মানব মনের ‘কদর্য’ মৃত্যুকে করেছে বড়ই অসুন্দর
হাজার বছর ধরে গড়ে উঠা মানব সভ্যতা, ধর্ম, নীতিবোধ, সামাজিক মূল্যবোধ, মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস, সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই সভ্যতা মৃত্যুকে দিয়েছিল একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ, একটি আনুষ্ঠানিক মর্যাদা কিন্তু মানুষের ‘দানবসত্তা’ সেই মর্যাদাকে এক নিমিষেই করেছে ভূলুণ্ঠিত।
এ কথা সত্যি যে মহামারি, যুদ্ধ, বড় বড় দুর্যোগে মানুষের লাশ, এখানে সেখানে পড়ে থাকতে দেখা যায়, নদীতে ভাসে, শিয়াল কুকুর টেনে নিয়ে যায় কিন্তু সেটাও অনেক আগের চিত্র। মানব সভ্যতা সেখান থেকে অনেক এগিয়ে গেছে। গত ৫০ বছরে আমাদের দেশও অনেক এগিয়েছে, উন্নতি করেছে। তাহলে আগের সেই সব দৃশ্য তো এখন আর কাম্য নয়।
একটি ভাইরাস যা সারাবিশ্বে ত্রাসের সৃষ্টি করেছে, মহামারি হিসাবে দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করেছে। সেই ভাইরাস এক নিমেষেই কেড়ে নিয়েছে মানুষের সকল বিশ্বাস। কেড়ে নিয়েছে মানুষের মৃত্যুর প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা।
মানুষ মরে গেলে তার ধর্ম অনুযায়ী মর্যাদার সঙ্গে শেষ বিদায় দেওয়ার যে রীতি গড়ে উঠেছিল, বলতে গেলে সেই মর্যাদাটুকুও পাননি বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী যিনি গত শুক্রবার রাতে সর্দি, জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্টে ভুগে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন।
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ৪৫ বছরের ওই লোক থাকতেন গাজীপুরে। করতেন ক্ষুদ্র ব্যবসা। মঙ্গলবার বাড়ি আসেন। বুধবার রাতে তার সর্দি, কাশি, জ্বর বেড়ে যায়। রাতে শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। ঘরে অসহায় স্ত্রী প্রতিবেশীদের ডেকেছেন, কেউ আসেনি। শহরের তিনটি হাসপাতালের হেল্পলাইনে ফোন করেছেন কেউ আসেনি। পরে আইইডিসিআরের হটলাইনে ফোন করেছেন, কেউ রিসিভ করেননি।
রাত চলে গেছে, সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে, দুপুর থেকে সন্ধ্যা। মৃতদেহ নিয়ে ঘরে একা কেঁদে চলেছেন তার স্ত্রী। না এসেছেন ডাক্তার না কোন প্রতিবেশী। মানুষ মরে গেলে সমবেদনা প্রকাশের যে রীতিও তাও যেন ভূলুণ্ঠিত হলো।
সৎকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক পুলিশ কর্মকর্তার কাছে জানতে পারলাম জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ (সিভিল সার্জন অফিস) এক ভয়ঙ্কর রকমের দীনতার প্রকাশ ঘটিয়েছে এখানে। মানুষটি মারা যাওয়ার কথা জানতেন সিভিল সার্জনসহ বড় দুইটি হাসপাতালের কর্মকর্তারা, কিন্তু কেউ সেই রোগীকে দেখতে যায়নি। না মৃত্যুর আগে, না মৃত্যুর পরে। গণমাধ্যমে খবর প্রচারের পরও কাউকে পাঠায়নি জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ।
নমুনা সংগ্রহ করা হবে বলে সকাল সাতটা থেকে পুলিশ বাড়িটি পাহারা দিয়েছে। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে শিবগঞ্জ থানার ওসি বিরক্ত হয়ে আমাকে ফোন করে বললেন, ভাই একটু সিভিল সার্জনকে ফোন করে বলেন না তারা নমুনা সংগ্রহ করবে কিনা?
শিবগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাকে ফোন করলাম, লাশ কি দাফন করা হয়েছে? তিনি জানান বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ থেকে একটি টিম যাচ্ছে নমুনা সংগ্রহের জন্য।
পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম মেডিকেল কলেজ থেকে কোনো টিম যায়নি। তার পরিবর্তে শিবগঞ্জ উপজেলা থেকে এক ল্যাব টেকনিশিয়ানকে পাঠানো হয়। তিনি সন্ধ্যার আগে কোনো রকমে নমুনা সংগ্রহ করেন। সিভিল সার্জন একটি ব্যাগ ও সংগ্রহ করতে পারেননি মৃত ব্যক্তির জন্য। পরে পুলিশের একটি ব্যাগে করে মরদেহ কবরে নেওয়া হয়েছে।
এর পরে সমস্যা দেখা দিলো যখন পরিবার এবং পুলিশ মৃত ব্যক্তিটিকে দাফন করতে গেলেন। বাড়ির পাশের যে কবরস্থানটি ছিল সেখানে দাফন করতে দিলেন না প্রতিবেশীরা।
পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলমগীর কবির গেলেন ঘটনাস্থলে। গিয়ে দেখলেন, আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন সভাপতি হাজারো লোক জড়ো করেছেন। তার এলাকায় দাফন হতে দেবেন না। পরে বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে খাস জমিতে পুলিশ পাহারায় দাফন হয় সেটাও রাত ৮ টার সময়।
দাফনের সময় আনুষ্ঠানিকভাবে হলো না জানাজা। এলাকার কোনো মৌলভী এগিয়ে এলেন না। কবর খোঁড়ার জন্যও পাওয়া গেল না কাউকে। পরে পুলিশের দুজন উপপরিদর্শক, উপজেলা প্রশাসন থেকে আসা দুজনকে নিয়ে কবর খোঁড়েন। পুলিশের এক কনস্টেবল ও উপজেলা চেয়ারম্যান মুনাজাত করেন। পুলিশের কয়েকজন সদস্য, ইউএনও, লাশ বহন থেকে কবর খোঁড়ার সঙ্গে যুক্ত তিন জন মানুষ ছিলেন জানাজায়।
সরকারি আদেশ রয়েছে গণজমায়েত করা যাবে না। কিন্তু যিনি দাফনে বাধা দিলেন সেই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা হাজার হাজার লোক তো ঠিকই জড়ো করলেন।
দাফন শেষে এই বীভৎস ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন বগুড়ার সহকারী পুলিশ সুপার কুদরত-এ খুদা শুভ। ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসে তিনি যা লিখেছেন তার সারকথা …একটা লাশ দাফনে স্থানীয় মানুষদের বোঝানোর জন্য এর আগে পুলিশকে এতটা গলদঘর্ম হতে হয়নি কখনো। কিছু দুষ্ট লোক হাজার হাজার মানুষ জড়ো করেছেন, দাফনে বাধা দিয়েছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ সুপারকে অতিরিক্ত দুই প্লাটুন স্পেশাল আর্মড ফোর্স পাঠাতে হয়েছে। অনেক নাটকীয়তার পর প্রটোকল মেনে অবশেষে দাফন করতে রাত হয়ে গেছে। এই ঘটনাটি কাল আপনার সঙ্গে ঘটলে কেমন লাগবে ভেবে দেখুন?
ইউএনও তো বলেই ফেললেন, মানুষ এত নিকৃষ্ট, নির্মম হতে পারে?
ডেপুটি সিভিল সার্জন আমাকে বললেন, যিনি মারা গেছেন তিনি হয়ত করনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন না। আইইডিসিআরে ফোন করে শুনেছেন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির সর্দি থাকেনা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই অব্যবস্থাপনার দায় কার? এত সময় পাওয়ার পরেও স্বাস্থ্য বিভাগের এই দীনতা কেন? মানুষের মৃত্যুকে আমরা পরিহাসের বিষয় বানিয়েছি কেন? বগুড়া শহরের বড় বড় বেসরকারি ক্লিনিক–হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকরা রোগী দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। ফোন করলে কেউ সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসছেন না কেন?
করোনায় আক্রান্ত হয়ে আজ রোববার পর্যন্ত সারা বিশ্বে ৩০৮৭৯ জন মানুষ মারা গেছেন। আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছয় লাখ ৬৩ হাজারেরও বেশি। ইতালিতে গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছে ৮৮৯ জন। আশার কথা হলো গত দুই দিনে বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত কেউ শনাক্ত হয়নি। এখনও আমাদের দেশের অবস্থা অনেক ভালো আছে। এখনও আমাদের হাতে অনেক সময় আছে। করোনায় যা করণীয় তার যথাযথ ব্যবস্থা নিলে হয়ত মৃত্যুর পর হলেও মানুষকে সম্মান দিতে পারব।
মোস্তফা সবুজ: দ্য ডেইলি স্টারের নিজস্ব সংবাদদাতা, বগুড়া
Comments