চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা

করোনার দিনে অন্যান্য রোগীদের যা করতে হবে

কিডনির ডায়ালাইসিসের জন্য গাজীপুর থেকে ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস এন্ড ইউরোলরি হাসপাতালে আসা আছিয়া বেগম। ১ এপ্রিল, শ্যামলী, ঢাকা। ছবি: রাশেদ সুমন

ডায়রিয়া ও জ্বরে ভুগছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। সঙ্গে একটু কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। উনার ছেলেমেয়েরা পাঁচটি হাসপাতালে ১৬ ঘণ্টা ঘুরে তাকে কোথাও ভর্তি করাতে পারেনি। তার পরিবারের সদস্যদের দাবি, করোনা আক্রান্ত সন্দেহে উনি সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা পায়নি আর এ কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে। অথচ মৃতদেহ থেকে নমুনা পরীক্ষা করে জানা গেল যে তার কোভিড-১৯ নেগেটিভ ছিল। প্রকৃতপক্ষে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের কারণে তারা মৃত্যু হয়। এই মৃত্যুর দায় কার? চিকিৎসকের, স্বজনদের, নাকি সরকারের?

দুদিন আগে এক চিকিৎসকের মা বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে কিডনি রোগে ভুগছিলেন। হঠাৎ করে শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায় হাসপাতালে তাকে নেওয়া হয়, কিন্তু কোন চিকিৎসক তাকে দেখেননি। সন্তান নিজেকে চিকিৎসক পরিচয় দেওয়ার পরও কোন হাসপাতাল একটু অক্সিজেন দিতেও রাজি হয়নি। তীব্র শ্বাসকষ্টের রোগীরা তাৎক্ষণিক চিকিৎসা না পেলে মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেক গুণে বেড়ে যায়। শ্বাসকষ্টের একজন রোগী সঙ্গে সঙ্গে অক্সিজেন, নেবুলাইজেশন ও অন্যান্য চিকিৎসা পাবে এটা তার ন্যূনতম অধিকার। একজন চিকিৎসকের মা যদি শ্বাসকষ্টে বিনা চিকিৎসায় মারা যায় তাহলে এদেশের সাধারণ মানুষ কীভাবে এই পরিস্থিতিতে শ্বাসকষ্ট বা জ্বরের চিকিৎসা পাবে?

শ্বাসকষ্ট হলেই করোনা আক্রান্ত রোগী হিসেবে ধরে নেওয় কোনোভাবেই ঠিক নয়। অন্য অনেক রোগের কারণে শ্বাসকষ্টের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। হাঁপানি, ক্রনিক পালমোনারি অবস্ট্রাকটিভ ডিজিস, হার্ট ফেইলর, ক্রনিক কিডনি ডিজিস, এমনকি অতি মাত্রায় রক্তশূন্যতা থেকেও শ্বাসকষ্ট হতে পারে। করোনা ছাড়া অন্য শ্বাসকষ্টের রোগীর এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসা পাওয়ার কি অধিকার নেই? শ্বাসকষ্টের রোগীরা চিকিৎসা পেতে সমস্যায় পড়ছেন কিন্তু কেন চিকিৎসা পাচ্ছে না, কোথায় সেই অব্যবস্থাপনা সেই কথাগুলো তুলে ধরতেই এই ভূমিকার অবতারণা।

প্রথমে আসি শ্বাসকষ্টের কোন রোগীকে চিকিৎসকরা করোনা আক্রান্ত রোগী হিসেবে সন্দেহভাজনদের তালিকায় রাখবেন।

১. যদি কোনো রোগীর জ্বরের সঙ্গে শ্বাসকষ্ট থাকে এবং গত ১৪ দিনের মধ্যে বিদেশ ভ্রমণের ইতিহাস থাকে বা বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে থাকেন বা করোনা পজিটিভ কোন রোগীর সংস্পর্শে এসে থাকেন তাহলে তিনি করোনার  একজন সন্দেহভাজন রোগী।

২. বিদেশে যাওয়ার কোন ইতিহাস নেই বা কোভিড-১৯ এর রোগীর সংস্পর্শের ইতিহাস নেই কিন্তু জ্বর আছে সঙ্গে কাশি বা শ্বাসকষ্ট আছে এবং তার জ্বর ও কাশির তীব্রতা এমন যে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হচ্ছে এবং এই শ্বাসকষ্ট অন্য কোন রোগ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না তাহলে তাকে কোভিড-১৯ এর সন্দেহভাজন রোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। 

এবার আসি এই সন্দেহভাজন রোগীরা কোথায় চিকিৎসা পাবেন।

কোভিড-১৯ এর সন্দেহভাজন রোগীরা জরুরি বিভাগে আসলে তাদের রোগের ইতিহাস দেখে, পরীক্ষা করে যদি সম্ভব হয় প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আইসোলেশন ওয়ার্ডে পাঠানো হবে। আইসোলেশন ওয়ার্ড থেকে তার কোভিড-১৯ সংক্রান্ত পরীক্ষার জন্য স্যাম্পল কালেকশন করে পাঠাতে হবে। কোভিড-১৯ এর পরীক্ষার রিপোর্ট আসতে চার-ছয় ঘণ্টা সময় লাগে। ক্ষেত্র বিশেষে ৪৮ ঘণ্টা সময়ও লাগতে পারে। এই সময় রোগী আইসোলেশন ওয়ার্ডে যথারীতি চিকিৎসা পাবেন। যদি কোভিড-১৯ টেস্ট পজিটিভ হয় তাহলে তাকে অবশ্যই নির্ধারিত ওয়ার্ডে পাঠানো হবে। কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগীদের চিকিৎসা হয় কুয়েত মৈত্রী আর কুর্মিটোলা এই দুই হাসপাতালে। বাকি হাসপাতালগুলো প্রস্তুত হচ্ছে। কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে আইসোলেশন ওয়ার্ড নেই। যেসব রোগীদের কোভিড-১৯ পরীক্ষা করা হয়েছে এবং রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে কেবল তারাই এই হাসপাতালে ভর্তি হতে পারবেন। আর যদি কোভিড-১৯ টেস্ট নেগেটিভ হয় তাহলে রোগীর যদি জটিল সমস্যা না থাকে তাহলে তাকে ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হবে। যদি জটিল সমস্যা থাকে তাহলে তাকে আইসোলেশন কেবিনে স্থানান্তর করতে হবে।

এবার আসি জ্বর ও কাশির রোগীরা যেখানে-যেভাবে চিকিৎসা পাবেন।

যাদের জ্বর এবং/অথবা কাশি থাকবে তারা সরকারি, বিএসএমএমইউ ও বেসরকারি সেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের কিছু হটলাইনের মাধ্যমে চিকিৎসকদের পরামর্শ নিয়ে বাসায় চিকিৎসা নিবেন এবং ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টিনে থাকবেন। 

-জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল

-কাশির জন্য এন্টি হিস্টামিন

-বেশি করে পানি পান করা

হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার সময় যদি নিম্নোক্ত উপসর্গ থাকে

-শ্বাসকষ্ট

-বেশি মাত্রায় জ্বর ও কাশি

-কথাবার্তায় অসঙ্গতি

তাহলে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।

করোনা মহামারী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশ্বে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গড়ে প্রতিদিন ৩০-৩২ হাজার মানুষ মারা গেছে বলে ধারণা করা হয়। আর এখন প্রতিদিন প্রায় সারা বিশ্বে চার-পাঁচ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। এভাবে যদি আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে তাহলে এই ভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতাকে হার মানাবে। এই যুদ্ধটি আসলে একটি ভাইরাসের সঙ্গে সমগ্র মানবজাতির যুদ্ধ। এখানে কেউ কাউকে দোষারোপ করে রেহাই পাওয়ার উপায় নেই। জনগণকে সচেতন থাকতে হবে যাতে রোগটি আমরা সহজে প্রতিরোধ করতে পারি। আবার কেউ যদি আক্রান্ত হয়ে যায় তাহলে কখন টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসা নিবে, কখন হাসপাতালে ভর্তি হবে, কোন হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে, হোম কোয়ারেন্টিনে কী কী করবে, এই ব্যাপারগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকতে হবে।

তেমনি চিকিৎসকদের উচিত নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করে রোগীদের চিকিৎসায় এগিয়ে আসা, যাতে কোভিড-১৯ ছাড়া অন্যান্য রোগের মৃত্যুহার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে না যায়। যাতে কোনো স্বজনের মনে আক্ষেপ না থাকে যে তার প্রিয়জন বিনা চিকিৎসায় মারা গেল। চিকিৎসকদের উৎসাহ দেওয়া, আর জনগণকে সচেতন করার মুখ্য ভূমিকা সরকারকেই নিতে হবে। আমাদের সরকার, চিকিৎসক, জনগণ, কেউ কারো জন্য বোঝা না হয়ে সবাই নিজেদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেই কেবল এ যুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভব।

 

ডা. কাওসার আলম: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ও রেসিডেন্ট

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
government bank borrowing target

Govt to give special benefits to employees, pensioners from July 1

For self-governing and state-owned institutions, the benefit must be funded from their budgets

1h ago