ফিরিয়ে দেওয়া রোগীর মৃত্যু ও চিকিৎসকের শপথ

তিন হাসপাতাল ঘুরেও বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়া স্কুলছাত্র রিফাত। ছবি: সংগৃহীত

তিন হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় খুলনায় স্কুলছাত্রের মৃত্যুর সংবাদটি গণমাধ্যমে প্রচার হলে মুহূর্তেই তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। রিফাত নামের ওই শিশুটি দীর্ঘদিন লিভারের জটিলতায় ভুগছিল। তার অসুস্থতা বেড়ে গেলে স্বজনেরা প্রথমে তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে ভর্তি করাতে না পেরে আরও দুইটা বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।

তিনটা হাসপাতাল থেকেই জানানো হয় সেখানে কোনো চিকিৎসক নেই বা চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। কি সাঙ্ঘাতিক কথা! হাসপাতালে চিকিৎসক নেই। তাও আবার সরকারি হাসপাতালে। নাকি চিকিৎসক থাকার পরও রোগীকে ভর্তি করানো হলো না? হাসপাতালে যদি চিকিৎসক না থেকে থাকে, সেটা ভারি অন্যায়। কিন্তু তার চেয়েও বড় অন্যায় রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি না করানো।

এই ঘটনা অনেক প্রশ্নের অবতারণা করে। একটি হাসপাতাল যখন চালু করা হয়, তার প্রধান শর্তই থাকে সেখানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দিতে হবে। হাসপাতাল থাকবে কিন্তু চিকিৎসক থাকবে না, সেটা কোনো অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না। চিকিৎসকবিহীন হাসপাতাল আর পানি বিহীন সমুদ্র একই কথা। আর সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক থাকবেন না, তাও আবার একটি টারশিয়ারি হাসপাতালে, এই কথা কতটা বিশ্বাসযোগ্য?

পেশাগত আচরণের ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের কতগুলো নৈতিক এবং আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল চিকিৎসকদের জন্য পেশাগত আচরণবিধি প্রণয়ন করেছে, যেগুলো লঙ্ঘন করলে সুনির্দিষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে কাউন্সিল সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশন বাতিলসহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে।

একজন রেজিস্টার্ড মেডিকেল প্র্যাক্টিশনার তার পেশাগত দায়িত্ব পালনের শুরুতে কিছু নীতিমালা অনুসরণ করার শপথ নিয়ে থাকেন। এই নীতিমালা ১৯৪৯ সালের ১২ অক্টোবর লন্ডনে বিশ্ব চিকিৎসা সম্মেলনের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত ঘোষণার আলোকে প্রণীত। সেই নীতিমালার মধ্যে রয়েছে, “আমি পুতঃভাবে প্রতিজ্ঞা করছি যে মানবতার সেবায় আমি আমার জীবন উৎসর্গ করব। ... রোগীর মৃত্যু ঠেকানোই হবে আমার প্রথম বিবেচ্য বিষয়।' (সূত্র: ডা. কে. সি. গাঙ্গুলী ও বাসুদেব গাঙ্গুলী, মেডিকেল আইন বিজ্ঞান, আলীগড় লাইব্রেরি, ঢাকা, ১৯৯২, পৃষ্ঠা ৩৫)।

দেশে হাসপাতাল চালু আছে অথচ বিনা চিকিৎসায় রোগী মারা গেল, হাসপাতালে ভর্তি নিল না, রোগীর মৃত্যু ঠেকানোর জন্য হাসপাতাল বা চিকিৎসক কিছুই করলেন না—এটা কি পেশাগত শপথ ভঙ্গ করা নয়? এই ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থায় বড় ধরনের গলদ রয়ে গেছে।

চিকিৎসা সম্পর্কিত নীতিমালা ও আচরণবিধির মূল সুর হলো রোগীকে লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে এবং তাকে অন্য কোনো লক্ষ্য পূরণের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার না করে চিকিৎসা সম্পর্কিত যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা। কিন্তু আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থার বাস্তব চিত্র অনেক ক্ষেত্রেই এই সূরের পরিপন্থী।

এই কথা সত্যি যে কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের বর্তমান সময়ে অনেক চিকিৎসকই প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়া রোগীকে চিকিৎসা দিতে ভয় পাচ্ছেন। কিন্তু তার মধ্যেও অনেক চিকিৎসক জীবন বাজি রেখে বিশ্বব্যাপী রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম নয়। কোভিড ১৯ রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে ইতিমধ্যে অনেক চিকিৎসক নিজেরাও আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের সাহসিকতা ও আন্তরিক সেবার জন্য আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। মানুষ হিসেবে চিকিৎসকদেরও রয়েছে নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে ভাবার অধিকার। তাই  নিরাপত্তা সরঞ্জামের জন্য চিকিৎসকদের যৌক্তিক দাবির প্রতি আমরা সম্মান ও সমর্থন জানাই।

স্বাস্থ্য বিভাগের দাবি অনুসারে দেশের প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক সুরক্ষা সরঞ্জাম ইতিমধ্যে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এমতাবস্থায় ভীত হয়ে হাসপাতালে অনুপস্থিত থাকা বা উপস্থিত থেকেও রোগীকে গ্রহণ না করা, তাকে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাছাড়া যে শিশুটি বিনা চিকিৎসায় মারা গেল, সে কোনো সর্দি, কাশি বা শ্বাসকষ্টের রোগী ছিল না, সে ছিল লিভার সিরোসিসের রোগী। তাকে চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা বোধগম্য নয়। তাকে কেন হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো না, এই বিষয়টি অবশ্যই তদন্তের মাধ্যমে অবিলম্বে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে প্রতিটি মানুষের রয়েছে চিকিৎসা পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার। এই আধুনিক যুগে দেশে কোনো রোগী বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে, সেটা কোনো অবস্থাতেই কাম্য হতে পারে না। এটা শুধু রাষ্ট্রের নয়, সামগ্রিকভাবে চিকিৎসাব্যবস্থারও চরম ব্যর্থতা। দেশে এতগুলো হাসপাতাল চালু থাকার পরও যদি কোনো রোগী বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করে, তবে জাতি হিসেবে আমরা নিজেদেরকে কোন স্তরের বলে দাবি করব—এই বিষয়টি এখন ভাবার সময় এসেছে। 

অরুণ বিকাশ দে: সাংবাদিক, দ্য ডেইলি স্টার

Comments

The Daily Star  | English

Large-scale Chinese investment can be game changer for Bangladesh: Yunus

The daylong conference is jointly organised by Bangladesh Economic Zones Authority and Bangladesh Investment Development Authority

2h ago