প্রবাসীরা সবসময়ই ‘নবাবজাদা’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন ঠিকই বলেছেন, ‘প্রবাসীরা দেশে আসলে নবাবজাদা হয়ে যান’। কেবল দেশে আসলেই নয়, প্রবাসীরা আসলে সবসময়ই নিজেদের নবাবজাদা মনে করেন। না, কথাটা ঠিক এ রকম না। প্রবাসীরা আসলে সবসময়ই নিজেকে ‘নবাব’ মানে ‘সম্রাট’ মনে করেন। আমি একজন প্রবাসী। আমি নিজেকে সম্রাট মনে করি, নবাব মনে করি। সেটা কেবল দেশে গেলেই নয়। বিদেশে থাকার সময়ও। সবসময়ই।
প্রবাসীরা নিজেদের কেন সম্রাট মনে করেন- সেই কথা বলি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রবাসীদের শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি, প্রতিটি রক্তকণিকা গড়ে উঠেছে তাদের কষ্টে উপার্জিত হালাল আয়ের টাকায়। কাউকে ঠকিয়ে, ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে সুবিধা নিয়ে কিংবা কারো দয়ায় পাওয়া কোনো অর্থে তাদের রুটিরুজির সংস্থান হয় না। ফলে নির্ভেজাল হালাল আয়ে খেয়ে পরে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর মন এবং মাথা দুটোই নবাবের মতো উঁচু থাকে, শিরদাঁড়া একেবারে সোজা হয়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন নিজেও এক সময় ‘প্রবাসী’ ছিলেন। সেই সময় তিনিও হয়তো বা নবাবই ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে মন্ত্রী বানিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তার যোগ্যতা, সফলতা-ব্যর্থতা মূল্যায়নের দায়িত্ব তার নিয়োগকর্তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। সরকারের কূটনৈতিক সম্পর্ক, উদ্যোগ, আয়োজন দেখভাল করার দায়িত্ব তার। কিন্তু তিনি কূটনৈতিক ভাষাটাই রপ্ত করতে পারেননি। সেটি ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময় তার বক্তৃতা-বিবৃতিতে প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রবাসীদের নিয়ে এই যে তিনি ঢালাওভাবে বলে দিলেন, ‘দেশে এলে প্রবাসীরা নবাবজাদা হয়ে যান’- এটিও কূটনৈতিক কোনো ভাষা নয়, শোভন ভাষা তো নয়ই।
ইতালি থেকে দেশে আসা ১৪২ জন নাগরিককে নিয়ে বিমানবন্দর এবং পরবর্তীতে আশকোনা হজ ক্যাম্পে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিলো। প্রবাসীদের কেউ কেউ সেখানে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, কেউ কেউ অশোভন আচরণ করেছে। সেখানে কর্তৃপক্ষের সীমাহীন অব্যবস্থাপনা ছিলো, সেই অব্যবস্থাপনাই তাদের ক্ষুব্ধ করেছে। সেই ক্ষোভ থেকে কেউ কেউ বাজে ব্যবহার করেছে। সেই বাজে ব্যবহারকে আমরা সমর্থন করি না। আমরা কর্তৃপক্ষের অবহেলা, অব্যবস্থাপনারও প্রতিকার চাই। সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আবদুল মোমেন সেখানে দায়িত্বশীল ভূমিকায় নিজেকে দাঁড় করাতে পারেননি। বরং তিনি ইতালি থেকে আসা বাংলাদেশিদের, ঢালাওভাবে প্রবাসীদের নিয়ে অকূটনৈতিক মন্তব্য করেছেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘প্রবাসীরা দেশে এলে সোনারগাঁও, ফাইভ স্টারের খাবার খেতে চায়’। আমার মনে হয় না এই কথাটা তিনি সঠিক বলেছেন। হাতে গোনা কিছু বাদ দিলে, প্রবাসীরা দেশে এসে সোনারগাঁও, ফাইভ স্টার হোটেলে খাওয়ার কথা ভাবেন না। ভাবেন না, কারণ তারা হালাল উপায়ে উপার্জিত টাকা পকেটে নিয়ে দেশে আসেন। সেই টাকায় ফুটানি করে উড়াতে তারা চান না। তারা যখন প্রবাসে থাকেন, তখনো শেরাটন ফাইভ স্টারে খান না। তাহলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই কথাটা কেন বললেন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে? তিনি তো সাধারণ প্রবাসী ছিলেন না। আমেরিকায় তার ব্যয় বহন করতো দেশের সাধারণ মানুষ, সেখানে এই প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের অর্থও থাকতো। এই অর্থে তিনি আমেরিকায় ফাইভ স্টার হোটেলে পার্টি করেছেন, লাঞ্চ, ডিনার করেছেন। কিন্তু সাধারণ প্রবাসীরা ফাইভ স্টার হোটেলে যান না। যেতে চানই না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, ‘ইতালি থেকে আসা নাগরিকদের পর্যটনের খাবার দেওয়া হয়েছিলো। এই খাবার তারা পছন্দ করেনি। তারা সোনারগাঁও, ফাইভ স্টার হোটেলের খাবার চান’। একটি টেলিভিশনে একজন ইতালি প্রবাসীর কথা শুনেছি। তিনিও বলছিলেন, ‘টেলিভিশনের খবরে শুনলাম আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো খাবার আমরা চোখেও দেখিনি। সকাল ১০টার দিকে আমাদের এক বোতল করে পানি দেওয়া হয়েছে শুধু’। কাকে বিশ্বাস করবো আমরা? পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে? না কি ইতালি প্রবাসীকে?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তথ্যে গড়মিল থাকে সেটা আমরা জানি। চীনের উহান থেকে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনা প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘টাকার অভাবে তাদের ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। সরকারের কোনো তহবিল নেই’। অর্থমন্ত্রী সেই দাবিকে নাকচ করে দিয়েছিলেন। অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘টাকার কোনো সমস্যা নাই’। অর্থাৎ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সে সময় সঠিক তথ্য দেননি। ভুল তথ্য দেওয়ার রেকর্ড যার আছে, তিনি এখন সঠিক তথ্য দিচ্ছেন সেটা কীভাবে ভাববো!
এসব কথা বাদ দেই। ঘটনাটা বিদেশ বিভূঁইয়ে থাকা নিজ দেশের নাগরিকদের নিয়ে। যারা একটি ক্রান্তিকালে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মাতৃভূমিতে এসেছে। যারা যে দেশ থেকে এসেছে, সেখানে করোনার ছোবল সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে। বাংলাদেশও করোনারে ভয়ে বিহ্বল। এমন একটি পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিকে, সরকারের প্রতিনিধিকে মানবিক আচরণ করতে হয়। নিজেদের ভরসাস্থল হিসেবে দাঁড় করাতে হয়। ড. মোমেন নিজেকে মানবিক মানুষ হিসেবে দাঁড় করাতে পারেননি। তিনি সরকার মানবিক কী না সেই প্রশ্নেরও পরিবেশ করে দিয়েছেন। নইলে রেমিট্যান্স যোদ্ধা প্রবাসীদের ঢালাওভাবে তিনি হেয় করে কথাবার্তা বলতে পারতেন না।
শওগাত আলী সাগর, টরন্টোর বাংলা পত্রিকা নতুনদেশ ডটকম-এর প্রধান সম্পাদক।
Comments