সরকারের কাজে সমন্বয় জরুরি, মানুষকে তথ্য জানাতে হবে: ডা. রশিদ-ই-মাহবুব
ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও পূর্ব-এশিয়ার উন্নত দেশগুলোর স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী। তাদেরকেও মারাত্মক করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বেগ পেতে হচ্ছে। তাদের তুলনায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা তেমন উন্নত নয়। করোনাভাইরাস ক্রমেই বাড়ছে এদেশেও। কীভাবে আমাদের এই সঙ্কট মোকাবিলা করা উচিত? স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব দ্য ডেইলি স্টারের পরিমল পালমার কাছে তার মতামত ব্যক্ত করেছেন।
দ্য ডেইলি স্টার: বাংলাদেশের বর্তমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতি কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?
ডা. রশিদ: অন্যান্য দেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বলতে পারি, আগামী এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে এখানে রোগীর সংখ্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। তবে প্রশ্নটি হলো আমরা এটি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত কী না। দৈনিক পরীক্ষার সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, এটা ভালো।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমার পরামর্শ থাকবে, লকডাউন এলাকায় গণপরীক্ষা করুণ। সরকারের অ্যান্টিবডি টেস্টিং করা উচিত। যা শ্বাসযন্ত্রে কোভিড-১৯ ভাইরাসের নমুনা থেকে (যেমন: থুথু, লালা) কিংবা ভাইরাসটির বিপরীতে মানুষের রক্ত বা সিরামে জন্মানো অ্যান্টিবডি শনাক্তের মাধ্যমে করা উচিত। এই পরীক্ষায় যাদের পজিটিভ ফলাফল আসবে তাদের আইসোলেশনে রাখতে হবে আর বাকিরা থাকবে পর্যবেক্ষণে। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত এরইমধ্যে অ্যান্টিবডি পরীক্ষার অনুমোদন দিয়েছে। সরকারের উচিত সম্ভাব্য আক্রান্ত রোগীর একটি সংখ্যা অনুমান করা। তার উপর ভিত্তি করে পরিকল্পনা তৈরি করা যেতে পারে। আমাদের দেশের সবাই আইসোলেশন বা কোয়ারেন্টিনের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারছে না। এখন এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা। এটা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা দরকার।
দ্য ডেইলি স্টার: রোগীর সংখ্যা বাড়লে আরও বেশি ভেন্টিলেটর ও নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট (আইসিইউ) প্রয়োজন। আমাদের এত অল্প সংখ্যক ভেন্টিলেটর ও আইসিইউ দিয়ে এটা কীভাবে সামাল দেব?
ডা. রশিদ: মোট সংক্রমিত রোগীর পাঁচ শতাংশের জন্য আইসিইউ প্রয়োজন হতে পারে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রায় ৫০০ আইসিইউ বেড আছে। রাতারাতি আইসিইউ তৈরি করে ফেলা কঠিন। তবে আমাদের যা আছে, প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ান ও চিকিৎসক থাকলে এগুলো দিয়েই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে। তবে সরকারের যথাযথ পরিকল্পনা না থাকলে এত দ্রুত প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ান ও চিকিৎসক পাবেন না। প্রত্যেকটা আইসিইউ জীবন বাঁচানোর জন্য কর্মক্ষম থাকা দরকার।
দ্য ডেইলি স্টার: বর্তমানে অনেক হাসপাতাল এবং চিকিৎসক কোভিড-১৯ লক্ষণযুক্ত রোগীদের দেখছেন না। এ কারণে, করোনা আক্রান্ত না হয়েও অনেক রোগী মারা গেছেন। এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
ডা. রশিদ: কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর পর থেকেই এই সমস্যা হয়েছে। ঠাণ্ডা ও শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে রোগীরা হাসপাতালে যান। কিন্তু তারা করোনাভাইরাস মুক্ত কী না এটা নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের চিকিৎসা বা ভর্তি করা হয়নি।
আমার পরামর্শ থাকবে প্রতিটি বিভাগে এই রোগীদের জন্য হাসপাতাল নির্ধারিত করার। প্রতিটি জেলা হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোকে এজন্য নির্ধারণ করা যেতে পারে। যদি কেউ সংক্রমিত হয়েছেন বলে সন্দেহ হয়, তাহলে দ্রুত তার পরীক্ষা করা এবং নিশ্চিত হলে আইসোলেশনে রাখা উচিত।
চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যসেবাদানকারী যারাই এমন রোগীদের সংস্পর্শে আসবেন, তাদের পিপিই (ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম) থাকতে হবে। সেই সঙ্গে তাদের জন্য খাওয়ার এবং থাকার একটি পৃথক সুবিধাসহ বিশেষ ব্যবস্থা রাখতে হবে। তাদের কাজ হওয়া উচিত পালাক্রমে। এই পদ্ধতিতে একটি গ্রুপ সাতদিন কাজ করবে এবং এরপর ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকবে। এসময় অন্য গ্রুপ কাজ করবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রচুর স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর প্রয়োজন হবে।
দ্য ডেইলি স্টার: কোভিড-১৯ রোগীদের সেবা দিতে স্বাস্থ্যকর্মীরা ভয়ের মধ্যে আছেন। এই ভয় কীভাবে দূর করা যায়?
ডা. রশিদ: স্বাস্থ্যকর্মীদের মনোবল বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। সরকার তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, যা আরও আগে করা উচিত ছিল। দেরিতে হলেও এটা ভালো। এটার প্রয়োজন ছিল।
তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো ডাক্তারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং তাদের পেশার গুরুত্ব তুলে ধরা। কিন্তু স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর কিছুটা দোষ চাপানো হচ্ছে। এখন এটা নিয়ে আলোচনা করার সময় না। সবার আগে ডাক্তারদের জন্য পিপিই নিশ্চিত করতে হবে।
দ্য ডেইলি স্টার: জরুরিভাবে আর কী করা উচিত?
ডা. রশিদ: কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য হাসপাতালে শয্যা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। তবে আমার মনে হচ্ছে কাজগুলো পর্যাপ্ত দ্রুততার সঙ্গে হচ্ছে না। রোগীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের চিকিৎসায় আরও বেশি শয্যা প্রয়োজন। দরকার হলে, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে এই রোগীদের জন্যে আলাদা হাসপাতাল বানানো উচিত।
করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য সকলের মধ্যে দৃঢ় সমন্বয় জরুরি। এ ছাড়াও সরকার কী করতে চাইছে এবং বর্তমানে পরিস্থিতি কেমন, সে সম্পর্কে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হবে। পর্যাপ্ত তথ্য সকলকে জানানোর কোনো বিকল্প নেই।
Comments