বন্যপ্রাণীদের ওপর শোষণের কারণে ভবিষ্যতেও ছড়াবে নতুন ভাইরাস

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

বন্যপ্রাণীদের ওপর শোষণের কারণেই নতুন করোনাভাইরাসের মতো রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে বলে মনে করছেন এক দল বিশেষজ্ঞ। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাণীর সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের প্রকৃতি বদলের কারণেই মানুষের মধ্যে নতুন ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটছে।

দ্য সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক প্রতিবেদনে ওই গবেষণা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে। মূলত ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রাণী থেকে মানবদেহে সংক্রমিত হওয়া ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক।

তারা জানান, জেনেটিক্সসহ অন্যান্য কারণে প্রাণীর শরীর থেকে ভাইরাস মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে।

ওই দলের প্রধান গবেষক ক্রিস্টিন ক্রেউডার জনসন বলেন, ‘বন্যপ্রাণী থেকে মানুষের দেহে ভাইরাস ছড়ানোর পেছনে মূলত মানুষই দায়ী। এটা মূলত প্রাণীদের আবাসস্থল ধ্বংস করে তাদেরকে শোষণ করার পরিণতি।’    

দিনদিন জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বন্য প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। আবার ব্যবসার জন্য বিভিন্ন জাতের পশুপাখি শিকার করা হচ্ছে। ফলে, অনেক প্রজাতির বন্যপ্রাণী এখন বিলুপ্তির মুখে। বন্যপ্রাণী বিলুপ্তির কারণে তাদের দেহে থাকা ভাইরাসগুলো অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে সংক্রমিত হচ্ছে।

ওয়ান হেলথ ইনস্টিটিউশনের এপিসেন্টার ফর ডিজিজ ডায়নামিকের পরিচালক ক্রিস্টিন আরও বলেন, ‘বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস করার পরিণতি হচ্ছে, তারা এখন ভাইরাসগুলো আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের কারণে বন্যপ্রাণী যত বেশি বিলুপ্ত হতে থাকবে তত বেশি মারাত্মক ভাইরাস আমাদের শরীরে বাসা বাধতে শুরু করবে। দুভার্গ্যজনক হলেও এটা সত্যি যে, মানুষের কিছু কর্মকাণ্ডের জন্যই বর্তমানে আমরা এরকম একটি বিপর্যয়ের মুখে পড়েছি।’

২০১৪ সালের আগে সংক্রমিত হওয়া ১৪০ ধরনের জুনোটিক ভাইরাস (বিভিন্ন প্রাণী থেকে ছড়ানো ভাইরাস) নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ঐতিহাসিকভাবে অধিকাংশ ভাইরাসের বাহক মূলত স্তন্যপায়ী প্রাণী। স্তন্যপায়ী অনেক প্রাণীই মানুষের গৃহপালিত কিংবা সান্নিধ্যে থাকে বলে তাদের থেকে মানুষের দেহে ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে।

গবেষকরা বলছেন, বন্যপ্রাণীর তুলনায় গৃহপালিত প্রাণীরা প্রায় আট গুণ বেশি জুনোটিক ভাইরাস মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে। উদাহরণ হিসেবে হান্টাভাইরাস, র‍্যাবিস, সোয়াইন ফ্লু’র কথা উল্লেখ করেন তারা।

১৯৬০ সালের তুলনায় বর্তমানে পৃথিবীর জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। জনসংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে বন উজাড়, নগরায়ণ ও কৃষির সম্প্রসারণ। ফলে, প্রাণীর আবাসস্থল আর মানুষের আবাসস্থলের মধ্যে দূরত্ব কমে আসছে। পরিবেশ ও আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে প্রাণীজগতেও আসছে পরিবর্তন। বাসস্থানের পাশাপাশি প্রাণীদের খাদ্যাভাসও বদলে যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে অনেক পরিবেশ বিজ্ঞানী ও জনস্বাস্থ্য সংস্থা বন্যপ্রাণী ও তাদের আবাসস্থল সংরক্ষণের দিকে মনোযোগী হওয়ার ব্যাপারে জোর দিয়েছেন। বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হতে থাকলে মারাত্মক ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে সতর্ক করেছেন।

গবেষকরা বলছেন, একদিকে প্রাণীর সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের প্রকৃতি বদল, অন্যদিকে, মানুষে-মানুষে যোগাযোগ সহজ হওয়ার কারণে ভাইরাস খুব দ্রুত ছড়িয়ে যেতে পারে।

সাধারণত কৃষকদের গুদাম ঘর কিংবা খামারে ইঁদুর, বাদুর কিংবা বানরজাতীয় ক্ষতিকর প্রাণী ঘোরাফেরা করে। এদের দেহ থেকে ক্ষতিকর ভাইরাস খাবারের মাধ্যমেও মানুষের দেহে পৌঁছাতে পারে বলে জানান তারা।

ইঁদুর, বাদুড় কিংবা বানর প্রজাতি থেকে প্রায় ৭০ শতাংশ জুনোটিক ভাইরাস মানুষের দেহে সংক্রমণ ঘটিয়েছে। ১৯৮০’র দশকে বানরজাতীয় প্রাণী থেকে এইচআইভি ভাইরাসের সূচনা হয়েছিল। আফ্রিকায় ছড়ানো ইবোলা রোগের সূচনা হয়েছিল বাদুড় থেকে। সার্স, নিপাহ ভাইরাসও বাদুড় থেকে ছড়িয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কোভিড-১৯’র ক্ষেত্রেও বাদুড় থেকে ভাইরাসটি ছড়িয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ভেটেরিনারি এপিডেমিওলজিস্ট দ্রিক ফেইফার বলেন, ‘মানুষ যত বন্যজন্তুর সান্নিধ্যে থাকবে ততবেশি তাদের দেহের ভাইরাসগুলো মানুষের শরীরে সংক্রমিত হতে থাকবে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে প্রাণী ও মানুষের আবাসস্থলের মধ্যে এখন তেমন দূরত্ব নেই।’

গবেষকরা মনে করেন, এই ধরনের ভাইরাস প্রতিরোধে ওয়ান হেলথ মডেল অনুযায়ী ডাক্তার, পশুচিকিৎসক, সার্জন ও পরিবেশবিদদের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। কৃষিক্ষেত ও খামারগুলোতে জীবনিরাপত্তা বাড়াতে হবে। প্রাণী কিংবা মানবদেহে নতুন কোনো রোগের সংক্রমণ ঘটলো কি না, তা নজরদারিতে রাখতে হবে। নতুন ভাইরাসের খোঁজ পাওয়া মাত্রই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

মেলব্রোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি এপিডেমিওলজিস্ট পেতা হিচেনস বলেন, ‘ভবিষ্যতে প্রাণী থেকে আরও অনেক ভাইরাস মানবদেহে ছড়াতে পারে। তাই আমাদের উচিত সর্তক হওয়া। ভাইরাস মোকাবিলায় আরও দক্ষতা অর্জন করতে হবে। কোনো নতুন ভাইরাস সংক্রমণের পর ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত কীভাবে রোগ সংক্রমণ ঠেকানো যায় সে ব্যাপারে আরও সুস্পষ্ট গাইডলাইন প্রয়োজন। কোভিড-১৯’র মহামারির অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের এই বিষয়গুলো শিখতে হবে।’

Comments

The Daily Star  | English

UK govt unveils 'tighter' immigration plans

People will have to live in the UK for 10 years before qualifying for settlement and citizenship

1h ago