কোয়ারেন্টিন প্রহসন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঘোষণা অনুযায়ী নভেল করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ মহামারীর নতুন কেন্দ্রস্থল ইউরোপ। ইউরোপের মধ্যে ভাইরাসটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে ইতালিতে। এরপরই আছে স্পেন। নজিরবিহীনভাবে সবচেয়ে উজ্জীবিত, উষ্ণ ও জনবান্ধব দেশ হিসেবে পরিচিত ইতালি অবরুদ্ধ হয়ে আছে। জনগণকে নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান করার আহ্বান জানিয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ।
ইতালি থেকে বেড়াতে আসা একটি দলের মাধ্যমে ভাইরাসটি ভারতে এসেছিল বলে জানা গেছে। ইউরোপ থেকে, বিশেষত ইতালি থেকে, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, আজ মধ্যরাত থেকে বাংলাদেশেও এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে।
গত শনিবার ঢাকায় দুজন কোভিড-১৯ সংক্রামিত রোগী পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে একজন এসেছেন ইতালি থেকে, অপরজন জার্মানি থেকে। তারপরও করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্থ দেশ ইতালি থেকে ১৪২ জন বাংলাদেশি দেশে ফেরার পর হোম কোয়ারেন্টিনের শর্তে আশকোনা হজ ক্যাম্প থেকে বাড়ি চলে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছে।
কেন? কারণ তারা বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনের জন্য আশকোনা হজ ক্যাম্পে যাওয়ার পর সেখানে থাকতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। অথচ, ঘটনাটি ঘটার কয়েক ঘণ্টা আগেই ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনের ঘোষণা দিয়েছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজে।
ইতালিতে সবচেয়ে বেশি সংক্রামিত এলাকা ভেনিস। ১৪২ জনের এই বাংলাদেশি গ্রুপটি সেখান থেকেই এসেছে বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার হয়। যাচাইয়ের পর এই খবরটি দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনে প্রকাশিত হয়। ফলে, এই প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রয়োজনীয় চিকিত্সা ও ব্যবস্থাপনার প্রস্তুতির জন্য পর্যাপ্ত সময় পেয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
হজ ক্যাম্পে কোয়ারেন্টিনে না থাকার জন্য যখন বিক্ষোভ চলছিল তখন দেখা যায়, দেশে ফেরা যাত্রীদের আত্মীয়স্বজনরা বিনা বাধায় কোনো ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই তাদের কাছে যাচ্ছেন। আমরা যতদূর জানতে পারি, দেশে ফেরা এই যাত্রীদের কারোই রক্তের নমুনা সংগ্রহ করার চেষ্টা করা হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তাদের কারো উপসর্গ ছিল না বলে যেতে দেওয়া হয়েছিল।
তাহলে ১৪ দিনের ইনকিউবেশন পিরিয়ডের কী হবে? আমাদের কি তাকে বলতে হবে যে উপসর্গ দেখা নাও যেতে পারে। উপসর্গ দেখা না গেলেও, প্রবসীদের কেউ সংক্রামিত হয়ে থাকলে তার সংস্পর্শে যারা আসবেন তারাও ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবেন।
পুরো পৃথিবী যখন করোনা আক্রান্ত অঞ্চল থেকে আসা মানুষদের কোয়ারেন্টিনে রাখছে, পরীক্ষা করে সংক্রামিতদের চিহ্নিত করছে এবং চিকিত্সা করছে, আমরা করছি বিপরীত।
বিমানবন্দরে এই ১৪২ জনের গ্রুপটি আলাদা ছিল। তারা সংক্রমিত কি না পরীক্ষা করার পরিবর্তে কর্তৃপক্ষ পরিবারের সঙ্গে তাদের দেখা করার অনুমতি দিয়েছে। ফলে তাদের কাছাকাছি থাকা সবাই ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন।
চলুন দেখে আসা যাক ‘হোম কোয়ারেন্টিন’ কিভাবে চলছে। মানিকগঞ্জের সিভিল সার্জনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জেলাটিতে ২২১ জন প্রবাসীকে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আমাদের সংবাদদাতা গত শুক্রবার সরেজমিনে গিয়ে দেখতে পান সৌদি আরব থেকে আসা একজন অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমার কোনো উপসর্গ নেই তাই আমি ঘুরছি।’
সাত দিন আগে উপসাগরীয় একটি দেশ থেকে ফেরা একই গ্রামের অপর এক যুবককে দেখা যায় বাড়িতে গবাদি পশুকে খাওয়াতে। তিনি তার পরিবারের বাকি সদস্যদের সঙ্গে অন্যান্য কাজও করছেন। এই দুজন যে বাড়ি থেকে বের হয়ে বাইরে ঘোরাফেরা করছেন তা সিভিল সার্জন জানেন না। তার জেলায় হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা ২২১ জনের কে কী করছেন সে সম্পর্কে সিভিল সার্জন কি সচেতন? তাদের কার্যক্রম দেখার জন্য কোনো ব্যবস্থা কি নেওয়া হয়েছে? সবাইকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য তার কি যথেষ্ট জনবল আছে?
ময়মনসিংহে হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন ৮১ জন। এই ৮১ জন কী করছেন সে সম্পর্কে জেলার সিভিল সার্জনের কোনো ধারণা আছে কি? আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত দেশে ফেরা দুই হাজার ৩১৪ জন প্রবাসীকে সেল্ফ কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হয়েছে। তাদের সবার জন্যই এই প্রশ্নটি প্রযোজ্য।
সেল্ফ কোয়ারেন্টিনে যারা আছেন তাদের ওপর নজরদারি করার বিষয়ে আইইডিসিআর পরিচালক ড. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘প্রবাসীদের বাড়িতে কোয়ারান্টিনে থাকতে বাধ্য করার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা নিতে সিভিল সার্জনদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
আমাদের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও কাজের গতি বিবেচনায় নিলে শিগগির কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যদি দেশে ফেরা এই প্রবাসীদের কেউ সংক্রামিত হয়ে থাকেন, তাহলে তার মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়বে।
সেল্ফ কোয়ারেন্টিন বলতে আসলে কী বোঝায়? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক মোজাহেরুল হকের মতে, টয়লেট সংযুক্ত ঘরে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে এবং এই সময়ের মধ্যে অন্য কারো ছয় ফুটের মধ্যে আসা যাবে না। যারা তার খাবার সরবারাহ করবে তাদের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। এই সংজ্ঞা কি আমাদের ‘সেল্ফ কোয়ারেন্টিনে’র সঙ্গে মিলছে?
ইতালি থেকে ফেরা ১৪২ জন যখন বিক্ষোভ করছিলেন তখন তাদের শান্ত রাখার জন্য কাজ করছিল পুলিশ। পুলিশকে দেখা যায় পরিস্থিতি শান্ত করতে তাদের সঙ্গে হাসি ঠাট্টা করছে, কখনও স্পর্শ করছে, এমনকি তাদেরকে আলিঙ্গনও করছে। আর পুলিশ এই সবই করেছে নিজেদের সংক্রামন থেকে বাঁচানোর জন্য কোনো ধরনের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না নিয়েই। প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিক্ষোভের সময় কয়েকজন সেখান থেকে বের হয়ে যেতে সক্ষম হন। তারা কোথায় গিয়েছেন কে জানে?
গোটা বিশ্বে কোভিড-১৯ এর প্রভাব পড়েছে এবং আমরাও তার মধ্যেই আছি। আমরা এটাও জানি যে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তির সবটা এখন হাতে নেই। এটাও সত্য যে ভাইরাসটির বিরুদ্ধে লড়াই করতে আমরা দেশের প্রতিটি কোণেও পৌঁছাতে পারব না।
কিন্তু, আমরা কি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে আসার প্রবেশদ্বার বৃহত্তম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি থেকে আরও বেশি দক্ষতা আশা করতে পারি না? কেনইবা ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন ঘোষণা করা হলো আর কেনইবা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তা লঙ্ঘন করে প্রহসনে রূপান্তরিত করা হলো?
আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করার জন্য মাত্র একটি পরীক্ষা কেন্দ্র কেন থাকবে? একমাত্র পরীক্ষা কেন্দ্র আইইডিসিআরের পরিচালক মিরাজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা আহ্বান জানিয়েছেন কেউ যাতে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য সশরীরে সেখানে না যান। কারও যদি সন্দেহ হয় তাহলে আইইডিসিআর-এ টেলিফোন করে জানাতে হবে এবং তাদের টিম পৌঁছনোর জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
পুরো বিশ্ব কি বিপরীতটা করছে না? সবাইকে ঘরে বসে থাকার আহ্বান না জানিয়ে তারা সামান্যতম লক্ষণ দেখা দিলে পরীক্ষা করার এবং চিকিত্সকের সহায়তা নিতে বলছে।
‘সচেতনতা’ তৈরি আর ‘আমরা পুরোপুরি প্রস্তুত আছি’ ঘোষণা করা ছাড়া আর তেমন কিছুই হয়েছে বলে মনে হয়নি। এই মেগা শহরের দুই কোটি মানুষ জানে না আইইডিসিআর ছাড়া আর কোথায় করোনাভাইরাস আছে কি না তা পরীক্ষা করতে যাবে। এমনকি, কোভিড-১৯ এ সংক্রামিত বলে সন্দেহ হলে বেশিরভাগ হাসপাতালের চিকিত্সক ও নার্সরা রোগীদের চিকিত্সা করা থেকে বিরত থাকেন।
স্পষ্টতই সরকারের বিভিন্ন শাখার মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সংযোগের মারাত্মক অভাব রয়েছে। কাজ করার ক্ষেত্রে মহাপরিচালকের নেতৃত্বাধীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মন্ত্রণালয়ের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে বস্তুত অসহায়। মন্ত্রণালয় নির্দেশনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জন্য অপেক্ষা করে। যা প্রক্রিয়াটিকে আরও দীর্ঘায়িত করে তোলে। আমলাদের সঙ্গে পেশাদার ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সহযোগিতার অভাব সমান ভাবে হতাশাজনক।
আমাদের কি আরও বলা দরকার?
মাহফুজ আনাম, দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক
Comments