যুক্তরাষ্ট্র-চীন-বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, করোনাভাইরাস নিয়ে যত ভুল
শুরু থেকেই করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের জন্য একে অপরকে দুষছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। করোনা মহামারি মোকাবিলায় হিমশিম খেলেও দোষারোপ থেমে নেই যুক্তরাষ্ট্রের।
গত ১৪ এপ্রিল চীনের প্রতি পক্ষপাতিত্বের কারণ দেখিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় (ডব্লিউএইচও) অনুদান বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মূহূর্তে, মহামারি মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব ও সমন্বয় প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সরিয়ে দিলে কোনো বৈশ্বিক সমন্বয় ও নেতৃত্ব ছাড়া এই মহামারি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট জানায়, ডব্লিউএইচওর বিরুদ্ধে অব্যবস্থাপনা ও লুকোচুরির অভিযোগ করেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। জাতিসংঘের এই সংস্থাকে ‘চীনকেন্দ্রিক’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
চীনের প্রতি পক্ষপাতি হওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আদহানম। ট্রাম্পের এমন সিদ্ধান্তকে ‘দুঃখজনক’ বলে মন্তব্য করেন তিনি। করোনা নিয়ে রাজনীতি না করে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকে একসঙ্গে মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আহ্বান জানান মহাপরিচালক আদহানম।
এদিকে, ট্রাম্পের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র মহামারি নিয়ে রাজনীতি করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করেছে চীন। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জাও লিজিয়ান বলেন, ‘চীনের উহান শহরে নয়, করোনাভাইরাসের উৎপত্তি যুক্তরাষ্ট্রে হয়ে থাকতে পারে।’
সংক্রমণের শুরু
২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্তের খবর প্রকাশ করে চীন। হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে ২৭ জন নিউমোনিয়ার রোগীর খবর পাওয়া যায়। পরদিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে একটি ম্যানেজমেন্ট টিম গঠন করা হয়। ৫ জানুয়ারি প্রথমবারের মতো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মানুষ থেকে মানুষে এই ভাইরাস সংক্রমণের কোনো প্রমাণ নেই। চীনে ভ্রমণ বা বাণিজ্যে কোনোপ্রকার নিষেধাজ্ঞার প্রয়োজন নেই বলে জানানো হয়।
অস্পষ্ট নির্দেশনা
জানুয়ারির শুরু থেকে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে মহামারি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রযুক্তি ব্যবহারে জোর দেওয়ার আহ্বান জানায় ডব্লিউএইচও। গত ১৪ জানুয়ারি ডব্লিউএইচওর কর্মকর্তা মারিয়া ভ্যান কারখোভ বলেন, ‘প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে করোনার বিস্তার ঠেকানো যেতে পারে।’
তবে, সেসময় টুইটে সম্পূর্ণ বিপরীত কথাও বলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘এই ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই।’
সংক্রামক রোগ হিসেবে ঘোষণা
গত ২০ জানুয়ারি করোনা সংক্রমণ প্রকট রূপ ধারণ করলে সংক্রমণ নিয়ে নতুন ঘোষণা দেয় চীন। ২০০২-০৩ সালে সার্স ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সময় নেতৃত্ব দেওয়া বিখ্যাত চীনা এপিডেমিওলজিস্ট জং ন্যানসেন ঘোষণা করেন, ‘নতুন করোনাভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে ছড়াচ্ছে। অনেক স্বাস্থ্যকর্মীর দেহে ভাইরাসটির সংক্রমণ হয়েছে।’
এমন ঘোষণার পরপরই ডব্লিউএইচও জানায়, বেইজিংয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ভাইরাসটি অন্তত কিছু মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।
বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা
গত ৩০ জানুয়ারি বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে ডব্লিউএইচও। সেসময় সংস্থাটির মহাপরিচালক তেদরোস আদহানম বলেন, ‘চীনের পরিস্থিতি বিবেচনা করে এই ঘোষণা দেওয়া হয়নি। বরং অন্যান্য দেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আমরা এই ঘোষণা দিচ্ছি।’
এই ভাইরাস দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।
তবে, সেসময়ও ভ্রমণ ও বাণিজ্যের উপর নিষেধাজ্ঞার প্রয়োজন নেই বলে জানান তিনি।
মার্কিন নাগরিকদের চীন ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা
ডব্লিউএইচওর পরামর্শ সত্ত্বেও ৩১ জানুয়ারি মার্কিন নাগরিকদের চীন ভ্রমণে যেতে নিষেধ করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনিং ট্রাম্পের ওই ঘোষণার জবাবে বলেন, ‘ডব্লিউএইচওর নির্দেশনার বিরুদ্ধে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এমন নিষেধাজ্ঞা অপ্রত্যাশিত ও ভিত্তিধীন। যুক্তরাষ্ট্রের এসব ব্যবস্থার কারণে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক আদহানম বলেন, ‘ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে ভালোর চেয়ে ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি। কারণ এর ফলে তথ্য বিনিময় ও চিকিৎসা সামগ্রীর সরবরাহ বিঘ্নিত হয়, অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
চীন-ডাব্লিউএইচও যৌথ মিশন
জানুয়ারির শেষদিকে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দেখা করেন ডাব্লিউএইচওর মহাপরিচালক। সেসময় তিনি জানান, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সম্পর্কে জানতে চীনে বিশেষজ্ঞ দল পাঠাবে ডাব্লিউএইচও।
এর প্রায় তিন সপ্তাহ পর চীন ও ডাব্লিউএইচওর একটি দল যৌথ মিশন শুরু করে। কিছুদিন পরই উহানের পরিস্থিতি পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ করেন তারা।
পরিদর্শন শেষে যৌথ মিশন জানায়, প্রার্দুভাব নিয়ন্ত্রণের জন্য চীনের ব্যবস্থা ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, দ্রুত ও কার্যকর।
মহাপরিচালক আদহানম চীনা কর্তৃপক্ষের ‘অসাধারণ উদ্যোগ’ গ্রহণের প্রশংসা করেন।
ট্রাম্পের যত অভিযোগ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বেইজিংয়ের সুবিধা অনুযায়ী করোনা সম্পর্কে তথ্য দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোলান্ড ট্রাম্প।
এই সপ্তাহে ট্রাম্প জানান, জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ হচ্ছে না এমন ঘোষণার কারণে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে।
তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার বিপক্ষে যাওয়া ছিল ডব্লিউএইচওর সবচেয়ে বড় ভুল। সেটি বিপজ্জনক একটি সিদ্ধান্ত ছিল। ভাগ্যক্রমে, আমি এই বিষয়ে নিশ্চিত থাকতে পারছিলাম না। আর সেজন্যই আমি চীনে ভ্রমণ বন্ধ করার জন্য নির্দেশ দেই। অগণিত মানুষ এর ফলে করোনা থেকে রক্ষা পায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ডব্লিউএইচও যদি শুরুতেই বিশেষজ্ঞদের দিয়ে চীনের পরিস্থিতি যাচাই করতো এবং চীনের অস্বচ্ছতা প্রকাশ করে দিতো, তাহলে প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ করা যেত, মৃত্যুও অনেক কম হত।’
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের এই পরস্পর ‘দোষারোপের রাজনীতি’ মূলত তাদের মধ্যকার তীব্র প্রতিদ্বন্দিতা ও কূটনৈতিক টানাপোড়েন থেকে জন্ম নিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত সোমবার ডব্লিউএইচওর মুখপাত্র মার্গারেট হ্যারিস মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে বলেন, ‘ইতোমধ্যে ডব্লিউএইচওর হলগুলোতে বিপদের ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে। পরিস্থিতি ভয়াবহ দিকে মোড় নিচ্ছে।’
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস মার্কিন প্রেসিডেন্টের অর্থায়ন বন্ধের সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘এখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অর্থায়ন কমানোর সঠিক সময় নয়। মহামারির মধ্যে এমন সিদ্ধান্ত ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মোড় নিতে পারে।’
এদিকে, সংকট মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে দোষারোপ করছে বলে তীব্র সমালোচনা করেছেন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ।
ট্রাম্পের সমালোচকেরা বলছেন, করোনা মোকাবিলায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে ডব্লিউএইচওকে বলির পাঁঠা বানাচ্ছেন। অন্যকে দোষ দিয়ে নিজে দায়মুক্ত হতে চাইছেন।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জাও লিজিয়ান বলেন, ‘বর্তমানে করোনা মহামারির ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আমেরিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় আর্থিক অনুদান স্থগিত করায় আমরা গভীরভাবে চিন্তিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন গোটা বিশ্বে সংকট চলছে। মার্কিন সিদ্ধান্তের কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সক্ষমতা দুর্বল হবে। মহামারির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও কমে যাবে।’
চীনের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইনস্টিটিউটে চীন-মার্কিন সম্পর্ক গবেষক কুই লেই বলেন, ‘চীনকে ক্রমাগত দোষারোপ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় আর্থিক অনুদান স্থগিত করার মতো সিদ্ধান্তে বিশ্বের মানুষের মধ্যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে। মহামারি মোকাবিলায় পরবর্তীতে চীনের সাহায্য নেওয়ার ব্যাপারে জনগণকে বোঝানো কঠিন হয়ে পড়বে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই মূহূর্তে, মহামারি মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব ও সমন্বয় প্রয়োজন। অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ডব্লিউএইচওর মতো দক্ষ নয়। মহামারি নিয়েও তাদের অভিজ্ঞতা নেই। সুতরাং ডব্লিউএইচওকে সরিয়ে দিয়ে এই মহামারি নিয়ন্ত্রণ অসম্ভবের মতো। কোনো বৈশ্বিক সমন্বয় ও নেতৃত্ব ছাড়া এই মহামারি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।’
রাজনীতি পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের এই দোষারোপের রাজনীতি খুব শিগগির কমার সুযোগ নেই বরং আরও অবনতির দিকে মোড় নিতে পারে।
Comments