বঙ্গবন্ধু আমাদের চেতনায়: প্রচারের নামে তাঁকে নিয়ে যা ইচ্ছা তাই না করার আবেদন

Bangabandhu
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

আমার বয়স তখন মাত্র ৯ বছর। ১৭ মার্চ ১৯৭৫ সাল। আমি আব্বার হাত ধরে গণভবনে গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে। ঐরকম বড় মাপের সুন্দর মানুষ আমি জীবনে ঐ প্রথম দেখলাম। স্পষ্ট মনে আছে আমি ‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা, গৌরী যমুনা বহমান’ কবিতাটির প্রথম চার লাইন শিখে তাঁকে শুনিয়েছিলাম। উনি মাথায় হাত রেখে দোয়া করেছিলেন। আমার ছোট হৃদয়ে সেই যে বঙ্গবন্ধু নামটা গাঁথা হয়ে গেল, আর কোনদিন তা মুছে গেল না। এই বয়সে এসেও চোখ বন্ধ করলে সেই ক্যারিসম্যাটিক চেহারাটাই ভেসে ওঠে।

এর মাত্র ৫ মাস পর এলো ইতিহাসের সেই কালো অধ্যায়। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেলো প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে। দৌড়ে আব্বা-আম্মার ঘরে গেলাম। সবাই হতচকিত। আমি ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। আব্বা টেলিফোন করার চেষ্টা করছেন খবর জানার জন্য। শব্দটা এত কাছ থেকে আসছিল যে কান পাতা যাচ্ছিল না। আমরা থাকতাম আসাদগেট নিউকলোনিতে। ৩২ নম্বর এর খুব কাছে। এর মধ্যে আম্মা হঠাৎ বলে উঠলেন ‘শব্দটা কি বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে আসছে? ওনাকে কি মেরে ফেললো? তুমি রেডিও ধর’। আম্মার এই কথার পর আব্বা সম্বিত ফিরে পেয়ে রেডিও অন করলেন।

ভেসে এলো মেজর ডালিমের কণ্ঠস্বর। তাদের অপকর্মের কথা জোর গলায় ঘোষণা করছে। আমার বয়স তখন প্রায় ১০ বছর, কিন্তু সব ঘটনা স্পষ্ট চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আব্বা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এর আগে আমি কখনও আব্বাকে কাঁদতে দেখিনি। আম্মাও কাঁদছেন। আমিও বুঝে, না বুঝে কাঁদতে থাকলাম। আমার তখন রাজনীতি বোঝার বয়স নয়, বুঝতামও না। কিন্তু, পারিবারিক কারণে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি অসম্ভব টান বা ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল। এছাড়াও, মাত্র ৫ মাস আগে আমি আমার সামনেই এই মহান নেতাকে দেখে এসেছি।

আব্বা সেসময় ছিলেন প্রিন্সিপাল ইনফরমেশন অফিসার। তিনি পাগলের মত কাঁদছেন, বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে খবর জানার চেষ্টা করছেন। আমাদের বাসায় তখন একটা ‘লাল ফোন’ ছিল, যেটা দিয়ে শুধু হাই-প্রোফাইল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলা যেতো। সেটার নম্বরও ছিল তিন ডিজিটের। সেই ফোনটা সকাল ১১টার দিকে বেজে উঠলো। ঐ পাশ থেকে একজন আব্বাকে বললো রেডি হয়ে নিতে, কারণ তাকে নিতে গাড়ি পাঠানো হয়েছে।

এই কথা শুনে আম্মার অবস্থা হলো আরও শোচনীয়। ততক্ষণে আমরা জেনে গেছি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর আশেপাশে যারা ছিল তাঁদেরও এক এক করে হত্যা করা হয়েছে। আম্মা চিৎকার করে আব্বাকে বলতে থাকলো, ‘ওরা তোমাকেও মেরে ফেলবে। ওরা জানে তুমি বঙ্গবন্ধুর লোক। তুমি যেও না রঞ্জনার আব্বা।’

কিন্তু, না যেয়ে তো উপায় নেই। আব্বা রেডি হয়ে নিলেন। বেলা ১২টার দিকে সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি এসে আব্বাকে নিয়ে গেল। সারা কলোনির মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ল সেই দৃশ্য দেখার জন্য। চরম একটা অনিশ্চিত ও ভীতিজনক অবস্থা। এরপর প্রায় দেড় দিন চলে গেল, আব্বার কোন খবর পেলাম না। আম্মা কাঁদতে-কাঁদতে পাগল হওয়ার অবস্থা। বাবেলের বয়স ১ বছর, ওর দিকেও আম্মার চোখ নেই। বাসায় রান্নাবান্না বন্ধ। ভয়ে অনেক আত্মীয়স্বজন খোঁজ খবরও নিচ্ছে না।

ঠিক এরকম একটি অবস্থায় প্রথম দিনটি চলে গেল। ১৬ আগস্ট সকালবেলায় দেখলাম আমাদের বিল্ডিংয়ের নিচতলায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের একজন নেতা থাকতেন, উনি মিষ্টি বিতরণ করছেন। অনেকেই হাসিহাসি মুখে সেই মিষ্টি খাচ্ছেন। সেসময় জাসদের পত্রিকা ’গণকন্ঠ’র একজন সাংবাদিক আনোয়ার সাহেব থাকতেন কলোনিতে। উনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে মুজিবকে বংশসুদ্ধ হত্যা করার কাজটি কত ভালো হয়েছে, সে বিষয়ে উঁচু গলায় বক্তৃতা দিচ্ছেন। আর অন্যরা এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানারকম টিপ্পনী কাটছেন।

আমি অবাক হয়ে সেই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিলাম। তখনও ভেবেছি, এখনও ভাবি— যে মানুষটি এই দেশকে স্বাধীন করলেন, তাঁকে এইভাবে কেন মারা হলো? তারপর আবার মিষ্টিও খাচ্ছে। এরকম একটি নির্মম হত্যাযজ্ঞকে কেন এবং কারা সমর্থন করছে? আমার সেসময়ের শিশুমনে যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল, এর উত্তর আজো পাইনি। কেন ওনাকে নির্বংশ করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, কারা করেছিল— সেই ইতিহাস আমি এখন জানি। কিন্তু, এরপরও যতবার ১৫ আগস্ট আসে, ততবার সবকিছু ছাপিয়ে শুধু ঐ দৃশ্যটিই আমার চোখে ভেসে ওঠে।

১৭ আগস্ট দুপুরে সেই লাল টেলিফোন আবার বেজে উঠলো। ঐ পাশে আব্বার কণ্ঠস্বর। যাক তাহলে ওরা আব্বাকে মেরে ফেলেনি। আম্মার যে চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছিল, তা আবার ধারার মতো নামতে শুরু করলো। শুধু বলতে থাকলো, ‘তুমি কী খাইছো? ওরা তোমাকে মারে নাইতো? তুমি কখন আসবা?’ আব্বা জানালো তিনি বঙ্গভবনে আছেন। ভাত খেয়েছেন। আব্বা আমাদের চিন্তা করতে মানা করলেন। বললেন, কাজ শেষ হলে ওরাই বাসায় দিয়ে যাবে। ঐদিনই রাত ১২টার দিকে আব্বা বাসায় ফিরে এলেন। কিন্তু, আব্বার সেই বিধ্বস্ত, ক্লান্ত, অসহায় আর বিষণ্ণ চেহারাটা আমি কোনদিন ভুলবো না।

সেই ১০ বছর বয়সে আমি যা বুঝিনি, পরবর্তী সময়ে এর অনেকটাই আমি বুঝেছি। বুঝেছি, ইতিহাসে কালো অধ্যায় একবার যোগ হলে, তা বারবার ফিরে আসে। সেদিন সামরিক বাহিনীর সেই কুৎসিত কাজকে যারা সমর্থন করেছিল, তারা নিজেরাই একদিন সেই কুৎসিত কাজের বলি হলো। বারবার সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষতবিক্ষত হলো দেশ ও দেশের মানুষ। আমি এখনও বিশ্বাস করি এবং সারাজীবন বিশ্বাস করে যাবো— ১৫ আগস্টের সেই হত্যাযজ্ঞ বাংলাদেশকেই পরাজিত করেছে এবং এর জের আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে।

এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি আসলে লিখতে বসিনি। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর থেকে প্রায় ৯০/৯১ সাল পর্যন্ত ওনার নাম নেওয়াও নিষিদ্ধ ছিল। স্কুল-কলেজের কোন পাঠ্যপুস্তকে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধে ওনার অবদান, আওয়ামী লীগ সম্পর্কে কিছু ছিল না। আমরা যারা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে প্রকৃত ইতিহাস জেনেছি, তারা প্রথমত পরিবার থেকে জেনেছি। দ্বিতীয়ত, বই পড়ে জেনেছি। বাকিরা তেমন কিছুই জানেনি বা পরিবার থেকে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পেয়ে বড় হয়েছে। সেসময়কার পাঠ্যপুস্তকে জিয়াউর রহমান সাহেবের সময়ের জয়-জয়কার ছিল। পরবর্তীতে এরশাদ সরকারের সময়ে বইতে যে কী কী ছিল, কী শেখানো হয়েছিল তা একমাত্র তারাই জানে।

অনেক পরে যখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলো, তখন অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। অনেকগুলো প্রজন্ম ইতিহাসের একটি বড় অধ্যায় না জেনে বা কম জেনে বা ভুল জেনে বড় হয়েছে। তাই বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের একটি বড় দায়িত্ব বর্তমান প্রজন্মকে স্বাধীনতার ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর কথা, আওয়ামী লীগের অবদান সঠিকভাবে জানানো। এই জানানোর প্রক্রিয়ায় মনে রাখতে হবে এই প্রজন্ম অনেক আলোকিত, স্মার্ট, ডিজিটাল ফ্রেন্ডলি এবং গুগলের সুবাদে দেশবিদেশের খবর জানা প্রজন্ম। এরা বঙ্গবন্ধুকে দেখেনি, মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, এরা মুক্তিযোদ্ধাও দেখেনি, দেখেনি স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে বাঙালির দুঃখ-দুর্দশা। যা জেনেছে সব তৃতীয় কোন উৎস থেকে জেনেছে। কাজেই এখন আওয়ামী লীগ সরকারের বড় দায়িত্ব এই শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের অন্তরে স্বাধীনতার ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধুর এমন একটি ইমেজ তৈরি করা, যা যুগ যুগ ধরে তারা বয়ে বেড়াবে।

আজ আমি লিখতে চাই স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে আমাদের সেই মহামানবের মতো মানুষটিকে কেন অসম্মানিত করা হচ্ছে? কারা করছে তাঁকে এই অপমান? বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীতে তাঁকে ঘিরে হচ্ছে নানা ধরনের প্রোগ্রাম ও প্রচার প্রচারণা। অথচ এসব প্রচার প্রচারণার অনেককিছুই করা হচ্ছে যেনতেনভাবে, যা দেখে আমার মনটা কষ্টে ভরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কিছু মানুষ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তামাশা করছে। কারো উপর বিশেষ করে শিশুদের উপর এমনকিছু চাপিয়ে দেওয়া ঠিক না যাতে বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতার অবমাননা হয়। ওনাকে নিয়ে হাসাহাসি করার সুযোগ পায়।

প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুকে চেনানো মানে বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে বাজারের ব্যাগ নয়। বাচ্চাদের স্কুলে বঙ্গবন্ধুর মুখোশ পরানো হল, একটি মেয়েদের স্কুলে মুজিবকোর্ট ও পাঞ্জাবি পড়ে ছাত্রীদের বসানো হল, পুলিশের জামার পিঠে বঙ্গবন্ধু এবং তারা বসেও আছে বঙ্গবন্ধুর ছেঁড়া পোস্টারের উপর, কাপল কালেকশনেও নাকি মুজিব শাড়ি ও পাঞ্জাবি বের হয়েছে। শাড়ির আঁচলে ৫০টা মুজিবের মাথা, মুজিব টিস্যু বক্স ও টি ব্যাগ। আমি জানি না মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরার জন্য এসবের কোনো দরকার আছে, কী নাই?

বঙ্গবন্ধুকে যারা প্রকৃত অর্থে ভালোবাসেন, সম্মান করেন তাদের দিয়ে কিছু সৃজনশীল কাজ করান, যাতে শিশু থেকে বয়স্ক মানুষ সবার নজর কাড়ে। এ প্রসঙ্গে সরকার ও আওয়ামী লীগের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। দয়া করে এরকম একজন অবিসংবাদিত নেতার সুন্দর ছবি, পোস্টর ও স্ট্যাচু ব্যবহার করুন। শুধু টাকা উড়ানোর উপায় হিসেবে এই মহানায়ককে নিয়ে কেউ যেন খেলতে না পারে, সে বিষয়ে সতর্ক হতে হবে।

বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাই যথার্থই বলেছেন— ‘মুজিববর্ষ নিয়ে কেউ অতি উৎসাহিত হবেন না। এত উৎসাহী থাকলে ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর লাশ সেখানে পড়ে থাকত না। আমার মা (বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব) এবং পরিবারের সদস্যদের রেড ক্রিসেন্টের শাড়ি দিয়ে দাফন করা লাগতো না। এখন আমি মারা গেলে কী হবে, তাও জানি। কাজেই কোনো বাড়াবাড়ি নয়।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘আব্বাকে আমার মা বলতেন, ‘আপনি যখন জেলে যান, তখন সাজানো বাগান রেখে যান। কিন্তু, জেলখানায় যাওয়ার পরই এ বাড়ি (ধানমন্ডি ৩২) বিরানভূমি হয়ে যায়। কেউ আসে না, যদি আমাদের সহায়তা করতে হয়। আবার আপনি যখন আসেন, তখন বাগান ভর্তি হয়ে যায়।’ কাজেই আমার এবং রেহানার পরিষ্কার বার্তা— আমরা চাই না মুজিববর্ষ নিয়ে বাড়াবাড়ি কিছু হউক’।

শাহানা হুদা রঞ্জনা: যোগাযোগকর্মী

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago