ইতালিতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা আতঙ্কজনক, জিনিসপত্রের সংকট নেই
ইতালির পরিস্থিতি নিয়ে আসলে কোনো সুখবর নেই। প্রতিদিনই মৃত্যুর হার, আক্রান্তের হার বাড়ছে। যত দিন গড়াচ্ছে মানুষের মধ্যে ভয়, আতঙ্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আমার পাশের ফ্লাটে একা এক প্রবীণ নারী থাকেন। বয়স প্রায় ৭৫ বছর। বাজার-সদাই থেকে শুরু করে সব কাজ একা করেন। এখন তিনি আর ঘর থেকে বের হন না। গতকাল জানালায় দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে কথা হয়। চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করছেন। তার কথা-মতে ইতালির প্রবীণ বয়সীরা ভয়াবহ আতঙ্কে আছেন। তাদের মধ্যে ভয় জন্ম নিয়েছে—হাসপাতালে বেশি বয়সী করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয় না। তাদের পরিণতি নিশ্চিৎ মৃত্যু।
বয়স্কদের এমন ভয়ের পেছনে মূলত কারণ দুটা—করোনায় মৃত্যুর মিছিলে বয়স্করা সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ‘ফেক নিউজ’ ছড়ানো হচ্ছে, যা আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
কদিন আগে এ ধরনের একটা খবরের বেশ ছড়াছড়ি দেখা গেছে। বলা হয়েছে, ইতালির ডাক্তাররা ৮০ বছরের বেশি বয়সের করোনা রোগীদের দেখছেন না। তারা কম বয়সীদের সুস্থ করার চেষ্টা করছেন।
সমালোচকরা বলছে, ইউরোপে প্রবীণদের পেছনে সরকারের অনেক খরচ হয়। বিশেষ করে ইতালি সরকারের বড় বোঝা হলো প্রতি মাসে মোটা অংকের পেনশন এবং চিকিৎসা খরচ। যে কারণে সরকারও প্রবীণদের ব্যাপারে উদাসীনতা দেখাচ্ছে।
যদিও এসব খবরের কোনো সত্যতা নেই। স্থানীয় মিডিয়াগুলোয় এসব খবরকে ‘ফেক’ বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
গতকাল রোমের বাংলাদেশি পাড়ায় সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল একাত্তর টিভির একটা খবর। সেখানে রোম থেকে একজন নারী সাংবাদিক বলেছেন, সুপারশপগুলোতে ঢুকতে লম্বা লাইন ধরতে হচ্ছে। একসঙ্গে বেশি খাবার কিনতে দেওয়া হচ্ছে না।
এটিএন বাংলার রোম সাংবাদিক হাসান মাহমুদ জানান রোমের কোথাও খাবার সংকট নেই। ছোট বড় সব দোকান, মার্কেটে পর্যাপ্ত খাবার আছে। কেনার ক্ষেত্রেও বিশেষ কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। লাইন ধরে মার্কেটে ঢুকতে হচ্ছে নিরাপত্তার স্বার্থে। একসঙ্গে বেশি মানুষকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। শুধু রোম নয়, সারা ইতালিতে একই নিয়ম চালু করা হয়েছে।
তিনি একাত্তর নিউজের বিষয়ে বলেন, ওই নারী সাংবাদিকের হয়তো বলার ভুল হয়েছে। এগুলো নিয়ে গুজব করার বা বিভ্রান্তি ছড়ানোর কিছু নেই।
মিলান থেকে বাংলা টিভির সাংবাদিক একে রুহুল জানান, দুই দিন আগে পর্যন্ত মিলানের আশপাশের শহরগুলোর সব ফ্যাক্টরি খোলা ছিল। বার রেস্টুরেন্ট বা অন্যান্য দোকান বন্ধ থাকলেও মানুষের চলাচল খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। পাবলিক পরিবহনেও কর্মজীবী মানুষের ভিড় দেখা গেছে।
তিনি বলেন, মিলান বড় শহর। এখানকার হাসপাতালগুলো তুলনামূলক বড়। আশপাশের ছোট শহরগুলো থেকে রোগী মিলানে এনে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। যে কারণে হয়তো মিলানে রোগী বা মৃতের সংখ্যা বেশি মনে হচ্ছে।
রুহুল জানান, মিলান থেকে আশপাশের ছোট শহরগুলোয় করোনা সংক্রমণের হার অনেক বেশি। শুক্রবার রাত ৮টায় করোনায় আক্রান্ত একজন বাংলাদেশি অভিবাসীর মৃত্যু হয়েছে। ৬৫ বছর বয়সের ওই অভিবাসীর গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী।
মিলানের পাশের শহর ব্রেশা থেকে দেশপ্রিয় পত্রিকার সম্পাদক সোহেল মজুমদার শিপন জানান, মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। প্রতিদিন যেমন মৃতের সংখ্যা বাড়ছে তেমনই ভয় এবং আতঙ্ক জেঁকে বসছে।
তিনি মনে করেন, এখনো মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব আছে। মানুষ গুজবে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে প্রবাসীদের আরও বেশি সতর্ক থাকা উচিত। সরকারি নির্দেশনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রয়োজন।
গেল দুদিন থেকে সামাজিক মাধ্যমে আরও একাটা পোস্ট ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেখানে বলা হচ্ছে—ইতালির সরকার প্রকৃত মৃতের সংখ্যা গোপন করছে। সরকার সেনাবাহিনীর গাড়িতে করে মৃতদেহ সরাচ্ছে, গোপন করছে।
এ ব্যাপারে ব্যবসায়ী আবদুস সালাম বাদল বলেন, কোনো কোনো গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে গোরস্থানে জায়গা সংকুলান হচ্ছে না, বাধ্য হয়ে লাশ অন্য শহরে সরানো হচ্ছে। মূলত এই খবর থেকেই ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে। আসল বিষয় হলো—ইতালির প্রতিটা পৌরসভায় কতজন মানুষ বাস করে, তাদের বয়স ও শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে পৌরসভার নির্দিষ্ট দপ্তরে হিসাব থাকে। সে অনুযায়ী বছরে কোনো পৌরসভায় কত জনের মৃত্যু হতে পারে তার একটা প্রাথমিক ধারনা থাকে। সৎকার এবং প্রার্থনা সভার প্রস্তুতি থাকে।
করোনাভাইরাস মহামারি আকার ধারণ করার ফলে ছোট পৌরসভাগুলোয় মৃতদেহ সৎকারের জন্য প্রস্তুতি সংকট তৈরি হয়েছে। আর এ কারণেই যেসব এলাকায় মৃতের হার বেশি ওইসব এলাকা থেকে লাশ পাশের পৌরসভায় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মৃত ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান জানাতেই লাশ বহনের কাজে সেনাবাহিনীর গাড়ি ব্যাবহার করা হচ্ছে। এখানে ঢাকাঢাকির মতো কোনো পরিস্থিতি হয়েছে বলে মনে হয় না। তাছাড়া সব মরদেহ সমাহিত করা হয় না। মৃতের ইচ্ছা বা তার আত্মীয়দের ইচ্ছায় অনেক লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়। স্থানীয় ভাষায় এটাকে ‘ক্রেমারে’ বলা হয়।
চীন থেকে একদল বিশেষজ্ঞ ইতালিতে এসেছেন দিন পাঁচেক আগে। তারা বলেছেন, এখানে যেভাবে হোম কোয়ারেন্টিন করা হয়েছে এতে কাজ হবে না। করোনা সংক্রমণ রোধ করতে হলে আরও শক্তভাবে লকডাউন করতে হবে।
আজ থেকে সারা ইতালির শহরভিত্তিক গণপরিবহন প্রায় ৮০ শতাংশ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রোববার খাবার দোকানসহ সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। খাবার কেনা বা ওষুধ কেনার মতো বিশেষ দরকারে বাড়ির বাইরে বের হলেও ২০০ মিটারের বাইরে যাওয়া যাবে না। এ নিয়ম অমান্য করলে শক্তভাবে জেল-জরিমানা করা হচ্ছে।
আজ থেকে শহরে পুলিশ প্রহরা বাড়ানো হয়েছে। প্রায় প্রতিটি গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সাইকেল আরোহীদের জন্য বলা হয়েছে, শুধুমাত্র খাবার কেনা এবং ওষুধ কেনার কাজে সাইকেল ব্যাবহার করা যাবে।
ইতালির প্রধানমন্ত্রী প্রফেসর জুযেপ্পে কোঁনতে প্রতিদিনই গণমাধ্যমের সামনে কথা বলছেন। তার সরকারের সক্ষমতা তুলে ধরছেন। মানুষকে সাহস দিচ্ছেন।
তিনি বলেছেন, আপনাদের যেকোনো প্রয়োজন আমরা মেটাব, আপনারা ঘরে থাকুন।
সিনোর কোঁনতে বলেন, দরকার হলে আগামী পাঁচ বছর ইতালির সব মানুষকে ঘরে বসে খাওয়ানো হবে, সে প্রস্তুতি আমাদের আছে। আপনারা আতঙ্কিত হবে না। নির্দেশনা অমান্য করবেন না। ঘর থেকে বের হবেন না।
গতকাল ইতালির সকল রেডিও থেকে একযোগে জাতীয় সংগীত ‘ফ্রাতেল্লি ইতালিয়া...’ বাজানো হয়। এ সময় ঘরবন্দি সব মানুষ যার যার ব্যালকনিতে এসে পতাকা ওড়ায় এবং একসঙ্গে গলা মিলিয়ে আত্মপ্রত্যয় প্রকাশ করে। বৃহস্পতিবার রাত সোয়া আটটায় রোমের মসজিদ থেকে ফেসবুক লাইভে আজান প্রচার করা হয় এবং সারা ইতালির বাংলাদেশি মুসলিমরা ওই আজান মোবাইল ফোনের স্পিকারে প্রচার করে ঘরের জানালায় বা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে।
Comments