টেলিভিশন ‘মনিটরিংয়ের’ প্রজ্ঞাপন সংশোধনে স্বস্তির কিছু নেই

বাংলাদেশ সরকার দেশের তিরিশটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে মনিটরিং করার জন্যে ১৫ জন সরকারি কর্মকর্তাকে ক্ষমতা প্রদান করে যে ঘোষণা দিয়েছিলো সমালোচনার মুখে তা বাতিল করে দিয়েছে। এই বিষয়ে সংশোধিত নতুন বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে কোভিড-১৯ (করোনাভাইরাস) বিষয়ে কোনো গুজব বা ভুল তথ্য প্রচার হচ্ছে কিনা, তা পর্যবেক্ষণ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং প্রচারমাধ্যমকে সহায়তা করতে তথ্য মন্ত্রণালয়ে একটি সেল গঠন করা হয়েছে’।
press freedom logo

বাংলাদেশ সরকার দেশের তিরিশটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে মনিটরিং করার জন্যে ১৫ জন সরকারি কর্মকর্তাকে ক্ষমতা প্রদান করে যে ঘোষণা দিয়েছিলো সমালোচনার মুখে তা বাতিল করে দিয়েছে। এই বিষয়ে সংশোধিত নতুন বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে কোভিড-১৯ (করোনাভাইরাস) বিষয়ে কোনো গুজব বা ভুল তথ্য প্রচার হচ্ছে কিনা, তা পর্যবেক্ষণ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং প্রচারমাধ্যমকে সহায়তা করতে তথ্য মন্ত্রণালয়ে একটি সেল গঠন করা হয়েছে’।

প্রথম ঘোষণাটি বাতিল করায় সাংবাদিকদের অনেকেই স্বস্তি প্রকাশ করেছেন এবং এই নিয়ে ঠাট্টা-তামাশাও করছেন। অধিকাংশের মন্তব্যে এই ধরণের সিদ্ধান্ত কারা নেয়, কেন নেয় বা যারা নেয় তারা কতটা ‘নির্বোধ’ এমন ধরণের কথাবার্তাই বলা হচ্ছে। ক্ষোভটা হচ্ছে কেন অগ্র-পশ্চাদ না ভেবে এই ধরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, আবার বাতিল করা হচ্ছে। এই ধরণের আলোচনায় যা অনুপস্থিত তা হচ্ছে এই ধরণের প্রত্যক্ষ সেন্সরশিপের হুমকি দেওয়ার রাজনৈতিক পটভূমি কী এবং এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপরে যে নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হচ্ছে সে বিষয়ে মূলধারার সাংবাদিকরা একই পরিমাণে ক্ষুব্ধ কিনা।

টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ওপরে থেকে কথিত মনিটরিংয়ের দৃশ্যমান খড়গ তুলে নেওয়ায় যারা স্বস্তি বোধ করছেন তারা জানেন যে, লিখিতভাবে এই ধরণের মনিটরিং ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হলেও অবস্থার কোনও হেরফের হবে না; ফেসবুকে সাবেক একজন সচিবের এই মন্তব্য যথেষ্ট – ‘গণমাধ্যম ২৪ ঘণ্টা মনিটর করা হয়, হচ্ছে’।

মনিটিরিংয়ের এই ঘোষণা দেওয়া হয়েছিলো করোনাভাইরাসকে উপলক্ষ করে। বলা হয়েছিলো যে, গণমাধ্যমে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত গুজব ও অপপ্রচার রোধ করার জন্যে এই সেল গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ওপরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সেন্সরশিপের উপস্থিতি নতুন নয়। গত ছয়-সাত বছর ধরে পুরো মাত্রায় বহাল আছে। প্রাতিষ্ঠানিক সেন্সরশিপের প্রয়োগ ছিলো অদৃশ্য। যার পরিণতিতে সেলফ সেন্সরশিপের চর্চা বিস্তার লাভ করেছে এবং স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। কোনও কোনও সাংবাদিক/সম্পাদক তা প্রকাশ্যেই বলেছেন। এই সরকারি প্রজ্ঞাপন কেবল বিরাজমান ব্যবস্থার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছিলো। করোনাভাইরাসকে উপলক্ষ করে সরকার এই ধরণের ব্যবস্থা নেবে সেটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া ২৫ মার্চের ভাষণেই ইঙ্গিত ছিলো।

ভয়েস অব আমেরিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ঘাতক ব্যাধি করোনাভাইরাস নিয়ে যারা গুজব ছড়াচ্ছেন তাদের সতর্ক করে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ ফলে এখন প্রথম ঘোষণা বাতিল করায় যে সব সাংবাদিক তাদের বিজয় দেখতে পাচ্ছেন তারা কার্যত এবং প্রকারান্তরে অপ্রকাশ্য ‘মনিটরিং’, যাকে সেন্সরশিপ ছাড়া আর কিছু বলা শব্দের খেলা মাত্র, তার প্রতি আস্থা রাখছেন। যে কারণে তারা প্রায় একই ধরণের ব্যবস্থা সামাজিকমাধ্যমে বহাল থাকায় এতটা ক্ষুব্ধ নন।

সরকারের প্রথম ঘোষণায় অনেক বিষয় ছিলো ইচ্ছাকৃতভাবেই অস্পষ্ট এবং কর্মকর্তাদের যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল তা সীমাহীন। গুজব বা অপপ্রচারের কোনো সংজ্ঞা আদৌ আছে কিনা সেটা অনেক পুরনো প্রশ্ন। কিন্তু, এই ধরণের কারণে যখন আইন প্রয়োগের বিষয় থাকবে বা সরকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা বলবে তখন তাতে এক ধরণের সংজ্ঞা দেওয়া জরুরি। কেননা, অন্যথায় যেকোনো কিছুকেই আইন ভঙ্গ বলে বিবেচনা করা যাবে। যেকোনো কিছুকেই এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব।

অস্পষ্টতার আরেকটি দিক ছিলো: কর্মকর্তাদের দেওয়া ক্ষমতা— ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ কোনো বেসরকারি টিভি চ্যানেলে করোনাভাইরাস সম্পর্কে অপপ্রচার কিংবা গুজব প্রচার হচ্ছে মর্মে চিহ্নিত করলে তা বন্ধ করার জন্যে সাথে সাথে মন্ত্রণালয়ের কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে’। কি বন্ধ করার কথা বলা হচ্ছে? ঐ কথিত অপপ্রচার না কি চ্যানেল? এর চেয়ে প্রত্যক্ষভাবে আইনের কথা বলে হুমকি দেওয়ার কোনো উদাহরণ দেওয়া যাবে না। সরকার অতীতে প্রচারকালীন অবস্থায় টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে এটা কেবল কল্পনাপ্রসূত নয় যে চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতাই দেওয়া হয়েছিল। এখন যদিও সামাজিকমাধ্যমের ক্ষেত্রে সেই ক্ষমতার কথা বলা হচ্ছে না, আমরা জানি যে সেই ক্ষমতা ইতোমধ্যেই ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মধ্যে আছে। এখনও এই অস্পষ্টতা আছে।

যা ঘটেছে তার রাজনৈতিক পটভূমি আলোচিত হচ্ছে না। কী ধরণের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই ধরণের আইনি/বেআইনি, প্রকাশ্য/অপ্রকাশ্য সেন্সরশিপ থাকে তা সহজেই বোধগম্য। সেই রাজনীতি অবশ্যই গণতান্ত্রিক নয়। অনেক মিডিয়া থাকলেই তা মত প্রকাশের স্বাধীনতা বোঝায় না। মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মিডিয়ার স্বাধীনতা এমন কোনো বিষয় নয় যে তা রাজনীতির বাইরে থেকে অর্জন করা যাবে।

গণতন্ত্র অনুপস্থিত কিন্তু মিডিয়া স্বাধীন এমন দেশের সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের অবস্থা অনুসরণ করে যে সব প্রতিষ্ঠান তাদের দেওয়া তথ্যে দেখা যায় যে, মূলধারার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা যখন সংকুচিত হয় সেই একই সময়ে সাইবার স্পেসেও মানুষের কথা বলার অধিকার হ্রাস পায়। আবার সাইবার স্পেসে যখন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় তখন আলাদা করে গণমাধ্যম স্বাধীনতা ভোগ করে না। ফ্রিডম হাঊসের হিসাবে দেখা যায় যে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশের ‘ফ্রিডম অন দ্য নেট’ আগের বছরের চেয়ে পাঁচ পয়েন্ট হ্রাস পেয়েছে, ৪৯ থেকে ৪৪ এ নেমে এসেছে। একইভাবে সামগ্রিকভাবে সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতা বা ফ্রিডম অব প্রেসের স্কোরও কমেছে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স-এর ২০১৯ সালের হিসাবে দেখা যায় যে, ২০১৮ সালের চেয়ে বাংলাদেশ চার ধাপ নিচে নেমেছে। এগুলো আবার সামগ্রিকভাবে মানুষের নাগরিকের অধিকার বা রাজনৈতিক অধিকার থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। বাংলাদেশে আইনের শাসনের অবনতি ও প্রেস ফ্রিডমের অবনতি একই সূত্রেই বাঁধা।

এই প্রজ্ঞাপন বিষয়ে সাংবাদিকদের কারো কারো প্রতিক্রিয়া দেখে উদ্বেগের মাত্রা বাড়ে। কোনো কোনো সাংবাদিক লিখেছেন যে, গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে যেহেতু গুজবের বা অপপ্রচারের অভিযোগ ওঠেনি সেহেতু এই ধরণের মনিটরিংয়ের দরকার নেই, কিন্তু, তার ভাষ্য অনুযায়ী ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক গুজব ছড়ানো হচ্ছে’। এই ধরণের কথাবার্তা বিপজ্জনক। এটি প্রকারান্তের সামাজিকমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের এক ধরণের খোলামেলা আমন্ত্রণ। সরকার সেই পথেই অগ্রসর হয়েছে, যে কারণে সংশোধিত ভাষ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেই হুমকির মুখে রেখেছে।

এই সরকারি ঘোষণার আগেই আমার দেখতে পাচ্ছি যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সরকারি মহাবিদ্যালয়ের দু-জন শিক্ষক বরখাস্ত হয়েছেন। একটি নিউজ পোর্টাল সেই খবর দিয়েছে এভাবে – ‘নভেল করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সরকারের ‘সমন্বিত উদ্যোগের’ মধ্যে এ নিয়ে ফেসবুকে ‘উস্কানিমূলক’ বক্তব্য ও ছবি পোস্ট করায় বরখাস্ত হয়েছেন সরকারি কলেজের দুই জন শিক্ষক’। আগে একজন ডাক্তারকে আটক করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সামাজিকমাধ্যমে কথা বলার অভিযোগ আনা হয়েছে। যারা টেলিভিশন চ্যানেলের ওপর থেকে নজরদারির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সময় বলছেন যে, এখন পর্যন্ত গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে এই ধরণের অভিযোগ ওঠেনি, তারা পরোক্ষভাবে এই কথাই কি বলছেন যে, অভিযোগ উঠলেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ বৈধ?

সরকার টেলিভিশন চ্যানেলের ওপরে ঘোষণা দিয়ে নিয়ন্ত্রণের যে আদেশ দিয়েছিল তা বাতিল করেছে। কিন্তু, সাংবাদিকদের কেবল একটি প্রজ্ঞাপন বাতিলে আনন্দিত না হয়ে, সব ধরণের ‘মনিটরিংয়ের’— প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য—বিরুদ্ধে দাঁড়ান জরুরি— তাদের অস্তিত্বের স্বার্থেই। যে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অবধারিতভাবেই মিডিয়ার স্বাধীনতা থাকবে না তার পক্ষে কথা বলে কেবল একটি প্রজ্ঞাপনের জন্যে আমলাদের শাপশাপান্ত করে লাভ নেই। কালকে ভিন্নভাবে এই প্রজ্ঞাপন জারি হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিংবা না জারি করলেই কি— আমরা তো জানি, ‘গণমাধ্যম ২৪ ঘণ্টা মনিটর করা হয়, হচ্ছে’।

 

আলী রীয়াজ, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো

[email protected]

 

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Why university rankings should matter

Why university rankings should matter

While no ranking platform is entirely comprehensive or flawless, it is better to participate in reliable ones.

6h ago