কিট ও পিপিই সংগ্রহে দেরিতে উদ্যোগ, হিমশিম খাচ্ছে সরকার
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব সঙ্কটে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে টেস্টিং কিট ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জাম (পিপিই) কেনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য প্রায় তিন মাস সময় পেলেও সরকার পরিস্থিতি বুঝতে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে টেস্টিং কিট ও পিপিই সংগ্রহ করা বেশ কঠিন হয়ে উঠেছে। সারা পৃথিবীতেই নভেল করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে। যার কারণে টেস্টিং কিটের চাহিদা ব্যাপক। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে পিপিই উৎপাদন করতে পারছে না কাঁচামালের অভাবে। এসবের কাঁচামাল বেশিরভাগই আমদানি করা হয় চীন থেকে।
১৭ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে এক লাখ পিপিই, পাঁচ লাখ সার্জিক্যাল মাস্ক ও সার্জিক্যাল গগলস এবং অন্যান্য সরঞ্জাম চেয়ে চিঠি দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিরাময় কেন্দ্র। তবে এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে অগ্রগতি হয়নি বললেই চলে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র বলছে, মন্ত্রণালয়ের অস্বস্তিকর ধীর প্রতিক্রিয়ার কারণেই এই অবস্থা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং কয়েকটি দাতা সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। যত দ্রুত সম্ভব কমপক্ষে এক লাখ টেস্টিং কিট এবং ১০ লাখ পিপিই প্রয়োজন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের।
বর্তমানে সরকারের কাছে প্রায় এক হাজার ৫০০ টেস্টিং কিট ও একই পরিমাণ পিপিই আছে। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ১০ হাজার টেস্টিং কিট ও একই পরিমান পিপিইর চালান এখন সিঙ্গাপুরে আছে। এক বা দুদিনের মধ্যে সেগুলো ঢাকায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে।
চীন গতকাল বুধবার ঘোষণা দিয়েছে তারা বাংলাদেশকে ১০ হাজার টেস্টিং কিট, ১৫ হাজার সার্জিক্যাল এন৯৫ রেসপিরেটর, ১০ হাজার মেডিকেল নিরাপত্তামূলক পোশাক ও এক হাজার ইনফ্রারেড থার্মোমিটার দেবে। ঢাকায় চীনা দূতাবাস এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়েছে, বেইজিং দ্রুত এসব চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের জন্য আকাশপথ ব্যবহার করবে।
গতকাল দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের কাছে কয়টি কিট আছে সেটা ব্যাপার না। পরীক্ষা করার জন্য কিটের কোনো সংকট হবে না। আরও কিট আসছে।’
১০ হাজার কিটের একটি চালান এখন সিঙ্গাপুরে আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করছি শিগগির এগুলো আমাদের হাতে এসে পৌঁছবে। আমরা আরও এক লাখ টেস্টিং কিট সংগ্রহ ও কেনার জন্য কাজ করছি।’
আবুল কালাম আজাদ আরও জানান, পিপিই সব চিকিৎসকদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় না। যারা সন্দেহভাজন করোনাভাইরাস রোগীদের চিকিৎসা করবেন শুধু তাদের জন্যই এগুলো প্রয়োজন। তিনি বলেন, ‘আমরা চিকিৎসকদের চাহিদা অনুযায়ী পিপিই সরবরাহ করছি।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত ৩৪০টি পিপিই চিকিৎসকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সময়ে সরকারের কাছে পর্যাপ্ত টেস্টিং কিট থাকা উচিত ছিল এবং পরীক্ষা করার সুবিধা সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত ছিল।
বাংলাদেশে একমাত্র রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) করোনাভাইরাস পরীক্ষা করে। তারা প্রতিদিন এক হাজার পরীক্ষা করতে সক্ষম এমন দাবি করলেও পরীক্ষার সংখ্যা নিতান্তই কম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা মুজাহেরুল হক গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা উচ্চ ঝুঁকিতে আছি। আমাদের প্রস্তুতিও অপর্যাপ্ত। তিন মাস সময় পাওয়ার পরও আমরা তা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। টেস্টিং কিট ও পিপিই সংগ্রহ করতে সরকার দেরি করে ব্যবস্থা নিচ্ছে।’
স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা তাদের জন্য অপ্রতুল নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার মোহাম্মদ সোহেল রানা জানান, তারা ইতোমধ্যে ১০০ পিপিইর জন্য চাহিদা দিয়েছেন কিন্তু এখনও পাননি।
তিনি বলেন, ‘আমাদের উপজেলায় প্রায় ১২৫ জন হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন। ঝুঁকিপূর্ণ হলেও তাদের স্বাস্থ্য সেবা দিতে হবে।’
কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের পর কোনো পিপিই পাননি জানিয়ে সিলেট বিভাগের পরিচালক (স্বাস্থ্য) দেবপদ রায় বলেন, ‘তবে আমরা আগামীকাল (আজ) এগুলো পাব বলে আশা করছি।’
বাড়তে থাকা চাহিদা, আতঙ্কিত হয়ে অতিরিক্ত কেনা এবং অপব্যবহারের কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করেছে সারা বিশ্বেই পিপিই সরবরাহে ঘাটতি নতুন করোনাভাইরাস এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
স্বাস্থ্য কর্মীরা নিজেদের এবং রোগীদের সংক্রামণ থেকে রক্ষা করতে পিপিইর উপর নির্ভর করেন। গ্লাভস, মাস্ক, রেসপিরেটর, গগলস, গাউন এবং অ্যাপ্রনের অভাব কোভিড-১৯ রোগীদের সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য কর্মীদের বিপদজনক পরিস্থিতিতে ফেলছে। এগুলো সরবরাহ পেতে কয়েক মাস সময় লাগতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক বে-নাজির আহমেদ বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে সরকার ব্যাপকভাবে প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন বোধ করেনি। যদি তা করত তাহলে এখন পর্যন্ত সবকিছুই প্রস্তুত হয়ে যেত।’
তিনি আরও জানান, রোগীর অবস্থা জানার একমাত্র উপায় হচ্ছে পরীক্ষা করা। তাই এটা সবার জন্য সহজলভ্য হওয়া উচিত।
বেশ কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরীক্ষা করতে সক্ষম। তাই বিশ্বাসযোগ্য এসব প্রতিষ্ঠানকে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করার অনুমতি দেওয়া উচিত বলে তিনি যোগ করেন।
‘আমরা এরই মধ্যে দেরী করে ফেলেছি, আর দেরি করতে চাই না।’
৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রামিত রোগী শনাক্ত হয়। গতকাল বুধবার পর্যন্ত এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ জনে এবং মারা গেছেন একজন।
গত ২১ জানুয়ারি থেকে ১৮ মার্চ পর্যন্ত মোট ছয় লাখ ৩১ হাজার ৫৩৮ জন বাংলাদেশি বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছেন। তাদের মধ্যে মাত্র ৩৫১ জনের পরীক্ষা করা হয়েছে।
বাংলাদেশে শুধুমাত্র তাদেরই করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা হচ্ছে যারা করোনাভাইরাস সংক্রামিত দেশ থেকে ফিরছেন ও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে এবং যারা এই প্রবাসীদের সংস্পর্শে আসছেন। যদি কেউ সম্প্রতি কোনো সংক্রামিত দেশে গিয়ে থাকেন এবং যদি কোনো লক্ষণ দেখা না যায় তাহলে তার পরীক্ষা করা হবে না।
তবে বিশ্বব্যাপী বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সংক্রামণ বিস্তার রোধে সন্দেহজনক সবারই পরীক্ষা করার বিকল্প নেই।
আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে বাহরাইন পরীক্ষা করছে চার হাজার ৯১০ জন, দক্ষিণ কোরিয়া চার হাজার ৯৯ জন এবং বাংলাদেশ মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য নয় জন (০.০৯)।
আরও পড়ুন: ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জামের দাবিতে কর্মবিরতিতে রাজশাহী মেডিকেলের ইন্টার্নরা
Comments