করোনাভাইরাস

যুক্তরাষ্ট্রে যা ঘটতে পারে

ছবি: রয়টার্স

পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। ভাইরাসটির বর্তমান কেন্দ্রস্থল বলা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এরই মধ্যে চীন ভাইরাসটির সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এনেছে। শুরু থেকেই সতর্ক থাকায় সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং ও তাইওয়ানে করোনার প্রাদুর্ভাব বাড়েনি। তারা বেশ ভালোভাবেই এটির মোকাবিলা করতে পেরেছে। যা বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর জন্য দৃষ্টান্ত।

কোভিড-১৯ কে শুরুতে ঢিলেঢালাভাবে নিয়েছিল মার্কিন প্রশাসন। খেসারত হিসেবে প্রতিনিয়ত সেখানে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটির তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ১ লাখ ৩৯ হাজারের বেশি মানুষের মধ্যে মারা গেছেন প্রায় আড়াই হাজার।

ভাইরাসটি যুক্তরাষ্ট্রে বিধ্বংসী রূপ নিলে আজ থেকে এক বছর পরের চিত্র কেমন হতে পারে?

অনেকটা এরকম: কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ২০ লাখেরও বেশি মার্কিন নাগরিক। কারোরই শেষকৃত্য হয়নি। প্রতিনিয়ত আরও অনেকেই মারা যাচ্ছেন। হাসপাতালগুলো হার্ট অ্যাটাক, শ্বাসকষ্ট ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের ঠাঁই দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই।

মানুষ ঘর থেকে বেরোতে ভয় পাচ্ছে। ভঙ্গুর পরিস্থিতিতে অর্থনীতি। অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়েছেন লাখো মানুষ। ভাইরাসটির যথার্থ কোনো প্রতিষেধক এখনও আবিষ্কৃত হয়নি।

অন্যদিকে যদি যুক্তরাষ্ট্র ভাইরাসটি মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়, তাহলে আজ থেকে এক বছর পরে সেখানকার পরিস্থিতি কেমন হতে পারে?

অনেকটা এরকম: মানুষ ইতোমধ্যে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে। ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশটির অর্থনীতিও। উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে ভাইরাসটির সংক্রমণ কমে গেছে। অনেক রোগীই সেরে উঠেছেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় ওষুধ কাজ করছে। কয়েক হাজার মার্কিন নাগরিক মারা গেছেন। তবে, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যেই ভাইরাসটির প্রতিষেধক আবিষ্কার করে এটিকে পরাজিত করা সম্ভব হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে ইতিবাচক প্রেক্ষাপট

বসন্ত রোগ মোকাবিলায় যে চিকিৎসক দল কাজ করে সফল হয়েছেন, তাদেরই একজন ডা. ল্যারি ব্রিলিয়ান্ট। তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে ভালো হয় যদি ভাইরাসটিকে দুর্বল করে মেরে ফেলা যায়।’

করোনাভাইরাসের আগে সার্স ও মার্স সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব হয়েছিল। এটির ক্ষেত্রেও সেটি সম্ভব বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। স্ট্যানফোর্ড মেডিকেল স্কুলের অধ্যাপক ডা. চার্লেস জি. প্রোবার বলেন, ‘আমি আশাবাদী যে কোভিড-১৯ টিকে থাকবে না।’

করোনাভাইরাস মোকাবিলা করা সম্ভব, ইতিমধ্যে অনেক দেশই তা দেখিয়েছে। সাময়িক সময়ের জন্য হলেও তারা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। অবিশ্বাস্যভাবে চীনের অভ্যন্তরে বর্তমানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে না। যা থেকে বোঝা যায়, তারা কতটা সফলভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। তারা দেখিয়েছে, করোনা দমন করা যায়।

সিঙ্গাপুরসহ যে দেশগুলো করোনা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে তারা বেশকিছু জিনিস অনুসরণ করেছে। দেশগুলোতে ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হওয়ার আগে থেকেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়াটা এক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তীতে তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অসুস্থদের আইসোলেশনের ব্যবস্থা, শনাক্তদের সংস্পর্শে যারা এসেছিলেন তাদের শনাক্ত করা, এরপর তাদের কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা এবং পর্যাপ্ত তথ্য দেওয়া— এগুলোর সবই করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক ডা. টম ফ্রাইডেন বলেন, ‘করোনা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর যা করেছে, তা অন্যান্য দেশের জন্য দৃষ্টান্ত। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত ও জনসমাগম সীমিত করে যুক্তরাষ্ট্র করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে পারে। এক্ষেত্রে তারা সিঙ্গাপুরের কৌশলগুলোও অনুসরণ করতে পারে।’

ডা. ক্রিস্টোফার উইলিস নামে সিঙ্গাপুরের এক চিকিৎসক বলছেন, ‘সাধারণ মানুষ যদি দায়িত্বশীল হয় এবং কিছু মৌলিক নীতি মেনে চলে, তাহলে ভাইরাসটির সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব। তাদের উচিত শান্ত থাকা। অনেক মানুষের জন্যই এটি (করোনা) সাধারণ ঠাণ্ডা লাগার মতোই।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আবহাওয়া সহায়তা করতে পারে। গরমকালে তাপমাত্রা বেশি থাকায় শ্বাসতন্ত্রের অনেক ভাইরাসের সংক্রমণ কমে যেতে দেখা গেছে।

করোনা মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞরা ইবোলা, ম্যালেরিয়া ও এইচআইভির কিছু ওষুধের ব্যাপারে আশাবাদী। এ ছাড়া, পরীক্ষার জন্য তালিকায় আরও বেশকিছু ওষুধের নাম রয়েছে।

মার্কিন বিশেষজ্ঞ ডা. তারা সি. স্মিথ বলেন, ‘আট সপ্তাহ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারলেই ভাইরাসটির সংক্রমণ ধীর হয়ে যাবে। মানুষ কীভাবে তাদের অভ্যাস পরিবর্তন করছে, সেটির ওপরও ভাইরাসটির নিয়ন্ত্রণ নির্ভর করছে।’

তিনি বলেন, ‘যদি উষ্ণ আবহাওয়া এক্ষেত্রে সহায়ক হয়, যদি আমরা প্রয়োজনীয় ওষুধ পাই, যদি কোম্পানিগুলো বেশি ভেন্টিলেটর উৎপাদন করতে পারে, তাহলে করোনার সংক্রমণ রোধ সম্ভব।’

যুক্তরাষ্ট্রে নেতিবাচক প্রেক্ষাপট

যুক্তরাষ্ট্রে পরিস্থিতি খারাপ হলে ২০ লাখেরও বেশি মার্কিন নাগরিক প্রাণ হারাতে পারেন, এ পরিসংখ্যানের কথা জানিয়ে পরিস্থিতি ভালো হলে প্রাণহানির সংখ্যা কত হতে পারে বলে জানতে চাওয়া হয় ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ ডা. নেইল এম. ফেরগুসনের কাছে। তিনি বলেন, ‘১০ লাখেরও বেশি মানুষ।’

যখন পরিস্থিতি ভালো হলেও এত মানুষের প্রাণহানির কথা বলা হচ্ছে, তখন কতটুকু আশাবাদী হওয়া যায়?

ফেরগুসন বলেন, ‘এখনো করোনাভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। তাই দক্ষিণ কোরিয়াসহ অন্যান্য দেশগুলো যারা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করেছে, তারা কি আগামী ১৮ মাস তাদের এ সফলতা ধরে রাখতে পারবে?’

অনেকে ধারণা করছেন, যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্তের সংখ্যা যা বলা হচ্ছে, প্রকৃত সংখ্যা হয়তো আরও বেশি।

যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়া একই দিনে তাদের দেশে করোনা আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত করে। কিন্তু, দক্ষিণ কোরিয়া বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিলেও যুক্তরাষ্ট্র নেয়নি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে।’ তবে, প্রকৃতপক্ষে আদৌ কি তিনি সচেতন ছিলেন? তৎপর হয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছিল ট্রাম্প প্রশাসন? থাকলে, যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে কেন?

মিত্রে নামে একটি অলাভজনক স্বাস্থ্য সেবা সংস্থা বলছে, ইতালি ও ইরানসহ বেশকিছু দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হারে বাড়ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা। হার্ভার্ড স্টাডির তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে করোনা রোগীদের জন্য একসঙ্গে তিন লাখ ৬৬ হাজারের মতো আইসিইউ বেড দরকার হতে পারে। বলা হচ্ছে, সেখানে বর্তমানে যেকটি আইসিইউ আছে, প্রয়োজন তারচেয়ে ১০ গুণ বেশি।

তাই যুক্তরাষ্ট্রের উচিত জরুরিভিত্তিতে ভ্যাকসিন ও ওষুধ তৈরির গবেষণায় বিনিয়োগ করা, পারসোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্টসহ (পিপিই) বিভিন্ন মেডিকেল সরঞ্জামের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা, প্রয়োজনে অবসরে যাওয়া চিকিৎসকদের কাজে নিয়োগ করা।

বেলর কলেজ অব মেডিসিনের ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞ পিটার হটেজ জানান, তিনি ও তার সহকর্মীদের কাছে করোনাভাইরাসের প্রাথমিক ভ্যাকসিন আছে। কিন্তু, পর্যাপ্ত তহবিল না থাকায় তারা সেটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করতে পারছেন না।

যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে চিকিৎসক ও মেডিকেলকর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জাম নেই বলেও জানা গেছে। তাই এটির পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, তা না হলে চিকিৎসক ও মেডিকেলকর্মীরাও আক্রান্ত হতে পারে। ইতালিতে দেখা গেছে, ৮ দশমিক ৩ শতাংশ চিকিৎসাকর্মীই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।

যদি যুক্তরাষ্ট্র করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে হয়তো দাঙ্গাও সৃষ্টি হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র উন্নত দেশ যেখানে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা নেই। যে কারণে অন্যান্য দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র ভাইরাস মোকাবিলায় দুর্বল অবস্থানে রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র কী করবে? তারা কি নেতিবাচক পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করবে? নাকি যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নেবে?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাস বিগত ১০০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী হতে পারে। এটির কারণে গোটা বিশ্ব ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র কী করবে সেটি তাদের ওপরেই নির্ভর করছে। যদি তারা ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তাহলে অবশ্যই দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। মোদ্দা কথা, স্বাস্থ্যখাতে তাদের বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সবশেষে সবচেয়ে প্রয়োজন সর্বসাধারণের সচেতনতা।

তথ্যসূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস

Comments

The Daily Star  | English

Freedom fighter’s definition: Confusion, debate over ordinance

Liberation War adviser clarifies that Sheikh Mujib, Tajuddin, others in Mujibnagar govt are freedom fighters

12h ago