ট্রাম্পের ৬ সপ্তাহের গাফিলতি, আমেরিকার অপূরণীয় ক্ষতি

শুরুর ছয় সপ্তাহ ট্রাম্পের গাফিলতি, অবহেলায় নষ্ট করে অপূরণীয় ক্ষতির মুখে পড়েছে আমেরিকা।
(বাম থেকে) যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক, গবেষক ড. নুরুন নবী; ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ও আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ, নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত আজকাল পত্রিকার সম্পাদক ও জ্যাকশন হাইটস বাংলাদেশি বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি জাকারিয়া মাসুদ এবং ডা. রায়হান ফারুকী। ছবি: সংগৃহীত

শুরুর ছয় সপ্তাহ ট্রাম্পের গাফিলতি, অবহেলায় নষ্ট করে অপূরণীয় ক্ষতির মুখে পড়েছে আমেরিকা।

নতুন করোনাভাইরাস ‘কোভিড-১৯’কে প্রথমদিকে কোনো ভাইরাসই বলতে রাজি হননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বলেছিলেন, এটি একটি ‘ফ্লু’ মাত্র। পরে তিনি ভাইরাসটিকে ‘চীনা ভাইরাস’ বলে উপহাসও করেছিলেন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কোনো পরামর্শকেই গুরুত্ব দেননি তিনি। আজ তারই মুখে শোনা যাচ্ছে ভিন্ন কথা। বলছেন, ‘চলতি ও আগামী সপ্তাহ কঠিন সময়, অনেক মানুষ মারা যাবে’।

গত ২৪ ঘণ্টায় নিউইয়র্কে আরও পাঁচ ও নিউ জার্সিতে দুই জন বাংলাদেশি মারা গেছেন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। এ নিয়ে গত ১৬ দিনে নিউইয়র্কে ৫৮, নিউ জার্সিতে সাত এবং মিশিগানে পাঁচ জনসহ ৭০ জন বাংলাদেশি মারা গেলেন।

আমেরিকায় এভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত আজকাল পত্রিকার সম্পাদক ও জ্যাকশন হাইটস বাংলাদেশি বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি জাকারিয়া মাসুদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘কোনো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। চীনে করোনাভাইরাস শনাক্তের পর নিউইয়র্কের জেএফকে ও লস অ্যাঞ্জেলেসের বিমানবন্দর দিয়ে ৪ লাখ ৩২ হাজার চীনা নাগরিক আমেরিকায় এসেছেন।’

‘বিমানবন্দরে কোনো স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা ছিল না,’ উল্লেখ তিনি আরও বলেন, ‘আমি মার্চের ৩ তারিখে বাংলাদেশ থেকে নিউইয়র্কে এসেছি। জেএফকে-তে আমার কাছে কিছুই জানতে চাওয়া হয়নি। অবহেলা করে সময় নষ্ট করায় আমেরিকা ভয়াবহ বিপদে পড়ে গেছে।’

জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির বরাত দিয়ে আজ রোববার সিএএএন জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে মোট আক্রান্ত ৩ লাখ ১২ হাজার ১৪৬ জন। মারা গেছেন ৮ হাজার ৪৯৯ জন। নিউইয়র্ক রাজ্যে আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ১৪ হাজার ১৭৪ জন এবং মারা গেছেন ২ হাজার ৬২৪ জন।

‘নিউইয়র্কে প্রতি মুহূর্তে পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। আক্রান্ত ও মারা যাওয়ার সংখ্যা বাড়ছে,’ যোগ করেন জাকারিয়া মাসুদ।

নিউইয়র্কের পরিচিত ব্যক্তিত্ব লেখক, গবেষক ড. নুরুন নবী দ্য ডেইলি স্টারকে বলছিলেন, ‘ছয় সপ্তাহের গাফিলতি, অবহেলায় আমেরিকার আজকের এই করুণ পরিণতি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের গোয়ার্তুমি অবহেলার মূল্য দিতে হচ্ছে আমেরিকার জনগণকে। এর মধ্যে নিউইয়র্কের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ।’

‘যুক্তরাষ্ট্রে করোনা আক্রান্ত রোগী প্রথম শনাক্ত হয় ২০ জানুয়ারি। দক্ষিণ কোরিয়াতেও একই দিন প্রথম শনাক্ত হয়েছিল। দক্ষিণ কোরিয়া অবহেলা না করে বহুমুখি ব্যবস্থা নিয়ে যখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসছিল, ট্রাম্প তখন বলছিলেন এটা সাধারণ বিষয়। দুই সপ্তাহে কয়েকজন মারা গেছে, আগামী সপ্তাহে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আর কেউ মারা যাবে না। এভাবে ছয় সপ্তাহ সময় নষ্ট করা হয় কোনো প্রস্তুতি না নিয়ে। এমনকী, মহামারি আকার ধারণ করার পরও ট্রাম্প প্রশাসন কোনো উদ্যোগ নেয়নি’ যোগ করেন ড. নবী।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ও আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ। তার কাছে জানতে চাইলাম, ‘কেন আমেরিকায় করোনাভাইরাস এতটা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করলো?’

ড. রীয়াজ দ্য ডেইলি স্টারকে বলছিলেন, ‘প্রথমত নেতৃত্বের ব্যর্থতা— ট্রাম্প ও হোয়াইট হাউস একে ছোট করে দেখেছে। এ বিষয়ে আগে থেকে যে সব সতর্কবাণী ছিল তা অবহেলা করেছে। এমনকী, গোয়েন্দা রিপোর্ট ছিল জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে— তাও বিবেচনায় নেয়নি।’

ট্রাম্প রাজনৈতিক বিবেচনার কারণে সংকটকে ছোট করে দেখিয়েছেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তার মতে, ‘দ্বিতীয় কারণ হলো: ফেডারেল কাঠামো ও সিডিসির পদ্ধতিগত কারণে প্রথম যখন সিয়াটলে ভাইরাসের উপসর্গ দেখা দেয় সে সময়েই টেস্ট করতে সেখানকার ল্যাবকে অনুমোদন দেয়নি। তারপর সিডিসি’র টেস্ট-কিটে ত্রুটি ধরা পড়ে। সব মিলে সময়ের অপচয় হয়েছে। তৃতীয়ত, এর মাত্রা বিষয়ে প্রথমে ধারণার ভুল ছিলো। সম্ভবত চীনের উহানের মাত্রা যা বলা হয়েছিল, তা বিশ্বাস করেছিল ট্রাম্প প্রশাসন। পরে বোঝা গেছে চীনের সেই সব তথ্য সঠিক ছিলো না— ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। চতুর্থত, ফেডারেল ও রাজ্য সরকারের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব।’

মূল সমস্যাটা কোথায় হলো?

ড. রীয়াজ বলেন, ‘এক কথায় মূল সমস্যা সময়ের অপচয়। যেভাবেই হোক সময়ের অপচয় হয়েছে। যখন প্রস্ততি নেওয়া দরকার সেই সময়ে কিছুই করা হয়নি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা। এই ধরনের মহামারি হতে পারে, তেমন আশঙ্কা আগে জানা যায়— ইবোলার ক্ষেত্রে জানা গেছে। সেই সময়ে মোকাবিলা করা গেছে।’

এতটা সংক্রমণ-প্রাণহানি ঠেকানো সম্ভব ছিল না?

ড. রীয়াজ মনে করেন, ‘ঠেকানো যেত না, কমানো যেত। সেটার জন্যে যে সহায়তা দরকার ছিল ফেডারেল সরকারের কাছ থেকে, সেটা পাওয়া যায়নি। যেখানে রাজ্য সরকার আগেই ব্যবস্থা নিয়েছে সেখানে কম হয়েছে। যেমন, ক্যালিফোর্নিয়া।’

‘কিছু জায়গায় তার ডেমোগ্রাফিক চরিত্র পরিস্থিতির অবনতি করেছে। নিউইয়র্কে এত ধরনের মানুষ যে তাদের বোঝাতেই সময় চলে গেছে। অনেক আগে লকডাউন করা দরকার ছিলো। সেটা করা হয়নি। এখন সেই অবস্থা হবে ফ্লোরিডাতে,’ যোগ করেন তিনি।

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল বাংলাদেশি আমেরিকান তরুণ ডাক্তার রায়হান ফারুকীর সঙ্গে। এই তরুণ ডাক্তার নিজে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছেন।

ডা. ফারুকী বলছিলেন, ‘আমি করোনাভাইরাস রোগী হিসেবে অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় চলে গিয়েছিলাম। প্রথম সপ্তাহে জ্বর ছিল ১০৩ ডিগ্রি। কাশির সঙ্গে সবুজ রঙের কফ বের হচ্ছিল। আমি প্রচুর পরিশ্রম করতে পারি, ক্লান্ত হই না। কিন্তু, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আমি এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, যা বলে বোঝাতে পারব না।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হয় দ্বিতীয় সপ্তাহে। তখন আমি হাসপাতালে যেতে বাধ্য হই এবং একদিন থাকতে হয়। আমার অক্সিজেন প্রয়োজন হয়েছিল। বয়স ও স্বাস্থ্য বিবেচনায় আমার ভেন্টিলেশন দরকার হয়নি। দুই সপ্তাহ পর আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠেছি।’

আমেরিকার একটি বায়োটেকনোলজি কোম্পানির কনসালটেন্ট ডা. রায়হান ফারুকী। আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স (এআই) নিয়েও কাজ করছেন। ইতোমধ্যে এআইভিত্তিক একটি টেক্সট মেসেজ প্রোগ্রাম তৈরি করেছেন। যা ডাক্তার-রোগী তথ্য আদান-প্রদানে দারুণভাবে কাজ করছে। করোনা পরীক্ষার স্বল্প মূল্যের কিটও তৈরি করেছেন। এখন যা পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আছে।

বাংলাদেশি-আমেরিকান ফর পলিটিক্যাল প্রোগ্রেস (বিএপিপি) সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ডা. ফারুকী।

আমেরিকার এই বিপর্যয়ের কারণ বিষয়ে তিনি বলছিলেন, ‘এক কথায় এর উত্তর হলো, ট্রাম্পের নেতৃত্বের ব্যর্থতা। প্রথমে ট্রাম্প গুরুত্বই দেয়নি। তারপর মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর বলেছেন, এটা ফেডারেল সরকারের দায়িত্ব নয়— সব দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। ট্রাম্পের এই দাবি সম্পূর্ণ অসত্য।’

‘নিউইয়র্কের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো শুরু থেকেই বলছিলেন, এই মহামারি ফেডারেল সরকারের সহায়তা ছাড়া, রাজ্য সরকারের পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব না। নিউইয়র্কে হাসপাতাল, ডাক্তার, নার্সের ঘাটতি নেই। পর্যাপ্ত আছে স্বাভাবিক সময়ের জন্যে। কিন্তু, মহামারি মোকাবিলায় হাসপাতালের বেড সংখ্যা, পিপিই, ভেন্টিলেটর সংকট দেখা দিয়েছে। এই সংকটের কথা গভর্নর কুমো আগেই বলেছিলেন। ট্রাম্প সরকার গুরুত্ব দেয়নি।’

‘আমরা এখন পর্যন্ত যে তথ্য পেয়েছি, তাতে নিউইয়র্কের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পুলিশ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। কারণ সবাই পুলিশকে আগে ফোন করেছে। পুলিশ ছুটে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছে,’ যোগ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে থাকা স্বাস্থকর্মীদের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তার-নার্সদের মধ্যে কমপক্ষে ১০ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছেন। ফলে নিউইয়র্কের চিকিৎসা ব্যবস্থায় একটা বড় সংকট তৈরি হয়েছে।’

‘অনেক অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে। আরও তৈরির কাজ চলছে,’ উল্লেখ করে ডা. ফারুকী বলেন, ‘কিন্তু তা দিয়েও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। অন্য রাজ্যগুলো থেকে ডাক্তার-নার্স, অ্যাম্বুলেন্স আসছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৩০ হাজার মেডিকেল স্বেচ্ছাসেবক এসেছে। তা দিয়ে পরিস্থিতি কতটা সামাল দেওয়া যাবে, সন্দেহ আছে। কারণ আগামী দুই সপ্তাহে নিউইয়র্কসহ আমেরিকায় করোনা পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করছি।’

পরিত্রাণ বিষয়ে ডা. ফারুকী বলছিলেন, ‘সমাধানের ফর্মূলা আমেরিকা, বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর জন্যে একই। ঘরে থাকতে হবে। বারবার জ্বর মাপতে হবে। প্যারাসিটামল খাওয়া যেতে পারে। কাশির সাধারণ ওষুধ খাওয়া যাবে। ডায়রিয়া প্রতিরোধের প্রচলিত পদ্ধতি মেনে চলতে হবে। শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে হাসপাতালে যেতে হবে। তবে সবচেয়ে জরুরি শুরুতেই পরীক্ষা করে শনাক্ত ও আইসোলেশনে থাকা। কোভিড-১৯ চিকিৎসায় আমেরিকায় কয়েকটি ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে। আংশিক কাজও করছে। তবে নানা রকমের পরীক্ষা না করে এসব ওষুধ ব্যবহার করা যাবে না। ফলে সেসব ওষুধের নাম বলছি না।’

আরও পড়ুন:

মর্গে জায়গা ফুরিয়ে আসছে নিউইয়র্কে

চলতি ও আগামী সপ্তাহ কঠিন সময়, অনেক মানুষ মারা যাবে: ট্রাম্প

করোনাভাইরাস মহামারি ঠেকানো সম্ভব ছিল: নোয়াম চমস্কি

নিউইয়র্কে আরও ৬ জনসহ ১৫ দিনে যুক্তরাষ্ট্রে ৬৩ বাংলাদেশির মৃত্যু

করোনায় গত ২৪ ঘণ্টায় নিউইয়র্কে আরও ৭, মিশিগানে ১ বাংলাদেশির মৃত্যু

নিউইয়র্কে করোনায় ২৪ বাংলাদেশির মৃত্যু

নিউইয়র্কে করোনায় ১০ বাংলাদেশির মৃত্যু

করোনায় নিউইয়র্কে ৫ বাংলাদেশির মৃত্যু

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

5h ago