ডায়রি

যাত্রাশিল্পী আবুল কালাম আজাদ ও ২ প্যাকেট খাদ্যদ্রব্য

যাত্রাশিল্পী আবুল কালাম আজাদ। ছবি: স্টার

ঘড়ির কাঁটায় ঠিক দুপুর ১টা। মানিকগঞ্জ প্রেসক্লাবের তিন তলায় নিউজ রুমে বসে কাজ করছিলাম। হঠাৎ তাঁর চোখে চোখ পড়তেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। মুখে মাস্ক পড়া ছিল, তবুও চিনলাম। নাম জানতাম না। তবে, বিভিন্ন সময় মানিকগঞ্জের বিভিন্নস্থানে গান গাইতে দেখেছি। গানের কণ্ঠ তার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো। গান শুনে মুগ্ধ হয়ে অনেকেই তাকে সাহায্য করেছেন। আমিও করেছি। থাক সে কথা।

আমাদের অফিস সহকারী আবু মুসা তরফদার তাঁকে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পরিচয় জানতে চায়। তিনি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েই থাকলেন, কোনো উত্তর দিলেন না। আমি কাজ রেখে তাঁর কাছে গেলাম। আগের মতোই তাঁকে অনুরোধ করলাম একটি গান শোনাতে। এক বলাতেই তিনি তাঁর মুখের মাস্কটি খুলে গান গাইতে শুরু করলেন। অন্যান্য সহকর্মীরা তার গান শুনে মুগ্ধ হলেন। হাতের কাজ রেখে উঠে এসে তার গানের ভিডিও ও ছবি তুলতে লাগলেন। গান শেষ হলো। এবার জানতে চাইলাম। এখানে আসার কারণ কী? অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে মাথা নিচু করে বললেন, ‘স্যার, খুব কষ্টে আছি।’

জিজ্ঞাস করতেই তিনি তাঁর ও পরিবার সম্পর্কে বললেন। নাম আবুল কালাম আজাদ। বয়স ৬৫ ছাড়িয়েছে। বাড়ি পাবনা জেলায়। গত ২০ বছর ধরে তিনি মানিকগঞ্জে থাকেন। জেলা শহরের জয়রা এলাকায় ২ হাজার টাকার ভাড়া বাসায় থাকেন। আছেন স্ত্রী আর দুটি ছেলে। স্ত্রী অন্যের বাড়িতে কাজ করেন আর তিনি মানিকগঞ্জ বাজারে কুলির কাজ করেন। সুযোগ হলে ঘুরে ঘুরে গান করেন।

দুটি সন্তানের একজন সরকারি দেবেন্দ্র কলেজে অনার্সে পড়ে, অন্যজন স্থানীয় জয়রা উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ে। এখন খুব কষ্টে তাঁর সংসার চলছে। কারণ, কুলির কাজও করতে পারছেন না, আবার ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে যে কিছু আয় করবেন— সেটাও পারছেন না।

সামাজিক দুরত্ব রাখতে গিয়ে তাঁর স্ত্রীও কাজ হারিয়েছেন কয়েকটি বাড়ির। সব অফিস-আদালত বন্ধ। সাংবাদিকদের অফিস খোলা আছে— তাই তিনি খুব আশা করে এসেছেন।

আমরা সংবাদকর্মীরা যে কতখানি ঝুঁকি, সংকট আর সীমাবদ্ধতা নিয়ে চলছি তা নিশ্চয়ই তিনি জানবেন না। তাঁর জানারও কথা না। কারণ সংবাদকর্মীরা সবকিছুতেই সামনের সারিতে থাকেন। তাইতো, তাঁদের সম্পর্কে প্রান্তিক জনগণের বড় ধরণের প্রত্যাশা থাকতেই পারে।

যশোরের নামকরা যাত্রাদল ‘বাসন্তী অপেরা’য় টানা ১৭ বছর তবলা বাদকের দায়িত্ব পালন করা আবুল কালাম আজাদকে এই ৬৫ বছর বয়সে কুলির কাজ করতে হচ্ছে। করোনার থাবায়, কাজ হারিয়ে শেষ পর্যন্ত রাস্তার নামতে হয়েছে। মুখ ফুটে কিছু চাইলেন না। তবুও সহকর্মীদের নিয়ে বসলাম। কতটুকু করতে পারবো জানি না। তবে, কিছুতো দেওয়া দরকার।

একজন একশত টাকা দিলেন। আমিও কিছু দিব বলে পকেটে হাত দিলাম। আবার থেমে গেলাম। ক্ষাণিকক্ষণ চিন্তা করে প্রেসক্লাবের সভাপতিকে ফোন দিলাম। তিনি বললেন, ‘প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্য মাহবুব মোর্শেদ হাসান রনু সাহেবের পক্ষ থেকে প্রেসক্লাবকে কিছু খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে দরিদ্র ও দুঃস্থ পরিবারের মাঝে বিতরণ করতে। ইতোমধ্যে বিতরণও করা হয়েছে।’

তবে নিশ্চিত করলেন, দুটি প্যাকেট আছে। একটি প্যাকেটে আছে চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, তেলসহ ১০ কেজি এবং অন্য প্যাকেটে আছে ৫ কেজি আটা ও ১ কেজি চিনি। দুটি প্যাকেট তুলে দিলাম তাঁর হাতে।

প্যাকেট দুটি তাঁর হাতে যখন তুলে দিলাম, তিনি তাঁকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। এই প্যাকেট তাঁর বহন করতে কষ্ট হতে পারে ভেবে মোটরসাইকেলে চড়িয়ে দিয়ে আসতে চাইলাম। মাথা নিচু করে বললেন, ‘স্যার আমি পারবো। আমিতো মাথায় করে নিতে পারি। কষ্ট হবে না।’

অফিস সহকারী ওই ব্যাগটা যখন ভবনের নিচ পর্যন্ত দিয়ে আসলো, তখন তিনি আমাদের অফিস সহকারীকে বললেন, ‘স্যার এটা আমার খুব কাজে লাগবে। আমার খুব উপকার হইছে।’ আমি উপর থেকে দেখলাম আর ভাবলাম— মানুষ এখন কতটা অসহায় হয়ে পড়েছে।

সারা দেশেই করোনাভাইরাসের কারণে যানবাহন ও দোকান-পাট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন কর্মহীন মানুষেরা। ভাড়া দোকানে যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন তারা ভাড়া দিতে পারছেন না। কর্মহীন মানুষেরাও তাদের ঘরভাড়া দিতে পারছেন না। মধ্যবিত্তরাও কষ্টে আছেন। ফোন আসে প্রতিনিয়ত। এই দুর্দিনে, আমরা আমাদের সাধ্য অনুযায়ী যদি প্রতিবেশীদের পাশে দাঁড়াই, তাহলে তাদের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে।

জাহাঙ্গীর শাহ: দ্য ডেইলি স্টারের মানিকগঞ্জ সংবাদদাতা

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
rally demanding ban on awami league in Dhaka

Blockade at Shahbagh demanding AL ban

The demonstration follows a sit-in that began around 10:00pm last night in front of the Chief Adviser's residence

4h ago