চাল চোরেরা করোনার চেয়েও ভয়ংকর!

Rice-1.jpg
প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত

ত্রাণ পাওয়ার জন্য ইউএনও’র অফিসের সরকারি হটলাইন ৩৩৩-এ ফোন করেছিলেন নাটোরের লালপুর উপজেলার ৬০ বছর বয়সী কৃষক শহিদুল ইসলাম। তিনি নিজের জন্য এবং তার প্রতিবেশীদের জন্য সাহায্য চেয়েছিলেন। কারণ এই কর্মহীন মানুষগুলো না খেয়ে আছেন। পরে স্থানীয় চৌকিদার তাকে বলেছিল, ইউএনও তার সঙ্গে দেখা করতে চান। এ কথা শুনে শহিদুল ইসলাম সেখানে গেলে ইউএনও’র দেখা পাননি, কিন্তু তাকে বেদম মারধর করেছে বরমহাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুস সাত্তার। বৃদ্ধ কৃষকের অপরাধ- কেন তিনি ত্রাণ চেয়ে ৩৩৩-এ ফোন করেছিলেন? সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে।

সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে ভাত খেতে না পেরে অভিমান করে আত্মহত্যা করেছে ছোট্ট মেয়ে আফরোজা। ১০ বছরের একটা মেয়ে ভাতের অভাব এবং এর জন্য বাবা-মায়ের তিরস্কারে এতটাই কষ্ট পেয়েছিল যে, সে এর চেয়ে মৃত্যুকেই ভালো মনে করেছে। ঝিনাইদহের তরুণ ভ্যানগাড়ি চালক পরিবারের সবার মুখে খাবার তুলে দিতে পারছিল না বলে একদিন আত্মহত্যা করেছে। করোনার কারণে এ ধরণের হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। নানাদিক থেকে খবর আসছে কাজের অভাব, খাদ্যের অভাব, মানুষের ক্ষোভের।

মানুষ একটু ভাত খেতে পারছে না, এই কথাটা শুনলেই একটি কথা মনে পড়ে- ছোটকালে আমি একবার মাছ খাব না বলে খাবারের প্লেটটা জোরে ঠেলে দিয়ে টেবিল থেকে উঠে গিয়েছিলাম। এতে আব্বা খুবই মনখারাপ করেছিল এবং রাগও হয়েছিল তার। আম্মাকে বলেছিল, ‘ওকে দুইদিন খাবার দেওয়া বন্ধ করে রাখ, তাহলেই ও বুঝবে ক্ষুধার কষ্ট কী। আর কোনোদিনও রাগ করে ভাতের থালা ঠেলে দিবে না।’ আমি সেই শাস্তি পাইনি ঠিকই কিন্তু আব্বার কাছে পরে গল্প শুনেছিলাম ৫০-এর মন্বন্তরের। যা শোনার পর আমার চিরজীবনের মতো শিক্ষা হয়েছিল যে, এক ফোটা খাবারও যেন আমার দ্বারা নষ্ট না হয়। কোনো পরিচিত মানুষ যেন আমার সামনে খাবারের কষ্ট না পায়। আমার সাধ্যের মধ্যে যা পারি, করব।

আব্বা বলেছিল, ‘ইংরেজি ১৯৪৩ সাল অর্থাৎ বাংলায় ১৩৫০ সালে এই দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। আমরা তখন ছোট। গ্রামের বাড়িতে ভাত খেতে হতো শুধু মিষ্টিকুমড়া আর লাউয়ের ঘাটা দিয়ে। কখনো কপালে একটু ডাল জুটত। তোদের দাদা বলে দিয়েছিলেন, ভাতের মাড় ফেলে দেওয়া যাবে না। জমাতে হবে। কেউ কিছু না খেলে ফেলে না দিয়ে রেখে দিতে হবে। দুপুরে আমরা খেতে বসলে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াত অসংখ্য কংকালসার মানুষ। তারা দাঁড়িয়ে থাকতো একটু ভাতের মাড়ের জন্য।’ আব্বা বলেছিল, ‘সেই দৃশ্য আমি কোনোদিনও চোখ থেকে সরাতে পারিনি।’

বাংলা ১৩৫০ সালে দুর্ভিক্ষটা হয়েছিল বলে একে বলা হয় ৫০-এর মন্বন্তর। এই মন্বন্তরে ভারত জুড়ে ৩০ লাখ লোক না খেয়ে মারা যায়। দুই বাংলাতেই মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল। তৎকালীন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক সেনা ও যুদ্ধে নিয়োজিত কর্মীদের জন্য বিপুল পরিমাণ খাদ্য মজুদ করায়, এই দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। ভাতের জন্য সারা বাংলায় হাহাকার পড়ে যায়। গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে দুর্ভিক্ষ। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকে মানুষের কংকালসার দেহ। এই করুণ পরিণতির জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে সরাসরি দায়ী করা হয়েছে ইতিহাসে। বলা হয়েছে এই দুর্ভিক্ষ মানবসৃষ্ট।

এরপর এসেছে ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ। সেই বয়সেই মানুষের না খেতে পেয়ে মৃত্যুর ছবি দেখেছি। অসংখ্য দরিদ্র মানুষ এতোটুকু ভাতের জন্য দরজায় দরজায় ঘুরেছে। বড় হওয়ার পর জেনেছি সেই দুর্ভিক্ষের অর্থনৈতিক-সামাজিক কারণ ও ফলাফল। জেনেছি সেই সময়ের চুরির রাজনীতি।

কয়েকটি গ্রামে কথা বলে জানলাম, সেখানে কৃষকের বাড়িতে চাল আছে এখনো, আছে আলু এবং শাক লতাপাতা। পুকুরে মাছও আছে। চাষিরা এখনো ক্ষেতে কাজ করছেন। তবে অসুবিধায় পড়েছেন দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ, শ্রমিক, মজুর, মুটে-কুলি, বিভিন্ন ধরণের ফেরিওয়ালা, রিকশা, সিএনজি, টেম্পুচালক, তাঁতি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। আছে বাস ও ট্রাকচালকরাও। অনেকেরই বেতন কাজ অনুযায়ী। পরিবহণ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কেউ কেউ অলরেডি বেতন পাচ্ছেন না।

এরপর আসি পোশাক শ্রমিকদের কথায়। এদের কাজের প্রয়োজন এতোটাই বেশি যে স্বাভাবিক সময়েও মালিক, সুপারভাইজারদের গুঁতা, চড়-থাপ্পড় খেয়ে, যৌন হয়রানির শিকার হয়েও তারা কাজ চালিয়ে যান। তাদের শ্রমে চালু থাকে অর্থনীতির চাকা। লকডাউনের সময় হারে হারে বুঝতে পারলাম পোশাক শ্রমিকদের কাছে এই চাকরির প্রয়োজন কতোখানি। অসংখ্য নারী-পুরুষ শুধুমাত্র চাকরি রক্ষার্থে ও বেতন নেওয়ার জন্য দূরদূরান্তের বিভিন্ন জেলা থেকে পায়ে হেঁটে, ট্রাকে ঝুলে, মাছের ভ্যানগাড়িতে করে মালিকদের মিথ্যা আশ্বাসে ঢাকায় এসেছেন, আবার টাকা না পেয়ে ফিরে যেতেও বাধ্য হয়েছেন। রিপোর্টে দেখেছি, এদেরকে গার্মেন্টসের দরজা থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

গ্রামের ছেলে হাশেম ঢাকায় রিকশা চালাতেন। রিকশার আয় থেকেই বউ আর দুই বাচ্চার মুখে খাবার তুলে দেন, ঘরভাড়া দেন এবং গ্রামেও বাবা-মাকে টাকা পাঠান। তারা প্রান্তজন বলে ভিটেমাটি কিছুই নাই। এ মাসের ঘরভাড়াও দিতে পারেননি। এখন দিনে ১০০ টাকাও ঠিকমতো আয় হয় না। দেশের প্রায় ৩ কোটি মানুষের অবস্থা এখন হাশেমের মতো। এদের প্রয়োজন খাবার। বাংলাদেশের মানুষ বহুদিন খাবারের কষ্ট পায়নি। যে যার মতো করে কাজ করে আয় করে। এমনকী নদীভাঙন ও চর এলাকাতেও ভাতের অভাব নাই। কাজেই হঠাৎ করে এই ভাতের অভাব তছনছ করে দেবে মানুষের জীবন।

মানুষ না খেয়ে ২/৩ দিন থাকতে পারে কিন্তু এরপর? ঢাকায় রাজপথ জুড়ে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে সাহায্যের জন্য। কোথাও ত্রাণ গেলে ছিঁড়েখুঁড়ে নিয়ে যেতে চাইছে। এইতো পহেলা বৈশাখের রাতে ডাক্তারদের জন্য তৈরি করা মাদলের খাবার রাস্তা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল কতিপয় যুবক। রাস্তায় নারী-পুরুষের যে দলগুলো দেখা যাচ্ছে এদের চোখে-মুখে ক্রোধ। এদের কেউ কেউ সাহায্য পেলেও সেটা খুব সীমিত। খিদা এমন একটা জিনিষ, যা মেটাতে না পারলে বাড়বে নৈরাজ্য, চুরি-ডাকাতি, বাড়িতে বাড়িতে হামলা। এমনকী লকডাউন উঠে গেলেও একশ্রেণীর মানুষ এগুলো চালিয়েই যাবে।

সরকার এইসব খেটে খাওয়া মানুষের জন্য ৭৬০ কোটি টাকা সহায়তা ঘোষণা করেছে। এই টাকা মানুষকে উদ্ধার করার জন্য যথেষ্ট। এই টাকা নাকি ব্যাংকের একাউন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, দরিদ্র মানুষের তালিকা ধরে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে এইসব মানুষের কতজনের ব্যাংক হিসাব আছে? লকডাউনের এই সময়ে কত দ্রুত সম্ভব এদের সবার ব্যাংক একাউন্ট করে দেওয়া? এমনিতেই ব্যাংক একাউন্ট করাটা বেশ হ্যাপার একটা ব্যাপার। এর মধ্যে গ্রামে-গঞ্জের নিরক্ষর ও স্বল্প শিক্ষিত মানুষের পক্ষে এখন ব্যাংক একাউন্ট খোলাটা কতোখানি সহজ হবে আমি জানি না। এর চেয়ে বিকাশ বা রকেট এর মতো সিস্টেমকে কাজে লাগানো সম্ভব খুব দ্রুত।

নগরীর খেটে খাওয়া এবং প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের অনেকেরই নিজেদের বিকাশ একাউন্ট আছে বা কাছাকাছি দোকানে এজেন্ট আছে দেখলাম। সরকার চাইলে মানুষের তালিকা ধরে এসব ব্যবস্থার মাধ্যমে টাকা দিতে পারে খুব সহজে। স্থানীয় পর্যায়ের সরকারি অফিসগুলোতে আছে সবার নামের তালিকা। শুধু প্রয়োজন একে হালনাগাদ করা ও ফোন নম্বর যোগাড় করা।

অন্যদিকে, সরকার ইতোমধ্যেই বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় চাল পাঠানো শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন বিনামূল্যে ও ওএমএস’র আওতায় এই চাল ও গম বিতরণ করা হবে। যদি সঠিকভাবে এইগুলো বিতরণ করা হয়, তাহলে অভাব হবে না।

তবে জানা যাচ্ছে ত্রাণের চাল চুরি করাও শুরু হয়ে গেছে স্থানীয় নেতা, পাতি-নেতাদের যোগসাজশে। প্রতিদিনই গণমাধ্যমে চুরির খবর প্রকাশিত হচ্ছে। খবরগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে যাচ্ছে সর্বত্র। আবার এও অভিযোগ করা হচ্ছে যে, এলাকায় মুখ চিনে লোকদের সাহায্য দেওয়া হচ্ছে। কোনো খবর কারো কাছে গোপন থাকছে না। এই আপদকালে এ ধরণের অভিযোগ সাংঘাতিক নেতিবাচক পরিণতি ডেকে আনবে। তখন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েও মানুষকে বাঁচানো যাবে না। করোনায় না মরলেও এরা অভাবে মরবে।

শ্রমজীবী এইসব মানুষের সঙ্গে এক, দুইমাসের মাথায় যোগ হবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অনেক মানুষ। লকডাউনের পরপরই বেসরকারি সেক্টরের, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বহু মানুষ চাকরি হারাতে পারেন বলে অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা আশংকা প্রকাশ করেছেন। আমাদের অনেক অভিবাসী ভাইরা তাদের কাজ ছেড়ে দেশে চলে এসেছেন । তারা আদৌ ফিরে যেতে পারবেন কী না, এও একটি বড় চিন্তা। যতোই বাহাদুরি করি না, দেশের রেমিট্যান্সের চাকা কিন্তু তাদেরই হাতে।

এখনই শক্ত হাতে এই চাল-গম চোরদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে না পারলে সরকারকে সমালোচনার মুখে পড়তে হবে। করোনা এমন একটি ভাইরাস যা ধনী-গরীব, রাজা-প্রজা সকলকে পরাস্ত করছে। এটা জেনেও চাল চোরদের হুশ হচ্ছে না। রাস্তায় না খেতে পেয়ে পড়ে থাকা মানুষের, ঘরে ঘরে অভুক্ত মানুষের মুখের গ্রাস যারা অনায়াসে কেড়ে নিতে পারছে, এরা করোনার চেয়েও ভয়ংকর কোনো দানব। ১৯৭৪ সালে যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল দেশে, এর পেছনেও ছিল এই চোরেরা, যারা সেইসময় চাল, চিনি, বাচ্চার দুধ, কম্বল, বিস্কুট কোনো কিছুই চুরি করা থেকে বিরত ছিল না। আর এর ফল ভোগ করতে হয়েছিল তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকারকে। অনিবার্য দুর্ভিক্ষ আমরা এড়াতে পারিনি।

শাহানা হুদা রঞ্জনা, যোগাযোগকর্মী

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

38m ago