লেখাপড়ার খরচ চলে। বৃদ্ধ বাবা-মার ওষুধ কেনা হয়। এই প্রবাসীরা সারা রাত ঘুমাতে পারেন না। তাদের চোখের দুই পাতা এক হয় না দুশ্চিন্তায়। এ ভাবে যদি আরও কয়েক মাস কেটে যায় তখন কী হবে? কীভাবে চলবে তাদের দেশে রেখে আসা সংসার? কে চালাবে বাচ্চাদের লেখাপড়ার খরচ? কোথা থেকে আসবে বাবা-মার ওষুধের টাকা?
অন্যদিকে সচেতন প্রবাসীরা চোখের সামনে দেখছেন, ইতালির মতো দেশ করোনার মহামারি ঠেকাতে কেমন নাকানিচোবানি খাচ্ছে। বাংলাদেশে যদি এই ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ে তখন কী হবে? কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি হবে সেখানে? কীভাবে নিরাপদ থাকবে দেশের মানুষ? কীভাবে নিরাপদ থাকবে আত্মীয়স্বজন, প্রিয়জন?
প্রবাসীদের বুকে চেপে রাখা এসব কষ্ট কেউ দেখে না। কেউ বোঝে না। কেউ জানে না। এত-এত দুশ্চিন্তার বোঝা মাথায় নিয়েও প্রবাসীরা প্রতিদিন দেশের মানুষদের সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলে। বুকের ব্যথা চেপে বলে— ‘আমি ভালো আছি মা, কোনো দুশ্চিন্তা করো না।’ এ মাসে আমি একটা বোনাস পেয়েছি, মাসের শেষে সব পাঠিয়ে দিবো।
৩.
রোমের বাংলাদেশ এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী বাচ্চু জানান, রোম একেবারেই ফাঁকা। মানুষ বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছে না।
তিনি বলেন, ‘রোমে ৩৫ হাজারের বেশি বাংলাদেশি অভিবাসী বসবাস করেন। এর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অভিবাসী নিয়মিত চাকরি করেন না। তারা ভ্রাম্যমাণ ব্যবসা করেন, অথবা টুরিস্ট পয়েন্টর ছোট-ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দৈনিক বেতনে চাকরি করেন। এই শ্রেণির জন্য এখনে সময়টা সব থেকে কঠিন। তাদের গচ্ছিত অর্থ দিয়ে কোনোভাবেই এক সপ্তার বেশি চলার কথা নয়। সুতরাং করোনা সংকট যতো লম্বা হবে এই মানুষগুলোর কষ্ট তত বৃদ্ধি পাবে।
রোমের অন্যতম সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তমাল আহমেদ বলেন, ‘চীন পৃথিবীর সব থেকে বড় রপ্তানিকারক দেশ। করোনার সংকট কাটিয়ে উঠতে তাদের অনেক সময় লাগবে। আর এই সময়ের মধ্যে পৃথিবীজুড়ে ব্যাপক একটা পরিবর্তন আসবে। বিশেষ করে অর্থনীতি ও রাজনীতি বেশি প্রভাবিত হবে। কারো অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়বে, কারোটা নতুন আশার মুখ দেখবে। কোনো কোনো জায়গায় উগ্রবাদীদের নয়া উত্থান হতে পারে।’
দৈনিক যুগান্তরের রোম প্রবাসী সাংবাদিক জমির হোসেন বলেন, ‘রাস্তাঘাট একদম ফাঁকা। এত সুনসান রোম শহর স্মরণকালে কেউ দেখেছে বলে মনে হয় না। সবার মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সাধারণ যান চলাচল কমিয়ে আনা হয়েছে। রাস্তায় রাস্তায় পুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে। পদে পদে মানুষকে থামানো হচ্ছে। জানতে চাওয়া হচ্ছে বাইরে বের হওয়ার কারণ। গ্রহণযোগ্য উত্তর দিতে না পারলে অর্থদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি সাবধান করা হচ্ছে একাধিকবার বিশেষ কারণ ছাড়া ঘর থেকে বের হলে হাজতেও যেতে হতে পারে।
তিনি জানান, রোমের কোথাও মাস্ক পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি নিজে অন্তত চারটি ফার্মেসিতে গিয়েছেন, কিন্তু মাস্ক পাননি। বাজারে আসার আগেই সব হাওয়া হয়ে যাচ্ছে।
জমির বলেন, ‘বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা কেউ ভালো নেই। অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ। খাবারের দোকানগুলো যারা খুলতে পারছেন তারা জানিয়েছেন বেচাকেনা খুব সামান্য। এ ভাবে আর কিছুদিন চললে দোকান ভাড়াও জোগাড় করা সম্ভব হবে না।’
তিনি জানান, যাদের নিয়মিত কাজ নেই তারা পড়েছেন সব থেকে বেশি বিপদে। তাদের অনেকেই দেশে চলে যাওয়ার কথা ভাবছেন। কারণ এখানে বসে নিজের খরচ বহন করা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
Comments