প্রবাস

করোনাভাইরাস: বৈশ্বিক পাপের শাস্তি

টোকিওতে বন্ধ অফিসের সামনে। ১৬ এপ্রিল ২০২০। ছবি: রয়টার্স

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব প্রতিদিন বাড়ছে। নিত্য-নতুন জনপদে হানা দিচ্ছে। চীন থেকে শুরু করে ইউরোপ-আমেরিকার গণ্ডি পেরিয়ে এখন বাংলাদেশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সেখানে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কিন্তু, সেই অর্থে বাংলাদেশের কোনো প্রস্তুতি নেই।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশে করোনা যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, চালাচ্ছে তা দেখে আমাদের দেশ কোনো শিক্ষা নিয়েছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ কেন শিক্ষা নেয়নি, কেন প্রস্তুতি গ্রহণ করেনি? এই প্রশ্নের উত্তর বিস্ময়কর, রহস্যঘেরা।

আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ সরলপ্রাণ, ধর্মভীরু। তারা হয়তো বিশ্বাস করেছেন করোনাভাইরাস আল্লাহর গজব। এটা পাপী-তাপীদের ওপর দিয়ে যাবে। মন্দ মানুষ, মন্দ জাতির ওপর দিয়ে যাবে। যারা বেশি-বেশি পাপ করে, সৃষ্টিকর্তার নির্দেশনা অমান্য করে, করোনা তাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালাবে। সুতরাং, আমাদের চিন্তার বিশেষ কোনো কারণ নেই।

সরলপ্রাণ মানুষদের এমন বিশ্বাস হয়তো একদম মিথ্যা নয়। মানুষ যখন মাত্রাতিরিক্ত পাপে লিপ্ত হয় তখন খোদায়ী গজব আসে। মানুষকে নানা দূর্যোগের মধ্যে ফেলে শাস্তি দেওয়া হয়। অন্যায় কাজ থেকে ফিরে আসার বার্তা দেওয়া হয়। এখনো হয়তো এমনটাই হচ্ছে। পৃথিবীর মানুষ এত বেশি পাপ করে ফেলেছে যে তাদের জন্য শাস্তি অবধারিত হয়ে পড়েছে। সৃষ্টিকর্তা রাগান্বিত হয়ে করোনাভাইরাস পাঠিয়েছেন। আর এই ভাইরাস যেহেতু কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না, সেহেতু আমরা এটাকে বৈশ্বিক গজব বা শাস্তি হিসেবে ধরে নিতে পারি। এটাকে মানুষের বৈশ্বিক পাপের ফসল হিসেবে গণ্য করতে পারি।

আমাদের দেশের সরলপ্রাণ, ধর্মভীরু মানুষরা বুঝতে পারেননি বৈশ্বিক পাপ কী? যে কারণে তারা অন্যান্য দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখে সতর্ক হননি। তারা প্রতিদিন এলোমেলো, অথর্ব কথা বলেছেন। গোয়ার্তুমি করেছেন। বিজ্ঞানীদের কথা, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ আমলে তোলেননি। তারা ভেবে নিয়েছেন, গরম পড়লে ‘কোভিড ১৯’ হবে না। মসজিদে গেলে করোনাভাইরাস আক্রমণ করবে না। ভালো মানুষ, সৎ মানুষরা এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কিন্তু, আসল বিষয় তা নয়। প্রকৃত বিষয় বুঝতে হলে প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে বৈশ্বিক পাপ কী? কারা বৈশ্বিক পাপী?

বৈশ্বিক পাপ হলো প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করা। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম অমান্য করা। প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকর কাজে লিপ্ত থাকা। যারা প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করে তারা সবাই বৈশ্বিক পাপী। সুতরাং বৈশ্বিক পাপ থেকে আমরা কেউ যেমন মুক্ত নই, একইভাবে পৃথিবীর কোনো মানুষ এখন আর নিরাপদ নয়।

যে কথা বিজ্ঞানীরা বহুদিন থেকে বলে আসছেন— জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে, নয়তো পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে। সত্যিকারার্থে এখন হয়েছেও তাই। পৃথিবীর মানুষ এতবেশি প্রকৃতিবিরোধী কাজে লিপ্ত হয়েছে যে এমন একটা বৈশ্বিক গজবের আশঙ্কা অনেক দিন থেকে করছিলেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মানুষকে বার বার সাবধান করেছেন। সতর্ক হতে বলেছেন। কিন্তু, কেউ কথা শোনেনি। রাজনীতিকরা, ধর্মনেতারা ধারাবাহিকভাবে অজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন।

বিজ্ঞানীরা অনেক বছর থেকে বলছেন, বাতাসের কার্বন কমাতে হবে। পানির দূষণ, শব্দের দূষণ, মাটির দূষণ কমাতে হতে। পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। কিন্তু, পৃথিবীর মানুষ তা আমলে নেয়নি। কলকারখানার চিমনি থেকে কালো ধোয়া ছেড়ে বাতাস দূষিত করেছে। বর্জ্য ফেলে পানি, মাটি দূষিত করেছে। গাছ-গাছালি কেটে বন-জঙ্গল বিনাশ করেছে। পাহাড়-পর্বত ধ্বংস করেছে। সাগর, নদী দখল করেছে। ভরাট করেছে। শোষণ করেছে। ভূপৃষ্ঠের ভারসম্য আমলে না নিয়ে অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মান করেছে। অতিমাত্রায় খনিজ উত্তোলণ করেছে। প্রতি সেকেন্ডে টন-টন অপচনশীল প্লাস্টিক ফেলে দূর্বিসহ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। লাখ লাখ টন বোমা ফাঁটিয়েছে। অতিমাত্রায় জ্বালানি, রাসায়নিক ও মাদকের ব্যবহার বাড়িয়েছে। জীবাণু অস্ত্র বানিয়েছে। খাদ্যে ভেজাল দিয়েছে। নিকোটিন, অ্যালকোহলসহ জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অখাদ্যে অভ্যস্ত হয়েছে। পরিবেশবান্ধব বন্যপ্রাণী খেয়ে উজাড় করেছে। পোষাপ্রাণীর সঙ্গে বিকৃত যৌনাচারে লিপ্ত হয়েছে। অসংযত জীবন যাপনের অভ্যাস করেছে।

বিজ্ঞানীরা বার বার বলেছেন, গ্রিনহাউস গ্যাসের ভারসম্য থাকছে না। পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ওজনস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সাগরতলের গভীরতা কমে যাচ্ছে। উষ্ণতা বাড়ছে। পাহাড়ের সাগরের বরফ চাঁই গলে যাচ্ছে। অতিরিক্ত রাসায়নিক ও যন্ত্রনির্ভর জীবন ভয়াবহতা ডেকে আনছে। জলবায়ু ও জীববৈচিত্র ধ্বংস হচ্ছে। কেউ গুরুত্ব দেয়নি। মানুষ ক্ষমতার লোভে, অতিমুনাফার লোভে বেপরোয়া, স্বার্থপর হয়ে উঠেছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হওয়া এত এত ঝড়, বন্যা, খরা মানুষকে ফেরাতে পারেনি। নিত্য-নতুন রোগব্যাধীতেও মানুষের হুশ হয়নি। ছোট-ছোট এসব গজব বা শাস্তিকে মানুষ অবহেলা করেছে। প্রতিদিন নতুন নতুন উপায়ে প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করেছে। প্রকৃতির নিয়ম অমান্য করেছে। সুতরাং করোনার মতো একটা বৈশ্বিক মহামারি অনেক দিন থেকে প্রত্যাশিত ছিল।

যদি আমাদের দেশের কথা দিয়ে চিন্তা করি তাহলেও বিষয়টা সহজে বোঝা যাবে। আমাদের প্রবীণদের মুখে প্রায়ই শোনা যায়— এখন আর কোনকিছুতে আগের মতো স্বাদ নেই, গন্ধ নেই। আগে কোনো বাড়িতে ইলিশ ভাজা হলে বহু দূর থেকে ঘ্রাণ পাওয়া যেতো। এখন পাশের ঘরে থেকেও বোঝা যায় না। আগে ফলমূলে যেমন স্বাদ ছিল, ঘ্রাণ ছিল এখন তা নেই। আগে যত রঙের বুনোফুল ফুটতো এখন আর ফোটে না। আগে গাছের পাতায় যেমন সজীবতা দেখা যেতো এখন দেখা যায় না। এখন আর আগের মতো পাখির গান শোনা যায় না। ছয় ঋতু খুঁজে পাওয়া যায় না। স্বচ্ছ আকাশ দেখা যায় না। এই কথাগুলো আমরা শুধু শুনে এসেছি, কিন্তু গভীর করে চিন্তা করিনি।

আসলে এই পরিবর্তনগুলো প্রকৃতি দূষণের ফল। আমরা প্রতিদিন প্রকৃতি দূষণ করেছি। জলবায়ু নষ্ট করেছি। অতিমাত্রায় রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করেছি। নদী-খাল-বিল ভরাট করেছি। বাঁধ দিয়েছি। নিষ্কাশন না করে বর্জ্য যত্রতত্র ফেলেছি, ঢেলেছি। প্রকৃতিকে প্রতি মুহূর্তে শোষণ করেছি। এগুলো ছিল প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ বা বৈশ্বিক পাপের প্রাথমিক সতর্ক বার্তা। যা আমরা কখনো আমলে নেইনি। বোঝার চেষ্টা করিনি। একইভাবে পৃথিবীব্যাপী প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ হয়েছে আরও ব্যাপক ও ভয়াবহ মাত্রায়। যা পৃথিবীর পক্ষে ধারণ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে পৃথিবীর মানুষকে আজ করোনাভাইরাসের মতো অদৃশ্য শক্তির কাছে করুণভাবে পরাজিত হতে হচ্ছে।

করোনাক্রান্ত হয়ে পৃথিবীতে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছেন ঠিক, কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যাবে পৃথিবীতে এমন একটা ‘বিরতি’ দরকার ছিল। লকডাউন করে দুনিয়ার মানুষ এখন ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছে। বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, মাটিদূষণ করা থেকে বিরত আছে। মাত্র কদিনের এই বিরতির সুফল খালি চোখে দেখা যাচ্ছে। জানালা খুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখুন, এত স্বচ্ছ আকাশ কবে দেখেছেন বা আদৌ দেখেছেন কিনা মনে করতে পারবেন না। যে পানিতে ব্যাঙ্গাচির মতো সামান্য জলজপ্রাণী টিকতে পারেনি আজ সেখানে নয়ন জুড়ানো ডলফিন খেলা করছে। নদী-খাল-বিল মাছে ভরে গেছে। গাছে-গাছে এত সবুজ, এত রঙ কবে দেখেছেন? এত পাখির কলকাকলি কবে শুনেছেন? এত পরিচ্ছন্ন হালকা বাতাসে কবে নিশ্বাস নিয়েছেন? জানি, মনে করতে পারবেন না।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাত্র এই কদিনেই বাতাসের কার্বন প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে। গ্রিনহাউজ গ্যাসের ভারসাম্য ফিরতে শুরু করেছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করেছে। সুতরাং এটাই হলো করোনার শিক্ষা। এটাই হলো বৈশ্বিক পাপ থেকে ফিরে আসার শক্ত বার্তা। নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের আহবান।

পৃথিবীর মানুষ যদি করোনাভাইরাস নামের বৈশ্বিক গজব থেকে শিক্ষা নেয়, প্রকৃতিদূষণ থেকে ফিরে আসে, তবে আরও অনেকদিন আমরা সুস্থ, সবলভাবে বাঁচতে পারবো। অন্যথায় এমন আরও অনেক গজব, অনেক পাপের শান্তি ভোগ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Students to resist AL event today

The student movement against discrimination will hold a mass gathering at Zero Point in the capital’s Gulistan today, demanding trial of the Awami League.

2h ago