অধ্যাপক হোসেন উদ্দিন শেখর

‘মানুষের বিশ্বাসের পরিবর্তন আনতে হলে সরকারকে গ্রহণযোগ্য তথ্য দিতে হবে’

Hossain Shekhar Final-1.jpg
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিভাগের অধ্যাপক হোসেন উদ্দিন শেখর। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

দেশে প্রথম করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। এর পর থেকে আজ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৪৮ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন মাত্র ৫ জন। এ ছাড়া, এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়ে ১৫ জন বাড়ি ফিরে গেছেন বলে জানিয়েছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।

ওয়ার্ল্ডোমিটারস বলছে, সারাবিশ্বে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৭০৫ জন। মারা গেছেন ৩১ হাজার ৭৩৭ জন। সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩১৯ জন। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ২৩ হাজার ৭৮১ জন এবং ইতালিতে মারা গেছেন ১০ হাজার ২৩ জন।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলো করোনার ভয়াল থাবায় মুমূর্ষু প্রায়, আইইডিসিআরের ‘তথ্য’ অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থা বেশ ভালোই বলা চলে। যদিও এদেশের জনমনে রয়েছে বিশ্বাসের অভাব। তারা কোনোভাবেই মানতে চাইছেন না যে, গত দুই দিনে দেশে নতুন করে করোনা আক্রান্ত একজনও শনাক্ত হয়নি।

দেশে করোনাভাইরাসে শনাক্তের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশকারীদের উদ্দেশে তাই আজ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেককে বলতে হলো, ‘অনেকে বলছে, সংখ্যা এত কম কেন। কেন, সংখ্যা বেশি হলে কি আমরা খুশি হই? আমরা কি চাই বেশি বেশি লোক সংক্রমিত হোক? বেশি বেশি লোক মৃত্যুবরণ করুক? আমরা তো চাই আমাদের দেশের লোক সংক্রমিত না হোক। আমাদের দেশের লোক মৃত্যুবরণ না করুক। এটিই সবচেয়ে বড় বিষয়।’

এসব বিষয় নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিভাগের অধ্যাপক হোসেন উদ্দিন শেখরের সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের কথা হয়।

অধ্যাপক হোসেন উদ্দিন শেখর বলেন, প্রাথমিকভাবে তিনটি কারণ আমি মনে করি। প্রথমত হচ্ছে যে, বাংলাদেশে ভাইরাসটির বিস্তৃতি কতটা ঘটেছে সেটি জানার জন্য আমাদের পরীক্ষার কিট ছিল না। যখন বিস্তার ঘটে তখন মানুষ জানত না যে টেস্ট করাতে হবে। দ্বিতীয়ত যখন জানা গেলে যে, টেস্ট করানো উচিত। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমাদের পর্যাপ্ত সনাক্তকরণ কিট নেই। তৃতীয়ত হলো, যে কিটগুলো আসছে সেগুলো সঠিক ফলাফল দিচ্ছে কি না? অর্থাৎ ফলস পজিটিভ রেজাল্ট অথবা ফলস নেগেটিভ রেজাল্ট দিচ্ছে কি না? এটি নিয়ে আমরা সংশয়ে আছি।

এই তিনটির বাইরে চতুর্থত হলো যে,  নিশ্চিত হতে গেলে যে পরীক্ষাটি করতে হয় তাকে বলে আরটিপিসিআর (রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টজ পালিমারেজ চেইন রিয়্যাকশন)। যদি আরটিপিসিআর আপনি করতে পারেন তাহলে জানা সম্ভব। তবে মেশিনটি অনেক দামী এবং পরিচালনা করার মতো লোকবল আমাদের নেই। সে ধরনের ল্যাবরেটরি আমাদের নেই। যার ফলে নিশ্চিতভাবে পরীক্ষা করে বলা কঠিন। এই কারণে আমরা আক্রান্তের সঠিক সংখ্যা জানতে পারছি না।

আইইডিসিআর আজ পর্যন্ত বলছে যে, দেশে মাত্র ৪৮ জন শনাক্ত হয়েছে। মুশকিল হলো কী, এই শনাক্তকরণ পদ্ধতিটা যদি সহজলভ্য না করা হয়, যদি সর্বত্র পরীক্ষার জায়গা না থাকে, তাহলে ওইসব জায়গাগুলোতে তো মানুষ আসতে পারবে না। প্রত্যন্ত অঞ্চলে, গ্রামে, গঞ্জে, সব জায়গার স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে এই সুবিধা থাকা উচিত ছিল। যেমন: ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীরা গ্লুকোমিটার স্ট্রিপ দিয়ে ঘরে বসে টেস্ট করে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ জানতে পারেন। তেমনই করোনাভাইরাস শনাক্তের জন্যও স্ট্রিপ আছে। তবে স্ট্রিপের প্রদানকৃত ফল নিয়ে সংশয় রয়েছে। কেউ বলেছেন এটি ৭০ শতাংশ ভুল ফল দেয়, আবার কেউ বলেছেন ৩০ শতাংশ ফল ভুল দেয়। এই সংশয় এড়ানোর জন্য আরটিপিসিআর’র প্রয়োজন, যা আমাদের দেশে এখনও পর্যাপ্ত নেই। যার ফলে সারাবিশ্বে যেভাবে প্রচুর রোগী শনাক্ত হচ্ছে, যেমন: ইতালিতে, স্পেনে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিনিয়ত যেভাবে শনাক্ত হচ্ছে, ওই মাত্রায় দেশে স্ক্রিনিং আমরা করতে পারছি না। আমাদের হাতেগোনা কয়েকশ কিট রয়েছে এবং যেগুলো আসছে সেগুলো করোনা শনাক্তকরণে কতোটা নির্ভরযোগ্য ফল দেবে তাও আমরা নিশ্চিত নই।

সত্যিকার অর্থে এটি একটি বিপর্যয়। এই বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য আমাদের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। এখন যে প্রস্তুতিগুলো নেওয়া হচ্ছে সেগুলো অপর্যাপ্ত। যেহেতু ভাইরাসটির দ্রুত বিস্তৃতি হচ্ছে, সে তুলনায় আমদের প্রস্তুতি সেরকম নেই বিধায় আমরা সঠিক পরিস্থিতি আঁচ করতে পারছি না। যেখানে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো কিছু কিছু ক্ষেত্রে সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। যেমন: তাদের ভেন্টিলেটর নেই। আক্রান্ত শনাক্ত করার পরপরই তো আর সমস্যার সমাধান হয়ে গেল না। এরপর রোগীকে কোয়ারেন্টিন করতে হবে, তাকে আইসিইউ সাপোর্ট দিতে হতে পারে, ভেন্টিলেশনে নেওয়া লাগতে পারে। সেখানে আমাদের তো ভেন্টিলেশনই নেই। লন্ডনের মতো জায়গায় ভেন্টিলেশন সংকট দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায় তারা ফোর্ডের মতো বড় বড় গাড়ি প্রস্ততকারক কোম্পানিগুলোকে বলছে ভেন্টিলেটর তৈরি করে দিতে। কোম্পানিগুলো এককথায় রাজিও হলেও বলেছে যে ভেন্টিলেশন তৈরি করতে দু-তিন সপ্তাহ লেগে যাবে। কিন্তু যে হারে আক্রান্ত বাড়ছে ততদিনে তো অনেক রোগী মারা যাবে। কারণ ভেন্টিলেশন একটি জরুরি সেবা, তাৎক্ষণিক এই সাপোর্টটি দিতে হয়।

এই ক্ষেত্রে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে যেখানে অর্থাভাব আছে, প্রশিক্ষিত লোকবলের অভাব আছে, বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি আছে এবং লোক নিয়োগে ব্যর্থতা আছে, সেখানে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে আমাদের একটি বড় গ্যাপ থেকে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ আমাদের পূর্বপ্রস্তুতি বলে কিছু ছিল না। এই বিপর্যয়  এসেছে, আমাদের প্রস্তুতি নিতে দেরি হয়ে গেছে। যদিও আমরা যথেষ্ট সময় পেয়েছিলাম। গত ডিসেম্বর থেকে আমরা সময় পেয়েছিলাম প্রস্তুতি নেওয়ার। ডিসেম্বর থেকেই ভাইরাসটি বিশ্বব্যাপী ছড়ানো শুরু হয়েছে। কিন্তু আমরা সতর্ক হয়েছি মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহের পর থেকে। আমরা অনেক দেরি করে সতর্ক হওয়ার কারণে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে অনেকদূর।

আইইডিসিআর গতকালের পর আজও বলেছে দেশে নতুন আক্রান্ত কোন রোগী নেই।

এই প্রশ্নটি আমারও। অন্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে কেন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে না? আমরা এর আগে দেখেছি যে কলেরার মতো পানিবাহিত রোগে আমাদের গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে গেছে। ভাইরাস আরও দ্রুত ছড়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) যেখানে মহামারি ঘোষণা করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশে লক্ষাধিক লোক আক্রান্ত হয়েছে, সেখানে আমাদের মত উচ্চ ঘনবসতিপূর্ণ দেশে কেন আক্রান্তের সংখ্যাটি বাড়ছে না, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

একটি বড় কারণ, আমাদের দেশে স্ক্রিনিংই হচ্ছে না। আমরা আসলে জানি না যে, কে আক্রান্ত আর কে আক্রান্ত না। অনেকগুলো কারণে মানুষ স্ক্রিনিং করতে আসতে চায় না, এর মধ্যে ভয়ও আছে। বাংলাদেশে বহু মানুষ হাইপারটেনশনে ভুগলেও তারা কোনদিন ব্লাড প্রেশার মাপে না, চিকিৎসকের কাছে যায় না, এমনকি ওষুধও খায় না। অথচ ব্লাড প্রেশার মাপা এক মিনিটের বিষয়। এর কারণ হলো, আমাদের দেশে চিকিৎসকের কাছে যাওয়াও একটা ভীতিকর ব্যাপার। করোনাভাইরাস পরীক্ষার ক্ষেত্রে অনেক কারণ রয়েছে, একে তো দেশের মানুষ চিকিৎসকের কাছে যেতে চায় না, দ্বিতীয়ত শনাক্তকরণে উপযুক্ত কিট নেই।

আর করোনাভাইরাস যখন বাংলাদেশে এসেছে, যখন সতর্ক হওয়ার জন্য আদর্শ সময় ছিল, তখন সরকারের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলেছে যে, এটি একটি সাধারণ ফ্লু ভাইরাস। ফ্লু-এর চেয়ে বেশি কিছু করার ক্ষমতা এর নেই। সেসময় আমরা বিষয়টিকে অত্যন্ত হালকাভাবে নিয়েছি। তখনও আমরা বুঝিনি যে, এত অল্প সময়ে পরিস্থিতি এরকম ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। আমরা এটিকে ফ্লু-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছিলাম। তখন আমরা বলেছিলাম এটি এক ধরনের সিভিয়ার অ্যাকুইট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (সার্স) ভাইরাসের জ্ঞাতি ভাই। কিন্তু করোনাভাইরাসের যে ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব ও প্রাণঘাতী ক্ষমতা তা আমরা তখন বুঝতে পারিনি।

আমরা এখনও কি বুঝতে পেরেছি? আমাদের সরকার কি পেরেছে?

আসলে একমাত্র সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলেই যে এই পরিস্থিতির উত্তরণ হবে তা নয়। সরকারেরও তো অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে। এখন সরকার যেটি করতে পারে তা হলো- যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মত আমাদের দেশেও বড় বড় শিল্পপতিদের ডাকতে পারে। ওইসব দেশে শিল্পপতিরা যেভাবে এগিয়ে এসেছে, আমাদের দেশেও আসবে বলে মনে হয়। কিন্তু এদের কাছ থেকে সহায়তা নেওয়ার জন্য, তাদের ব্যবহার করার জন্য সরকারকে বিশেষ কিছু করতে হবে। যেমন: তথ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও সাংবাদিকদের একসঙ্গে করে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মাল্টি ডিসিপ্লিনারি ও মাল্টি সেক্টরাল কমিটি করে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য প্রদান করতে হবে। কারণ এই যে আইইডিসিআর বলছে, দেশে করোনা আক্রান্ত রোগী মাত্র ৪৮ জন, মানুষ তো তা বিশ্বাস করছে না। সরকার তো আর মানুষের বিশ্বাসের উপর জোর দিতে পারবে না। মানুষকে মারধর করে হয়তো নিয়মের মধ্যে আনা যাবে, কিন্তু তার বিশ্বাসকে তো বদলানো যাবে না। দেশের মানুষের বিশ্বাসের পরিবর্তন আনতে হলে সরকারকে গ্রহণযোগ্য তথ্য দিতে হবে।

একজন দায়িত্বশীল বা আস্থাবান ব্যক্তি যখন কথা বলেন, তখন মানুষ তা বিবেচনা করে তার উপর বিশ্বাস রাখতে পারে। এখন সরকারের জরুরিভাবে ওইরকম কোনো বিশ্বস্ত কমিটি গঠন করা উচিত। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী আক্রান্ত হয়েও মানুষের সামনে কথা বলতে আসছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও চীনের প্রেসিডেন্ট দেশবাসীকে প্রতিনিয়ত আশ্বস্ত করছেন। আমাদের দেশে যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর প্রতি মানুষের আস্থা আছে, তিনি এসে যদি সঠিক তথ্য তুলে ধরেন তাহলে মানুষ বিশ্বাস করতে পারে। কারণ আমাদের তো বাস্তবতা স্বীকার করে নিতে হবে। পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যায়, তারপরও তা স্বীকার করতে হবে। আমাদের সব ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে মোকাবিলা করতে হবে। আমরা যদি চোখ বন্ধ করে রাখি তাও আমাদের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে, খুলে রাখলেও হতে হবে। তবে চোখ খুলে রেখে পরিস্থিতি সামাল দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে, পরিস্থিতির স্বচ্ছ বিবরণ দিতে হবে এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। যত বড় ক্ষতিই হোক, আমাদের সবকিছু স্বীকার করে নিয়ে এগুতে হবে। এছাড়া আমাদের আর কোনো গতি নেই।

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

42m ago