গরিব পেটানোর মূলেও আইনের শাসনহীন বিচারহীনতা

মানুষকে অপমান-অসম্মান ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার মধ্যে এক ধরনের আনন্দের উপলক্ষ লুকিয়ে থাকে। বিশেষ করে ক্ষমতাবানরা ক্ষমতাহীন দরিদ্রদের নিপীড়ন করে আনন্দ পায়। এই আনন্দের হয়ত নৃতাত্ত্বিক-সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখা বা বিশ্লেষণ আছে। তা না হলে রীতি কিছুকাল অনুপস্থিত থেকে আবার ফিরে আসবে কেন!
Punishment
ছবি: সংগৃহীত

মানুষকে অপমান-অসম্মান ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার মধ্যে এক ধরনের আনন্দের উপলক্ষ লুকিয়ে থাকে। বিশেষ করে ক্ষমতাবানরা ক্ষমতাহীন দরিদ্রদের নিপীড়ন করে আনন্দ পায়। এই  আনন্দের হয়ত নৃতাত্ত্বিক-সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখা বা বিশ্লেষণ আছে। তা না হলে রীতি কিছুকাল অনুপস্থিত থেকে আবার ফিরে আসবে কেন! বাংলাদেশের মানুষ তো ভুলে যায়নি সামরিক শাসনকালের কথা। কার চুল বড়-কার নখ, কে শাড়ি কিভাবে পড়লেন, সেসব অভিনব কুৎসিত শাস্তির কথা নিশ্চয় স্মরণে আছে। কিন্তু, বিষয়টি যে বেসামরিক প্রশাসন এতটা রপ্ত করেছে নিয়েছে, তা হয়ত এতটা দৃশ্যমান ছিল না।

একজন প্রধান শিক্ষককে কান ধরে উঠ-বস করিয়ে সংসদ সদস্যের বিনোদিত হওয়ার সংবাদে দেশের মানুষ বিচলিত হয়েছিলেন। তারপর আস্তে আস্তে নীরববতা নেমে এসেছে। কিন্তু, ‘সোলে‘র গব্বর সিংদের উল্লাসের রীতি যে তারা প্রায় নিয়মে পরিণত করে নিয়েছেন, এতটা জানা ছিল না।

ফলে গত কয়েকদিনের কিছু ভিডিও ও স্থিরচিত্র দেখে অস্থিরতা অত্যাধিক মাত্রায় বেড়ে গেছে। এই অস্থিরতা করোনা অস্থিরতা বা আতঙ্কের চেয়ে বেশি, অনেক বেশি। এটা ঠিক অস্থিরতাও নয়, এক ধরনের তীব্র কষ্ট-বেদনা-যন্ত্রণা। যা ঠিক ভাষা দিয়ে বোঝানো যায় না। যেমন, যশোরের সাংবাদিক সাজেদ রহমান ফেসবুকে একটি ছবি পোস্ট দিয়ে লিখেছিলেন, ‘...ছবিটি দেখে আমি স্থির থাকতে পারছি না। আমি তার শাস্তি দাবি করছি।’

ছবিটি ভাইরাল হয়েছে। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে একজন নারী ছবি তুলছেন বা ভিডিও করছেন। দরিদ্র-নিঃস্ব এক বৃদ্ধ কান ধরে উঠ-বস করছেন। যিনি কান ধরে উঠ-বস করাচ্ছেন- ছবি তুলছেন তিনি একজন সরকারি কর্মচারি, এসি ল্যান্ড। যাকে কান ধরে উঠ-বস করানো হচ্ছে তিনি একজন ভ্যানচালক। বয়সে এই এসি ল্যান্ডের বাবা বা দাদার সমান।

এই সমাজ আমাদের শিখিয়েছিল, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের শিখিয়েছিল, বড়দের-মুরব্বিদের সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে হবে। এই এসি ল্যান্ড যে সমাজে বড় হয়েছেন, যে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, সেখানে কী এই শিক্ষা পাননি? পাওয়ার কথা, হয়ত পেয়েছেনও। তাহলে কি প্রশাসনে যোগ গিয়ে পূর্বের সব শিক্ষা ভুলে গেছেন? নিশ্চিত করে মন্তব্য করা যায় না, একজনকে দিয়ে সবার মূল্যায়ন করাও যৌক্তিক নয়। কিন্তু তারপরও গত কয়েকদিনের ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করলে, মোটামুটি একটি মূল্যায়ন হয়ত করা যায়। বেসামরিক প্রশাসনে যারা যোগ দিচ্ছেন, তারা নিজেদের অবিশ্বাস্য রকমের ক্ষমতাবান ভাবছেন। তা শুধু ভাবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখছেন না, প্রয়োগেও তা দৃশ্যমান করছেন। চলমান রাষ্ট্র পরিচালনা পদ্ধতি তাদেরকে এমনটা ভাবতে উদ্বুদ্ধ করছে। কুড়িগ্রামের ডিসি, আরডিসি, পাংশার সেই সহকারী এসপি, যশোরের এই এসি ল্যান্ড সারা দেশে চলমান ঘটনার বিচ্ছিন্ন কিছু নমুনা মাত্র। অথচ এরা সবাই জানেন, সংবিধান অনুযায়ী এমন শাস্তি দেওয়া যায় না। মানুষকে এমন শাস্তি দিয়ে তারা প্রচলিত আইন অনুযায়ী অপরাধ করেছেন।

২.

রাস্তায় পুলিশ নির্দয়ভাবে দরিদ্র মানুষদের পেটালো। চর-ঘুষি-লাথি, কান ধরে উঠ-বস করানো কোনো কিছু বাদ রাখছে না। লাঠি দিয়ে পেটানো হচ্ছে দিনমজুর ভ্যানচালক বা রিকশা চালকদের। লাঠির আঘাতে কারো কারো পিঠ ফুলে লাঠির আকার ধারণ করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেসব ভিডিও-ছবি ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষের বেদনা-যন্ত্রণার চাপা ক্ষোভ ‘শাস্তি চাই’র মধ্যে সীমাবদ্ধ।

এর মধ্যে নজরে এলো পুলিশের আইজি পুলিশ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, ‘...দায়িত্ব পালনকালে সাধারণ জনগণের সঙ্গে বিনয়ী, সহিষ্ণু ও পেশাদার আচরণ বজায় রাখুন’।

প্রশ্ন হলো, পুলিশ সদস্যদের কি এসব কথা জানা নেই? আগে তারা জানেনি বা শেখেনি? তাদের প্রশিক্ষণে কি এসব শেখানো হয় না? যদি হয়েও থাকে, প্রক্রিয়ায় যে সমস্যা আছে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। তারপরও আইজিপির এই নির্দেশনা প্রশংসার দাবি রাখে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়। আইজিপি তার নির্দেশনা সেইসব পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে কিছু বলেননি, যারা দরিদ্র মানুষের অপমান-অসম্মান করেছেন, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন, পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছেন। আইনের মানুষ হয়ে তারা কাজ করেছেন সম্পূর্ণ বেআইনি। বেআইনি কাজ মানে অপরাধমূলক কাজ। পুলিশ সদস্যরা প্রচলিত আইন অনুযায়ী অপরাধ করেছেন। অপরাধীকে শাস্তির আওতায় না এনে, শুধু উপদেশ যে কোনো কাজে আসে না, তা অন্য যে কারো চেয়ে ভালো জানেন আইজিপি। কিন্তু, এক্ষেত্রে তিনি তার সদস্যদের প্রতি নীতি নিয়েছেন দায়মুক্তির।

করোনা আতঙ্কের কালেও থানায় পিটিয়ে মানুষ হত্যার অভিযোগ এসেছে। হত্যার পর আত্মহত্যা বলে চালানোর অভিযোগ এসেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি।

এসি ল্যান্ডদের পরিচালনাকীরী প্রশাসন তাকে ‘প্রত্যাহার‘ করে নিয়েছেন। ‘প্রত্যাহার‘ যদি কোনো শাস্তি হতো, তবে প্রশাসনে এমন ঘটনা নিয়মিত বিরতিতে ঘটতো না। এধরণের তথাকথিত ‘শাস্তি‘ ও ‘তদন্ত‘ সাপেক্ষে ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি আসলে এক ধরণের কুকৌশল। যার মধ্য দিয়ে অপরাধ সংঘটনকারীরা আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে থাকেন। সারা দেশেই জনগণের এসব কর্মচারীরা মানুষকে অপমান-অসম্মান ও নিপীড়ন করছেন। যে দু-একটি ঘটনা প্রমাণসহ সামনে আসে, সেগুলোর ক্ষেত্রেই শুধু ‘প্রত্যাহার‘ জাতীয় আইওয়াশ দৃশ্যমান হয়। প্রমাণ ছাড়া অভিযোগ ধর্তব্যের মধ্যেই নেওয়া হয় না। যশোরের এই অপরাধের যদি ছবিসহ প্রমাণ না থাকতো, তবে প্রত্যাহার তো দূরের কথা স্বীকারই হয়ত করা হতো না।

৩.

প্রশাসনের কর্মকর্তাদের যা করার কথা নয়, তা করে আলোচনায় আসছেন মূলত ‘ভ্রাম্যমান আদালত’কে কেন্দ্র করে। জেলা প্রশাসকদের এমন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যে, তারা ভ্রাম্যমাণ আদালত গঠন করে অভিযান পরিচালনা করতে পারেন। তাৎক্ষণিকভাবে জেল-জরিমানা করতে পারেন। যা কতটা সংবিধান সম্মত, প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে কতটা সাংঘর্ষিক, তা নিয়ে আলেচনা-সমালোচনা আছে। পূর্বে বিচারালয় থেকেও এসব প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। ‘ভ্রাম্যমাণ আদালত’ ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এরপর বহু কিছু ঘটে গেছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত চলছে। কুড়িগ্রাম থেকে যশোর, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমেই অপরাধ সংগঠিত হয়েছে। একথা সত্যি যে, ভ্রাম্যমাণ আদালত একটি জনপ্রিয় ব্যবস্থা। বিশেষ করে ভেজালবিরোধী অভিযান এই আদালতকে জনপ্রিয়তা দিয়েছে।

এই জনপ্রিয়তার মিল আছে ‘ক্রসফায়ার’র সঙ্গে। বিচার না পাওয়া মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে কিছু একটা পেতে চায়। পেলে খুশি হয়। বিচারহীনতার সংস্কৃতির দেশে শাসকরা সব সময় সেই সুযোগ নেয়। কিন্তু, ‘ক্রসফায়ার’র মাধ্যমে পৃথিবীর কোনো দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। সমাজে অনাচার-অনায্যতা বেড়েছে।

‘ভ্রাম্যমান আদালত’ দিয়েও সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না, যাবে না। বিচার প্রক্রিয়া একটি সামগ্রিক বিষয়, তাৎক্ষণিক কিছু নয়। একজন ডিসি বা এসি ল্যান্ডের শাস্তি পাওয়া বা চাওয়ার চেয়ে, দাবি জোরালো হওয়া দরকার ‘ভ্রাম্যমাণ আদালত’র বিষয়ে। কথা বলা দরকার আইনের শাসনহীন-বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে।

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

8h ago