করোনা ‘বিশেষ-অজ্ঞ’!

তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম। দুপুরের খাবার পর চাটাই নিয়ে বাড়ির পাশের এক দাদুর কাছে কেচ্ছা (গল্প) শুনতে যেতাম। দলে আমরা সমবয়সী কয়েকজন ছিলাম। দাদু গাছতলায় শুয়ে শুয়ে আমাদের রাজা-বাদশা, ভূত-পেত্নী, জিন-পরী নিয়ে মজার মজার গল্প শোনাতেন। দাদুর একটা অভ্যাস ছিল। কেচ্ছার কিছু অংশ বলে থেমে যেতেন। তখন আমরা আবার সমস্বরে বলে উঠতাম, ‘হুম, হেইয়ার (তার) পর’। তিনি আবার একটু বলে থেমে যেতেন। কখনো ঘুমিয়ে নাক ডাকা শুরু করতেন। আমরা তাকে আবার ধাক্কাতে ধাক্কাতে উঠিয়ে কেচ্ছার শেষ পর্যন্ত শুনে তবেই ছাড়তাম।
Corona Expert.jpg
ছবি: সংগৃহীত

তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম। দুপুরের খাবার পর চাটাই নিয়ে বাড়ির পাশের এক দাদুর কাছে কেচ্ছা (গল্প) শুনতে যেতাম। দলে আমরা সমবয়সী কয়েকজন ছিলাম। দাদু গাছতলায় শুয়ে শুয়ে আমাদের রাজা-বাদশা, ভূত-পেত্নী, জিন-পরী নিয়ে মজার মজার গল্প শোনাতেন। দাদুর একটা অভ্যাস ছিল। কেচ্ছার কিছু অংশ বলে থেমে যেতেন। তখন আমরা আবার সমস্বরে বলে উঠতাম, ‘হুম, হেইয়ার (তার) পর’। তিনি আবার একটু বলে থেমে যেতেন। কখনো ঘুমিয়ে নাক ডাকা শুরু করতেন। আমরা তাকে আবার ধাক্কাতে ধাক্কাতে উঠিয়ে কেচ্ছার শেষ পর্যন্ত শুনে তবেই ছাড়তাম।

এমন চৈত্রের এক বিকেলে দাদু এক রাজা ও তার উজিরের গল্প শুনিয়েছিলেন। গল্পটা এমন: এক দেশে ছিল এক রাজা। তার ছিল এক উজির। উজির বেজায় চালাক আর বুদ্ধিমান লোক। তিনি নানা প্রয়োজনে রাজাকে বুদ্ধি দিয়ে সহযোগিতা করেন। একদিন রাজদরবার চলাকালে হঠাৎ করে রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, আমার রাজ্যে কোন পেশার মানুষ সবচেয়ে বেশি? সভাসদদের কেউ উত্তর দিলো কৃষক, কেউ বলল শ্রমিক, কেউ জেলে আবার কেউ বলল সৈনিক। কিন্তু উজির নিরুত্তর। এবার রাজা উজিরকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘উজির, তুমি বল তো, কোন পেশার মানুষ বেশি’? উজিরের ঝটপট উত্তর, ‘মহারাজ, আপনার রাজ্যে বৈদ্য (ডাক্তার) বেশি’।

উজিরের এ কথা শুনে রাজা তো রেগেমেগে আগুন। বললেন, আমার রাজ্যে বৈদ্যের সংকট। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে বলে অভিযোগ পাই। আর তুমি কী না বলছ বৈদ্য বেশি। তোমাকে এটা প্রমাণ করতে হবে। যদি না পার তাহলে তোমার গর্দান যাবে। উজির বলল, ঠিক আছে মহারাজ। আমাকে একদিন সময় দেবেন। আমি প্রমাণ করে দিব আপনার রাজ্যে বৈদ্য বেশি। রাজা বললেন, ঠিক আছে। তবে সময় কিন্তু একদিন।

পরেরদিন সকালে যথারীতি রাজা সিংহাসনে বসে দরবার শুরু করলেন। তিনি রাজ্যে বৈদ্য বেশি প্রমাণ করার জন্য উজিরকে ডাকলেন। কিন্তু উজির দরবারে অনুপস্থিত। রাজা এবার উজিরের বাড়িতে পেয়াদা পাঠালেন। পেয়াদারা উজিরের বাসায় গিয়ে দেখলেন, উজির গরমের মধ্যে একটি কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে আছেন। পেয়াদারা বলল, উজির সাহেব, মহারাজ আপনাকে ডেকেছেন। কম্বলের ভেতর থেকে কাঁপতে কাঁপতে উজির বললেন, মহারাজকে বলো আমার জ্বর। আজ আমার পক্ষে রাজদরবারে যাওয়া সম্ভব না। পেয়াদারা ফিরে গিয়ে এ কথা জানাতে রাজা ক্ষেপে গেলেন। এবার তিনি পেয়াদাদের হুকুম দিলেন, যাও, উজির যে অবস্থায় আছে, সেই অবস্থায় তাকে তুলে আনো। মহারাজের এমন হুকুমে পেয়াদারা গিয়ে খাটসমেত উজিরকে রাজদরবারে তুলে নিয়ে এলো।

উজিরকে দেখেই রাজা হুংকার দিয়ে বললেন, উজির, কী হয়েছে তোমার? কম্বলের মধ্যে থেকে কাঁপতে কাঁপতে উজির উত্তর দিলেন, আজ্ঞে মহারাজ, আমার জ্বর। এ কথা শুনে রাজবৈদ্য হেসে উঠলেন। বললেন, হুম এটা কোনো রোগ হলো। তুমি খালি গায়ে থাকো। আমার থেকে দুটি বড়ি নিয়ে খাও। ও দুদিনে সেরে যাবে। রাজবৈদ্য থামতেই সভাকবি বলে উঠলেন, এমন অসময়ে জ্বর তো ভালো না। আমার পিসি বলেছে, হলুদ ভাজা খেলে অসময়ের জ্বর সেরে যায়। এবার সভাপণ্ডিত বললেন, আরে পুরুষ মানুষ এইটুকু জ্বরে কাবু হলে চলবে? তুমি উঠে পুকুরে দুটো ডুব দিয়ে আসো তো। দেখবে জ্বর উবে গেছে। সভাপণ্ডিতকে থামিয়ে দিয়ে মন্ত্রী বললেন, তুমি সভাপণ্ডিতের কথা ছাড়ো। তুমি সাতটি ফল গাছের পাতা একসঙ্গে বেঁটে খাও। ও জ্বর একটু পরেই সেরে যাবে।

এভাবে সভায় উপস্থিত থাকা সবাই একের পর এক উজিরকে জ্বরের ওষুধ দেওয়া শুরু করল। উজিরের চিকিৎসা নিয়ে রাজসভায় রীতিমত হট্টগোল। এবার রাজা চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘তোমরা সবাই থামো। উজির তুমি ওদের কারও কথা শুনবে না। আমি বলছি শোনো। তুমি বাবলা পাতার রস খাও। তোমার জ্বর সেরে যাবে।’ রাজার এমন পরামর্শ শুনে, উজির গায়ের কম্বল ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, মহারাজ, আমার জ্বরের জন্য আপনারা সবাই আমাকে একটা একটা করে ওষুধ দিয়েছেন। আসলে আমার জ্বরই হয়নি। আপনাকে বলছিলাম না, আপনার রাজ্যে বৈদ্য বেশি। এবার তো প্রমাণ পেলেন!

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের বিস্তারের কারণে কেন জানি দাদুর এই গল্পটার কথা খুব বেশি মনে পড়ছে। করোনা নিয়ে দেশে এখন বিশেষজ্ঞরা যেমন বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন, তেমনি বিশেষ-অজ্ঞগণও নানান পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকের কল্যাণে না চাইলেও সেগুলো চোখে পড়ে যাচ্ছে। আমরা যতটা বুঝে ফেসবুক ব্যবহার করি, তার চেয়ে ঢের বেশি করি না বুঝে। এ কারণে কিছু দেখলেই শেয়ার। সত্যতা যাচাইয়ের ধার ধারি না। কার আগে কে শেয়ার দিব, এটা নিয়ে পুরস্কারহীন মুক্তবাজার প্রতিযোগিতা। আমাদের এমন বিবেচনাহীন কর্মকাণ্ডে ডালপালা মেলে গুজব, অসত্য আর ভুয়া সংবাদ। এগুলো দেখে মানুষ হয় বিভ্রান্ত। যার প্রভাব পড়ে এ সংক্রান্ত সঠিক নির্দেশনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে।

করোনা নিয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আছে। দেশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আছে। ডাক্তার আছেন। ভাইরাস বিশেষজ্ঞ আছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আছে। আপনি তো এগুলোর কোনোটিই না। তাহলে আপনি কেন মনগড়া পরামর্শ দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে বেড়াচ্ছেন? করোনার মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বিষয়ে এত ‘বিশেষ-অজ্ঞ’ হওয়ার দরকারটা কী শুনি?

করোনাভাইরাস ধর্ম চেনে না, বর্ণ চেনে না। ধনী-গরীব বুঝে না। শিশু-তরুণ-যুবক কিংবা বৃদ্ধ বিবেচনায় নেয় না। করোনার দরকার বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য উপযুক্ত স্থান কিংবা পরিবেশ। এটি কোন দেশে, কোন সমাজে কিংবা কোন নগরে-সেটি বিবেচ্য নয়। তাই, সবকিছুর মধ্যে নিজের মতো একটা ব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মের দোহাই না দেই। মানুষের ধর্মভীরুতাকে পুঁজি করে অপপ্রচার না করি। আমরা সবাই ডাক্তার হয়ে না যাই। পরামর্শ সবাই দিলে গ্রহণ করবেটা কে? ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা দেখি, যাচাই ছাড়া করে যেন শেয়ার না করি। পারলে সঠিক সংবাদ বা নির্দেশনা জানিয়ে মানুষের উপকার করি। না পারলে ঘরে থাকি। দয়া করে, মিথ্যা কিংবা গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা থেকে নিজেকে বিরত রাখি।  

মো. ইমরান আহম্মেদ: সহকারী পুলিশ সুপার (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস), বাংলাদেশ পুলিশ, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, ঢাকা।

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

8h ago