কোথাও কেউ ক্ষুধার্ত না থাকুক কিংবা অবহেলায় কারো মৃত্যু না হোক
ধনী-গরিব সবার ওপরেই পড়েছে মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাব। তবুও, রাষ্ট্র ও সচ্ছল মানুষদের উচিত— সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া, প্রান্তিক ও বিচ্ছিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতি এ সময়ে বিশেষ নজর দেওয়া। এসব সম্প্রদায়ের সিংহভাগই কেবল দরিদ্র কিংবা হতদরিদ্র নয়, তারা দারিদ্র্যের ত্রিমুখী চ্যালেঞ্জ ও দুর্বলতার মুখোমুখি। দেশে চলমান দুর্যোগকালীন তাদের অনেকেই হয়তো ক্ষুধার্ত কিংবা অনাহারে জীবন যাপন করে থাকতে পারেন। দেশে চলমান লকডাউনে কীভাবে এসব সম্প্রদায়ের মানুষের দিন কাটছে, সে চিত্র আমাদের জানা উচিত।
মালিকদের সন্তুষ্টির জন্য লকডাউনের মধ্যেও কাজ করে যাচ্ছেন সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের ১৬৩টি চা-বাগানের শ্রমিকরা। দেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের মতো তারাও বেতন ও অন্যান্য সুবিধাসহ ছুটির দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু, সরকার ও বাগানের মালিকদের সিদ্ধান্ত, ‘বাধা’ চা-শ্রমিকরা অবশ্যই কাজ করবেন। কারণ, তাদের ধারণা, চা-শ্রমিকরা করোনার ঝুঁকি থেকে মুক্ত এবং তারা নিরাপদেই বসবাস করেন; কাজেই চা-বাগানগুলো চালু রাখতে কোনো সমস্যা নেই। বলা বাহুল্য, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারঘোষিত প্রণোদনা সুবিধার আওতায় চা-শ্রমিকরা নেই।
চা-বাগানগুলোতে বসবাসরত প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের আরেকটি গুরুতর বিষয় রয়েছে। সেটি হলো— চা-বাগানগুলোতে সাধারণত এক পরিবার থেকে একজনই চা-বাগানে কাজ করেন এবং তার দৈনিক আয় ১০২ টাকার নগদ মজুরি ও কিছু রেশন সুবিধা। কিন্তু, পাঁচ সদস্যের পরিবারের পক্ষে এইটুকু দিয়ে বেঁচে থাকা দায়। প্রত্যেক চা-শ্রমিক পরিবারের অন্তত একজন প্রতিদিন বাগানের বাইরে কৃষিকাজ, ইটভাটা, ফলমূল ও লেবু বাগান বা বাড়িঘরে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে কিছু রোজগার করেন।
প্রায় এক লাখ স্থায়ী চা-শ্রমিকের সংগঠন বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, ‘চা-বাগানে যত শ্রমিক তার থেকেও বেশি মানুষ ঠিকাদারের মাধ্যমে বা নিজেরা কাজ খুঁজে প্রতিদিন রোজগার করেন।’
দেশে বর্তমানে লকডাউন জারি করার পরেও এসব মানুষ বাগানের বাইরে কাজের খোঁজে বেরিয়েছেন। বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী বলেন, ‘বাগানের বাইরে কাজ করা শ্রমিকদের অনেকেই এখন আর কাজের জন্য বাইরে যেতে পারছেন না। ফলে এসব চা-শ্রমিক পরিবারকে খুবই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।’
চা-শ্রমিকরা এখনো সরকারঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় থেকে ছুটি চান। উদ্বৃত্ত ও বেকার শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সরকার, বাগান মালিক ও চা-শ্রমিক ইউনিয়নের উচিত দ্রুত তাদের তালিকা তৈরি করা এবং তাদের পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তার ব্যবস্থা করা। একইসঙ্গে কর্মক্ষেত্রে চা-শ্রমিকদের সুরক্ষা ব্যবস্থা, যা এখন নেই, তা নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশে বসবাসরত অবাঙালি পেশাজীবী সম্প্রদায় হরিজন। যারা সুইপার কিংবা ক্লিনার নামে পরিচিত। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার অধীনস্থ বিভিন্ন কলোনিতে গাদাগাদি করে বাস করেন থাকেন হরিজন সম্প্রদায়ের লোকেরা। বেশিরভাগ হরিজন পল্লিই শহরের সবচেয়ে নোংরা স্থানে অবস্থিত। সেখানে প্রায় এক লাখ হরিজনের বসবাস। অর্থাৎ, শহর পরিষ্কার রাখছেন যে হরিজনরা, তারাই বাস করছেন সবচেয়ে নোংরা স্থানে। তাদের কলোনিগুলোতে যে পরিমাণ ত্রাণ ও সুরক্ষা উপকরণ দেওয়া হয়েছে, প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল।
হরিজনদের সংগঠন বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদের সভাপতি কৃষ্ণলাল বলেন, ‘ঢাকায় সিটি করপোরেশন থেকে আমাদের এখন পর্যন্ত একবার কিছু সাবান ও ব্লিচিং পাউডার দেওয়া হয়েছে।’
চা-শ্রমিকদের মতো যেসব হরিজন অস্থায়ী শ্রমিক, তারা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। এ ছাড়া, অনেকে তাদের ডেকে নিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ দেন। বর্তমানে চলমান লকডাউনে কাজ পাচ্ছেন না এসব উদ্বৃত্ত হরিজন-শ্রমিক। তাদেরও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিশেষ সহায়তা প্রয়োজন।
করোনার প্রভাবে মারাত্মক পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে দেশের ভাসমান জনগোষ্ঠী বেদে সম্প্রদায়। সমাজ সেবা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বসবাসরত বেদের সংখ্যা ৭৫ হাজার ৭০২। তবে, বেদে জনগোষ্ঠীর দাবি, তাদের সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ।
তাদের বেশিরভাগই দেশের বিভিন্ন স্থানে রাস্তার ধারে কিংবা খোলা মাঠে তাঁবুতে থাকেন। এই অস্থায়ী বসবাসের ক্যাম্পে থাকার সময় তারা স্থানীয় মানুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন। ফলে স্থানীয় প্রশাসন কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে তারা প্রত্যাশিত সহায়তা নাও পেতে পারেন। চলমান এই দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশনা দিয়ে সরকার তাদের পাশে দাঁড়াতে পারে।
দেশে প্রায় এক লাখ যৌনকর্মী রয়েছেন, যাদের মধ্যে চার হাজারের মতো বাস করেন দেশের ১১টি যৌনপল্লিতে। বলা বাহুল্য, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে যৌনপল্লিগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে যৌনপল্লি ভিত্তিক যৌনকর্মীরা যে সহায়তা পাচ্ছেন, তা পর্যাপ্ত নয়। দেশের প্রায় ৩৭ হাজার ভাসমান যৌনকর্মীর মধ্যে অনেকের হয়তো থাকার জায়গাও নেই। এ ছাড়া, আরও প্রায় ৩৭ হাজার যৌনকর্মী বাসা-বাড়ি থেকে কাজ করে থাকেন এবং হোটেল ভিত্তিক যৌনকর্মী রয়েছেন আরও প্রায় ১৬ হাজার।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১০ হাজার তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ রয়েছেন। দেশে চলমান সংকটময় পরিস্থিতিতে ভাসমান যৌনকর্মীদের মতো বেহাল দশা তাদেরও। কারণ, বিভিন্ন বাজার ও রাস্তার মানুষদের কাছ থেকে চাঁদা ও ভিক্ষা সংগ্রহ করেই তারা জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। তাদের মধ্যে অনেকেই আবার যৌনকর্মী হিসেবেও কাজ করেন। দেশের এই সংকটময় সময়ে সাহায্যের জন্য আকুতি জানাচ্ছেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ ও যৌনকর্মীরা।
পেশাগতভাবে প্রান্তিক ও সামাজিক অস্পৃশ্যতার শিকার জলদাসরা বংশ পরম্পরায় একটি মৎস্যজীবী জনগোষ্ঠী। দেশের কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলায় বাস করছেন প্রায় দেড় লাখ জলদাস। মূলত সমুদ্রে মাছ ধরে জলদাসরা জীবিকা নির্বাহ করেন; বর্তমানে সমুদ্রে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
জলদাস জনগোষ্ঠীর একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও লেখক হরিশংকর জলদাসের দেওয়া তথ্যানুসারে, উপকূলীয় গ্রামে বসবাসরত অনেক জলদাস পরিবারের কাছে এখনো ত্রাণসামগ্রী পৌঁছায়নি। স্থানীয় প্রশাসনের উচিত এই অভিযোগ আমলে নিয়ে জলদাস সম্প্রদায়ের প্রতি সহায়তার পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া।
দেশের ১৩টি জেলার ৭০টি ক্যাম্পে বাস করছেন তিন লাখ উর্দুভাষী বিহারি। তারাও কোনো ধরনের সহায়তা পাচ্ছেন না বলে জানা গেছে। ৭০টি ক্যাম্পের মধ্যে ৩৩টিই ঢাকায়।
গত ৯ এপ্রিল স্ট্র্যান্ডেড পাকিস্তানিজ জেনারেল রিপ্যাট্রিয়েশন কমিটির (এসপিজিআরসি) সাধারণ সম্পাদক এম শওকত আলী বলেন, ‘বিহারি ক্যাম্পগুলোতে এখনো কোনো ধরনের সরকারি ত্রাণসামগ্রী এসে পৌঁছায়নি। আমরা ক্যাম্পগুলোতেই রয়েছি। আমাদের খাদ্য সহায়তা ও সুরক্ষা উপকরণ প্রয়োজন।’
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা যশোর, খুলনা ও সাতক্ষীরার ৪১টি গ্রামে বাস করছেন কায়পুত্র জনগোষ্ঠীর ১২ হাজার মানুষ। তারা সাধারণত শূকর চরানো জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত, যে কারণে তারা সমাজের একটি বড় অংশের কাছে ‘অচ্ছুৎ’ হিসেবে বিবেচিত। করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েছে তাদের ওপরেও। কায়পুত্র জনগোষ্ঠী এবং তাদের পালিত শূকরগুলো মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে অকল্পনীয় জটিলতার মধ্যে দিয়ে জীবন যাপন করছে।
যশোরের শূকর ব্যবসায়ী দিলিপ মণ্ডল সম্প্রতি তার ৬০০ শূকরের পাল ও ১৫ জন রাখাল নিয়ে শরীয়তপুরে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘শরীয়তপুরের লোকেরা এমনভাবে আমাদের দিকে আঙুল তুলল, যেন আমরা অপরাধী। তারা আমাদের দ্রুত সেই এলাকা ছাড়তে বলে। আমরা শূকরগুলো নিয়ে হেঁটে নড়াইলে চলে আসি।’ লকডাউন চলাকালে শূকর বা শূকরের মাংস বিক্রি কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে বসবাসরত ঋষিরা বংশ পরম্পরায় চর্মকার, চামড়া-শ্রমিক ও বাদক। তাদেরকে মুচি, চামার ও চর্মকার নামেও অভিহিত করা হয়। করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েছে তাদের ওপরেও। যদিও তাদের বেশিরভাগই যশোর, সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলায় বসবাস করেন, কিন্তু দেশের প্রায় সব জেলাতেই ঋষি গোষ্ঠীর মানুষ রয়েছেন।
তাদের মধ্যে যারা মুচি হিসেবে কাজ করেন কিংবা যারা বাঁশের জিনিস তৈরি করে থাকেন, বর্তমানে তাদের কাজ নেই। সাতক্ষীরায় ঋষি ও দলিতদের জন্য কর্মরত সংগঠন পরিত্রাণের পরিচালক মিলন দাস বলেন, ‘দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলায় বসবাসরত ঋষি সম্প্রদায়ের মানুষেরা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের ত্রাণসামগ্রী পাচ্ছে না বললেই চলে।’
বাংলাদেশে আছেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অন্তত প্রায় ২০ লাখ মানুষ। এদের মধ্যে যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম চাষ করেন, প্রত্যন্ত এলাকায় বাস করেন ও কৃষিকাজ করেন, চলমান সংকটময় পরিস্থিতিতে তারাও কঠিন সময় পার করছেন। উন্নয়ন পরামর্শক হ্যান হ্যান বলেন, ‘বছরের এ সময়টি পার্বত্য চট্টগ্রামে এমনিতেই সংকটের মাস, আর এখনি এখানে খাদ্য সংকটের ব্যাপারটি স্পষ্ট।’
পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা ও স্থানীয় প্রশাসন এ ব্যাপারে অবগত। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য প্রকাশ কান্তি বড়ুয়া বলেন, ‘কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলে খাবার পৌঁছানো কঠিন। খাদ্য সংকটের সময় অভাবী মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছানোর ক্ষেত্রে আমরা ইউএনও ও ইউনিয়ন পরিষদের তৈরি করা তালিকা অনুসরণ করছি।’
এ ছাড়া, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের, বিশেষ করে কৃষক, দিনমজুর, রেলস্টেশনে কাজ করা শ্রমিক ও যারা বস্তিতে থাকেন, সরকারে উচিত তাদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া।
সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া, প্রান্তিক ও বিচ্ছিন্ন আরও অনেক সম্প্রদায়ও রয়েছে, যাদের এ মুহূর্তে সহায়তা প্রয়োজন। এদের মধ্যে রয়েছেন— প্রতিবন্ধী, নাপিত, ধোপা, তাঁতি, দর্জি, কসাই, কামারসহ অনেকেই। এ ছাড়া, যারা রাস্তায় ভিক্ষা করেন ও রাস্তাতেই থাকেন, তাদের কথা ভুলে গেলেও চলবে না।
বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গে পুরো দেশই গভীর শোকের মধ্যে রয়েছে। আমরা জানি না এ মহামারির শেষ কবে। যা হোক, করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদেরও পিছিয়ে পড়া ও প্রান্তিক সম্প্রদায়ের ৭০ লাখ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানো উচিত। আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত— কোথাও কেউ ক্ষুধার্ত না থাকুক কিংবা অবহেলায় কারো মৃত্যু না হোক।
ফিলিপ গাইন: গবেষক ও সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের (শেড) পরিচালক
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments